উপকূলীয় অঞ্চলে বাড়ছে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের ব্যবহার

২০২০ সালের জানুয়ারিতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে ২০২১ সালের মধ্যে এ ধরনের প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করতে আদেশ দেন হাইকোর্ট। এর মধ্যে ৩ বছর কেটে গেলেও এ বিষয়ে দৃশ্যমান তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি।
ছবি: সংগৃহীত

খুলনাসহ আশেপাশের উপকূলীয় জেলাগুলোতে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের ব্যবহার ব্যাপকহারে বেড়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তদারকির অভাবে এসব প্লাস্টিকের ব্যবহার কোনোভাবেই কমানো যাচ্ছে না।

এছাড়া ব্যবহারকারীদের অসচেতনতায় উপযোগিতা ও সহজলভ্যতার কারণে এটি এখন নিত্যব্যবহার পণ্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে এর ভয়াবহতা আরও বৃদ্ধি পাবে।

পরিবেশবাদী ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের উপকূলীয় এলাকার হোটেল, মোটেল ও রেস্তোরাঁয় একবার ব্যবহারের পর বর্জ্য হয়ে যায় এমন প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যবহার বন্ধের নির্দেশনা আছে হাইকোর্টের। কিন্তু, এ নির্দেশনা অনুযায়ী পরিবেশ অধিদপ্তর যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ায়, এটি দিনদিন উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পরিবেশবাদীদের মতে, একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করতে যা করা দরকার, পরিবেশ অধিদপ্তরের তা করতে না পারার কোনো কারণ নেই। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় তারা সহজেই সরেজমিনে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে পারে এবং যারা এ আদেশ মানছে না তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে।

যেসব প্লাস্টিক পণ্য একবার ব্যবহারের পর আর কোনো কাজে লাগে না, সেগুলোই পরিচিত সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক হিসেবে।

২০২০ সালের জানুয়ারিতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে ২০২১ সালের মধ্যে এ ধরনের প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করতে আদেশ দেন হাইকোর্ট। এর মধ্যে ৩ বছর কেটে গেলেও এ বিষয়ে দৃশ্যমান তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি।

খুলনা নগরীর সাত রাস্তা মোড়ের হোটেল ব্যবসায়ী শামিম আহসান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রথমদিকে সিঙ্গেল প্লাস্টিক ব্যবহার করতাম না। কিন্তু ক্রেতাদের চাহিদার কথা বিবেচনা করে এখন এটি ব্যবহার করি। যদিও আমি এগুলো ময়লাপোতা মোড়ে সিটি করপোরেশনের এসটিএস (সেকেন্ডারি ট্রান্সফার প্ল্যান্ট) প্ল্যান্টে ফেলে দিয়ে আসি।

'করোনার সময় থেকে অধিকাংশ কাস্টমার প্লাস্টিকের গ্লাস দিতে অনুরোধ করেন, অনেকেই আবার একবার ব্যবহার করা যায় এমন প্লেট চান। ব্যবসায়িক কথা বিবেচনা করে আমি তাদেরকে এসব দেই। সত্যি কথা বলতে এগুলো পরিষ্কার করার কোনো ঝামেলা থাকে না। শ্রম কম লাগে, ব্যয় ও হয় কম,' বলেন তিনি।

এই ব্যবসায়ী আরও বলেন, 'হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ মালিকরা এটি ব্যবহার করছেন কারণ এ ধরনের প্লাস্টিক ব্যবহার করাই তাদের জন্য সুবিধাজনক।'

খুলনার লবণচরা, টুটপাড়া, রূপসা, ফুলবাড়ি গেট অঞ্চলে কমপক্ষে ১৫-১৬টি প্লাস্টিক কারখানা আছে। দিনে এসব প্লাস্টিক কারখানা বন্ধ থাকে। কিন্তু গভীর রাতে এগুলো চালু হয়। আর এখান থেকে বিভিন্ন হাতে ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে যায় সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক।

খুলনায় প্লাস্টিকের সবচেয়ে বড় মোকাম বড়বাজার। এখান থেকে খুলনার সব জায়গায় ও  আশেপাশের জেলাগুলোতে সিঙ্গেল প্লাস্টিকের বিভিন্ন আইটেম ছড়িয়ে পড়ছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন খুলনার সমন্বয়কারী বাবুল হাওলাদার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিভিন্ন সময় অভিযান করলেও, ধারাবাহিকতার অভাবে কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখছে না। খুলনা অঞ্চলের এমন কোনো বিয়ের অনুষ্ঠান বা সামাজিক অনুষ্ঠান নেই যেখানে সিঙ্গেল প্লাস্টিকের প্লেট, গ্লাস ব্যবহার করা হয় না। অনেক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে প্লাস্টিকের প্লেট ব্যবহার একটি সাধারণ ব্যাপার হয়ে গেছে। এটি ব্যাপক হারে শহর থেকে গ্রাম সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে।'

গত বছর এপ্রিলে র‌্যাবের অভিযানে খুলনায় ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনার মাধ্যমে নিষিদ্ধ ৩ হাজার ৮৭৫ কেজি পলিথিন জব্দ করা হয়। এ সময় ৩ প্রতিষ্ঠানকে ৬৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। 

খুলনা সিটি করপোরেশনের কনজারভেন্সি অফিসের তথ্য অনুযায়ী, খুলনা শহরে প্রতিদিন গড়ে ১২০০-১৬০০ মেট্রিক টন বর্জ্য তৈরি হয়। এর মধ্যে ২৫-৩০ মেট্রিক টন প্লাস্টিক বর্জ্য। এই বর্জ্যের ১০-১৫ শতাংশ সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক। যার ৫৫-৬০ শতাংশ আনকালেক্টেড থেকে যায়। এর সঙ্গে প্রায় ৫-৬ লাখ সিঙ্গেল প্লাস্টিক ব্যাগ অন্যান্য বর্জ্যের সঙ্গে মিশে ড্রেন ও জলাশয়ে যাচ্ছে।

খুলনা সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য কর্মকর্তা মো. আনিসুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের এখন বড় মাথাব্যথার কারণ এই সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক। এটি কোনোভাবেই রিসাইকেল করা যায় না। তাছাড়া চায়ের দোকান থেকে শুরু করে অন্যান্য মুদি দোকানের আশপাশে এটি বিচ্ছিন্নভাবে ছড়ানো-ছিটানো থাকায় আমাদের সংগ্রহ করতে বেগ পেতে হয়।'

খুলনা শহরের প্রায় ৩ হাজারের বেশি চায়ের দোকান ও বেকারির ব্যবহৃত সিঙ্গেল প্লাস্টিক পরিবেশ বিপর্যয়ের একটি বড় কারণ বলে মনে করেন তিনি।

বিশ্বব্যাংকের ২০২০ সালের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহার ২০২০ সালে এসে ৯ কেজি হয়েছে, যা ২০০৫ সালে ছিল ৩ কেজি। এসব প্লাস্টিকের বেশিরভাগই শেষ পর্যন্ত সাগরে গিয়ে পড়ে। এটি সমুদ্রের জীববৈচিত্র্যের অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ।

বেলা খুলনার বিভাগীয় সমন্বয়কারী মাহফুজুর রহমান মুকুল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'খুলনা অঞ্চলের নদীগুলো দিয়ে সিঙ্গেল প্লাস্টিক সুন্দরবন হয়ে সাগরে প্রবেশ করছে। বিশেষ করে যশোরের নোয়াপাড়া, খুলনার বড়বাজার চালনা, বাগেরহাটের দিগরাজ, মংলা এসব এলাকার সিঙ্গেল প্লাস্টিক ভৈরব ও পশুর নদী দিয়ে সুন্দরবনের নদী-খালে চলে যাচ্ছে। এর প্রভাব খুবই মারাত্মক। এইসব প্লাস্টিক পণ্য উপকূলীয় অঞ্চলের প্রাণ প্রকৃতির জন্য হুমকিস্বরূপ। এগুলো সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।'

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিশেষ উদ্যোগ ছাড়া এটি কোনোভাবে রোধ করা সম্ভব না বলেও মনে করেন তিনি।

তিনি বলেন, 'সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক কাপ বা গ্লাসের বিকল্প হিসেবে মাটির কাপ বা বিকল্প ব্যবহারের দিকে নজর দেওয়া জরুরি।'

গত বছরের ২৯ মার্চ এডিপি অগ্রগতি পর্যালোচনা সভায় তৎকালীন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন সুন্দরবনে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক ব্যবহার নিষিদ্ধ সংক্রান্ত নির্দেশনা প্রদান করেন।

অন্যদিকে গত ৬ মে থেকে মৌখিকভাবে পর্যটকদের সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জে প্রবেশ সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করে বনবিভাগ।

বন বিভাগ বলছে, ট্রলারে ডাস্টবিনের ব্যবস্থা থাকলেও পর্যটকরা সুন্দরবনে ট্রলারে খাওয়া-দাওয়ার পর প্লাস্টিকের পানির বোতল, প্লাস্টিকের অন্যান্য বস্তু, ওয়ান-টাইম খাবার পাত্রসহ নানা অপদ্রব্য নদীতে ফেলে পরিবেশ নষ্ট করছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানের অধ্যাপক আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দেশে বর্তমানে ৫৫ মাইক্রন পুরুত্বের পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধের আইন রয়েছে, তবে বাস্তবায়ন নেই। সেজন্য জরুরি ভিত্তিতে "পরিবেশ সুরক্ষা পুলিশ ফোর্স" গঠন করে পলিথিনের উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহারে প্রণীত আইনের কঠোর বাস্তবায়ন দরকার।'

'পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সরকারের অন্যান্য সংস্থাগুলো যদি উদ্যোগী না হয় তাহলে তো পরিবেশের যা যা বিপর্যয় হওয়ার তা হবেই,' বলেন তিনি।

এই অধ্যাপক আরও বলেন, 'কোস্টাল অঞ্চলের প্রথম সমস্যা যেটা হচ্ছে, সেটা হলো মাছের শরীরে প্লাস্টিক পাওয়া যাচ্ছে। এই মাছ সাধারণ মানুষ খাচ্ছে। মাছের মাধ্যমে এই প্লাস্টিক খাদ্যশৃঙ্খলে মানুষের মধ্যে চলে আসছে। ফলে মাছের যেমন ক্ষতি হচ্ছে, মাছের প্রজনন স্বাস্থ্যের ও ক্ষতি হচ্ছে। কারণ প্লাস্টিক যখন মাছের শরীরে প্রবেশ করে তখন স্বাভাবিকভাবে তার জীবনপ্রক্রিয়ায় এক ধরনের পরিবর্তন আসে। এর ফলে মাছের প্রজনন প্রক্রিয়া, মাছের বংশবৃদ্ধি, মাছের গ্রোথ সবকিছুই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।'

'শুধু মাছ না, অন্যান্য যে জলজ প্রাণী আছে সবার ক্ষেত্রে একই বিপর্যয় হচ্ছে। ফলে এই কোস্টাল এর সকল প্রাণ প্রকৃতির মধ্যেই কিন্তু একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে,' বলেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Love road at Mirpur: A youthful street

Certain neighbourhoods in Dhaka have that one spot where people gather to just sit back and relax. For Mirpur, it’s the frequently discussed street referred to as “Love Road”.

6h ago