চারদিকে অথৈই জলরাশি তবু সুপেয় পানির জন্য হাহাকার

উপজেলার প্রায় ১ লাখ বাসিন্দার মধ্যে ৫০ ভাগ ও পৌর এলাকায় ২৭ হাজার বাসিন্দাদের মধ্যে ২০ ভাগ মানুষ এখনো সুপেয় পানি বঞ্চিত।
ছবি: সোহরাব হোসেন/স্টার

বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী ৩৮৭ বর্গ কিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার দক্ষিণে বঙ্গাপসাগরের বিশাল জলরাশি আর অপর তিন দিকেই রয়েছে বড় বড় নদী। চারদিকে অথৈই জলরাশি থাকলেও এখানে সুপেয় পানির তীব্র সংকট। মাটির নিচে পাথরের মতো শক্ত বস্তু থাকায় নলকুপ বসানো যায় না।

ফলে উপজেলার প্রায় ১ লাখ বাসিন্দার মধ্যে ৫০ ভাগ ও পৌর এলাকায় ২৭ হাজার বাসিন্দাদের মধ্যে ২০ ভাগ মানুষ এখনো সুপেয় পানি বঞ্চিত।

পাথরঘাটা পৌর এলাকার হাজামজা পুকুরের পানি ফিল্টারিং করে বাসিন্দাদের সরবরাহ করা হয়। টাকা দিয়ে ওই পানি কিনে খেতে হয় পৌরবাসীদের। সূর্য ওঠার আগে ও সূর্য ডোবার আগ মুহূর্তে প্রান্তিক জনপদের নারী-শিশুরা সারিবদ্ধভাবে পুকুর ও বিলের ডোবা থেকে পানি আনেন। কখনো কখনো এক কলসি পানির জন্যও দুশ্চিন্তায় পড়তে হয়। উপকূলীয় উপজেলা পাথরঘাটার বিভিন্ন এলাকার চিত্র এটি। এখানকার বাসিন্দাদের মতে, বারো মাসই পানির দুঃখে কাটাতে হয়।

ছবি: সোহরাব হোসেন/স্টার

বছরের পর বছর ধরে এভাবেই চলছে এখানকার বাসিন্দাদের পানির কষ্ট। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. মেহেদী হাসান বলেন, 'মাটির নিচে পাথরের মতো বস্তু থাকায় গভীর নলকূপ বসানো যায় না। এজন্য পানির সংকট থাকে। বিশেষ করে শুকনো মৌসুমে এ সংকট আরও তীব্র হয়। পৌর এলাকায় এ সংকট সবচেয়ে বেশি। এখনকার বাসিন্দারের বেশিরভাই পুকুর, ডোবা, খাল বা নদীতে গোসল করেন।'

তিনি জানান, উপজেলার প্রায় ১ লাখ বাসিন্দার মধ্যে ৫০ শতাংশকে খাবার পানি দেওয়া সম্ভব হয়েছে। বাকি অর্ধেক জনগোষ্ঠী নিজেদের উদ্যোগে পানির ব্যবস্থা করছেন।

তিনি বলেন, 'পৌর এলাকায় দু'টিসহ উপজেলায় মোট ৪০টি পিএসএফ (পন্ড স্যান্ড ফিল্টার) রয়েছে। এসব ফিল্টারের মাধ্যমে পুকুরের পানি ফিল্টারিং করে তা সীমিত আকারে পাইপের মাধ্যমে খাবার পানি সরবরাহ করা হয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব পিএসএফ'র সাথে পানির ট্যাপ বা নলকুপ থাকে যার মাধ্যমে স্থানীয়রা প্লাস্টিকের ড্রামে বা কলসিতে পানি সংগ্রহ করে। পৌর এলাকায় এরকম ১৬টি পানির পয়েন্ট রয়েছে।'

ছবি: সোহরাব হোসেন/স্টার

'খাবার পানি সংকট দূর করতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিনামূল্যে পানির ট্যাংক বিতরণ করা হয়েছে। এসব ট্যাংকে বর্ষাকালে পানি সংরক্ষণ করে স্থানীয়রা ব্যবহার করছেন,' বলেন তিনি।

এছাড়াও এসব পয়েন্ট থেকে পানি সংগ্রহের পর ভ্যানে করে বাসা বাড়িতে নিয়মিত পানি পৌছানোর ব্যবস্থাও রয়েছে। প্রতি ২০ লিটারের এক ড্রাম পানির দাম ২০ টাকা। এ কাজে পৌর এলাকায় ৭ জন ভ্যান চালক সকাল-সন্ধ্যা পানি বিক্রির কাজে জড়িত।

৩০ বছর ধরে পানির পয়েন্ট থেকে ড্রাম বা কলস ভর্তি করে ভ্যানে বাসা বাড়িতে পানি দিয়ে আসছেন মিজানুর রহমান। তিনি জানান, গ্রাহকরা মাসিক ভিত্তিতে আবার কেউ কেউ দৈনিক পানির টাকা পরিশোধ করেন। প্রতিটি পরিবারে ১৫ থেকে ৩০ ড্রাম পানি লাগে।

মিজানুরের মতোই আরেকজন পানি সরবরাহকারী শাহ আলম জানান, পানি সরবরাহ করে প্রতিমাসে তার ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা আয় হয়, যা দিয়ে তার সংসার চলে।

জানতে চাইলে পৌরসভা সড়কের বাসিন্দা মো. বাবুল শেখ বলেন, 'আমার দু'সদস্যের পরিবারে মাসে ১০ ড্রাম খাবার পানি লাগে। এতে মাসে খাবার পানি বাবদ ২০০ টাকা দিতে হয়। এছাড়াও পৌরসভা থেকে পাইপের মাধ্যমে যে পানি সরবরাহ করে তা দিয়ে গোসলসহ গৃহস্তালির কাজে ব্যবহার করা যায়।'

এজন্য মাসে ৩০০ টাকা পরিশোধ করতে হয়। তবে সব পৌরবাসীকে পাইপের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা যাচ্ছে না।

এ বিষয়ে পৌরসভার পানি সরবরাহ শাখার কর্মকর্তা সোহেল আহমেদ বলেন, '২৭ হাজার জনসংখ্যা অধ্যুষিত পৌর এলাকার ৮০ ভাগ মানুষের জন্য পিএসএফ বা পাইপের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করতে পারছি। পৌর এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টে ১৬টি পানির পাবলিক ট্যাপ রয়েছে যার মাধ্যমে স্থানীয়রা খাবার পানি সংগ্রহ করতে পারে। শুকনো মৌসুমে পানি সংকট বেড়ে গেলে তিন মাসের জন্য আরও ১২ টি পাবলিক পানির ট্যাপ স্থাপন করে চাহিদা পূরণের চেষ্টা করা হয়। প্রতি ঘণলিটার পানি ২২ টাকা হিসেবে পৌর বাসিদের কাছে বিক্রি করা হয়।'

তিনি আরও বলেন, পৌর এলাকায় দুটি পিএসএফ ও প্রতিটি ১৬ হাজার লিটার ধারণ ক্ষমতার ২টি ওভারহেড ট্যাঙ্ক রয়েছে। বর্তমানে পৌর এলাকায় দৈনিক ২৮ লাখ লিটার পানির চাহিদার বিপরীতে ২৩ লাখ লিটার পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। বৃষ্টির পানি সংরক্ষনের জন্য ৩ হাজার পরিবারকে একটি করে পানির ট্যাঙ্ক বিনামূল্যে দেয়া হয়েছে। এছাড়াও পৌর এলাকার ৫৮ টি মিঠা পানির পুকুরগুলো পুনরায় খনন এবং সোলারের মাধ্যমে ফিল্টারগুলো সচল রাখায় পানির অভাব অনেকাংশে পূরণ হচ্ছে।

ছবি: সোহরাব হোসেন/স্টার

সরেজমিনে কয়েকটি গ্রাম ঘুরে সেসব অঞ্চলের মানুষের পানির জন্য হাহাকারের চিত্র দেখা গেছে। এক কলসি পানি সংগ্রহের জন্য নারী-পুরুষ আর শিশুদের ছুটতে হয়।

কথা হয়, চরদুয়ানী ইউনিয়নের ছহেরাবাদ গ্রামের আবদুল করিমের সঙ্গে। তিনি বলেন, 'জন্মের পর থেকেই পানির অভাব দেখছি। পুকুর, ডোবা, খালের ঘোলা পানি, পচা পানি খাওয়া অভ্যাস হয়ে গেছে। আমরা দিন মজুরী করে সংসার চালাই। সেক্ষেত্রে এক কলসি পানি আনতেই ২-৩ ঘণ্টা সময় যায়।'

একই গ্রামের বাসিন্দা আলেয়া বেগম শিশুপুত্র নিয়ে পানির জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন। তিনি বলেন, 'চরদুয়ানীর ছহেরাবাদের একটি পুকুর থেকে সৌর বিদ্যুৎ চালিত পানির প্লান্টের একটি ট্যাপ থেকে পানি আনতে হয়। প্লাস্টিকের এক ড্রাম পানি আনতে লাইনে দাঁড়াতে হয়। ড্রাম ভতি পানি আনার কষ্ট তো সহ্য করা যায়, পানির অভাব তো আর সহ্য করা যায় না।'

এদিকে, সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের পাশাপাশি ২০২২ সাল থেকে বাংলাদেশ বন্ধু ফাউন্ডেশনের সুপেয় পানি সরবরাহ প্রকল্পের আওতায় 'সৌর বিদুৎ চালিত পানির প্ল্যান্ট'র মাধ্যমে সুপেয় পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। সিসিডিবি পাথরঘাটা সদর ইউনিয়নের তিনটি গ্রামের বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য ৬০০ পানির ট্যাংক ও পাঁচটি পিএসএফ ফিল্টার নির্মাণ করে।

বাদুরতলার সাবেক ইউপি সদস্য সোহরাব হোসেন বলেন, 'চারদিকেই পানি, কিন্তু খাবার পানি নেই। সুপেয় পানির অভাব। প্যাডেল ভ্যান, রিকশা আর বাইসাইকেলে করে মিঠা পানি আনতে হয় দূর থেকে। তিন কিলোমিটার দূরে চরলাঠিমারা গ্রামের খাস পুকুর থেকে পানি আনতে হয়।'

আবার চৈত্রের খড়ায় পুকুরগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় অবস্থা আরও খারাপ হয়। উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী দেখা যায়, এ উপজেলায় ৪২টি মিঠা
পানির পুকুর পুনরায় খনন করা হয়েছে। উপজেলায় সুপেয় পানির জন্য পন্ড স্যান্ড ফিল্টার (পিএসএফ) রয়েছে ১৭০টি। সবকটিই সচল রয়েছে।

বাংলাদেশ বন্ধু ফাউন্ডেশনের পাথরঘাটা উপজেলা প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার মো. শামীম জানান, ২০১২ সাল থেকে ফাউন্ডেশনটি সেখানকার মানুষের খাবার পানি সংকট নিরসনে কাজ করছে। ২০২২ সাল থেকে এ পর্যন্ত বন্ধু ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে পাথরঘাটা উপজেলায় ১০টি সৌর বিদুৎচালিত পানি প্ল্যান্ট বসানো হয়েছে। যার মাধ্যমে জনপ্রতি পাঁচ লিটার এবং দৈনিক ৫০ হাজার লিটারের বেশি পানি বিনামূল্যে সরবরাহ করা হচ্ছে। এছাড়াও সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে পুকুর থেকে পানি তুলে তা চার ধাপে পরিষ্কার করে সাধারণের মধ্যে বিতরণ করা হয়।

পাথরঘাটা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কবির বলেন, 'জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের মাধ্যমে পানি সংরক্ষণের জন্য প্রতি বছরই কমবেশি ট্যাঙ্ক বিতরণ করা হচ্ছে। এ বছর তিন হাজার লিটারের ১৫ হাজার ৫০০টি ট্যাংক বরাদ্দ হয়েছে। তাতে অনেকাংশে পানির ঘাটতি পূরণ হবে।'

Comments

The Daily Star  | English
World Press Freedom Day 2024

Has Bangladesh gained anything by a restrictive press?

The latest Bangladesh Bank restriction on journalists is anti-democratic, anti-free press and anti-public interest.

12h ago