নদীতে এত কম পানি আগে দেখেনি পদ্মাপাড়ের মানুষ
এক সময়ের প্রমত্তা পদ্মা এখন দেখে চেনার উপায় নেই। যে নদীতে একসময় প্রবাহিত হতো সুশীতল জলধারা এখন তা পড়ে আছে বিস্তৃত বালিময় চর বুকে নিয়ে। নদীর এক পাড়ে দাঁড়িয়ে মাঝ নদীর সংকীর্ণ জলধারার দেখা পাওয়াও এখন দুষ্কর।
পানির প্রবাহ না থাকায় নদীপাড়ের মানুষের জীবন-জীবিকা এখন হুমকির মুখে। মাছ ধরে বা নৌকা বেয়ে জীবিকা চালানো জেলে ও মাঝিদের অনেকে এখন কর্মহীন।
এ বছর পদ্মায় প্রবাহ বিগত বছরগুলোর তুলনায় আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাওয়ায় পুরো নদীতে এখন ধু ধু বালুচর। প্রয়োজনীয় সেচের পানিরও সংকট।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, উজান থেকে প্রবাহ কমে যাওয়ায় পদ্মায় পানি আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। পানি চুক্তির ফলে যে পরিমাণ পানি মিলছে তা নদীর তলদেশের শুষ্কতা দূর করতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে।
পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশীর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে সেতুর নিচে বেশিরভাগ অংশ এখন মরুময়। সেতুর বেশিরভাগ পিলারের নিচেই এখন শুকনো চর।
নদীর প্রায় অর্ধেকের বেশি এলাকা পার হয়ে কিছুটা পানির দেখা মিললেও সেখানেও পানি কম হওয়ায় পণ্যবাহী নৌকা চলে না। কিছু নৌকায় দেখা যায় দর্শনার্থীদের ঘুরতে-ফিরতে। পানি কম থাকায় তাদের চলাচলেও বিঘ্ন ঘটছে।
সবচেয়ে দুর্ভোগে আছে পদ্মাপাড়ের জেলেরা। যে নদীতে এক সময় জাল ফেললেই বিপুল পরিমাণ মিঠা পানির মাছ পাওয়া যেত সে নদীতে এখন তারা সারা দিনে এক-দুই কেজির বেশি মাছ ধরতে পারছেন না। হুমকিতে পড়েছে তাদের জীবিকা।
পদ্মাপাড়ের জেলে মো. চাঁদ আলি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জীবনে এত কম পানি এর আগে কখনো দেখিনি। গত দুই মাসে দিনে দুই কেজির বেশি মাছ ধরতে পারিনি। দুই সপ্তাহ আগে এমন দিন গেছে দিনে এক কেজি মাছও ধরা পড়েনি।'
তিনি আরও বলেন, 'নদীর বেশিরভাগ অংশে পানি না থাকায় এবং বাকি অংশে খুব সামান্য পানি থাকায় বড় মাছ নেই বললেই চলে। গত বছরও দিনে গড়ে তিন থেকে চার কেজি মাছ ধরতে পারতাম।'
তার মতো একই অবস্থা অন্য জেলেদের। তাদের ভাষ্য, যে পরিমাণ মাছ পাওয়া যায় তা বিক্রি করে নৌকার তেলের খরচ তোলা যাচ্ছে না।
মাছ ধরা ছাড়া অন্য কাজে দক্ষতা না থাকায় অনেক কষ্ট করে চলতে হচ্ছে শতাধিক জেলে পরিবারকে।
শুধু মাছের আকাল নয়, পদ্মায় পানি না থাকায় সেচ সংকটে পড়েছে দক্ষিণাঞ্চলের আবাদি জমি। নদীতে পানি কম থাকায় এ বছর চালু করা যায়নি গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) সেচ প্রকল্প।
জিকে প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. আব্দুল হামিদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জিকে প্রকল্পের সেচ পাম্প চালাতে কমপক্ষে সাড়ে চার মিটার উচ্চতার পানির প্রয়োজন হয়। এ বছর মার্চের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত পানির উচ্চতা ছিল চার দশমিক শূন্য সাত মিটার। এমনিতেই জিকে প্রকল্পের তিনটি প্রধান সেচ পাম্পের দুটি দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট হয়ে আছে। এমন পরিস্থিতিতে একমাত্র পাম্পটি চালানো সম্ভব হচ্ছে না।'
জিকে প্রকল্পের সেচ পাম্প চালু না হওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলের চার জেলার প্রায় ৯৬ হাজার হেক্টর জমির চাষাবাদ হুমকিতে পড়েছে বলে জানান তিনি।
পানি পরিমাপক দপ্তর হাইড্রলজি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে—পদ্মা পানি চুক্তি অনুসারে জানুয়ারির প্রথম দিন থেকেই এ বছর গত বছরের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম পানি পাওয়া গেছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর প্রতি দফাতেই কমপক্ষে ১০ থেকে ২০ হাজার কিউসেক কম পানি পাওয়া যাচ্ছে।
যৌথ নদী কমিশন, বাংলাদেশ'র ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য মতে—এ বছর ১ জানুয়ারি থেকে ১০ মার্চ পর্যন্ত প্রতি দফায় (প্রতি দশ দিন অন্তর) পদ্মা নদীর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পানির প্রবাহ ছিল যথাক্রমে ৬৩ হাজার ১১৩ কিউসেক, ৪৮ হাজার ৫১৮ কিউসেক, ৪৮ হাজার ৩৫৯ কিউসেক, ৪৩ হাজার ৯২৬ কিউসেক, ৩৪ হাজার ৬৯৭ কিউসেক, ৩৫ হাজার ৭৫১ কিউসেক ও ৩৬ হাজার ৮১৮ কিউসেক।
গত বছর একই সময়ে পানির প্রবাহ ছিল যথাক্রমে ৮৫ হাজার ৩১৬ কিউসেক, ৭০ হাজার ৮২৭ কিউসেক, ৬৯ হাজার ৯৯০ কিউসেক, ৬৭ হাজার ৩৬৪ কিউসেক, ৫৯ হাজার ৩৭৬ কিউসেক, ৪৭ হাজার ৮৯১ কিউসেক ও ৪২ হাজার ৩৭২ কিউসেক।
পাবনা হাইড্রলজি বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রেজাউল করিম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এ বছর শুরু থেকেই পদ্মার উজানে ফারাক্কায় পানির প্রবাহ কম থাকায় চুক্তি অনুযায়ী পানি পেলেও পরিমাণগত দিক থেকে পানি অনেক কম পাওয়া যাচ্ছে।'
উজানে পানির প্রবাহ কম থাকার পাশাপাশি এ বছর শুষ্ক মৌসুমে অপেক্ষাকৃত কম বৃষ্টি হওয়ায় নদীর এ করুণ অবস্থা বলে মনে করেন তিনি।
পদ্মায় শুষ্ক মৌসুমে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিত করার জন্য ১৯৯৬ সালের ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সই করা গঙ্গার পানি চুক্তির আলোকে প্রতি বছর ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ফারাক্কা পয়েন্টে গঙ্গার পানি ও বাংলাদেশের হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পদ্মার পানি প্রবাহ পর্যবেক্ষণ করে দুই দেশ।
চুক্তি অনুযায়ী ফারাক্কা পয়েন্টে প্রথম ১০ দিন ৭০ হাজার কিউসেক বা কম পানি থাকলে দুই দেশ ৫০ শতাংশ করে পানির হিস্যা পাবে। দ্বিতীয় ১০ দিন ৭০ থেক ৭৫ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহ থাকলে বাংলাদেশ ৩৫ হাজার কিউসেক পানি পাবে এবং অবশিষ্ট পানি ভারত পাবে। শেষ দশ দিন ৭৫ হাজারের বেশি পানি থাকলে ভারত ৪০ হাজার কিউসেক পানি পাবে এবং অবশিষ্ট পানি পাবে বাংলাদেশ।
চুক্তিতে আরও বলা হয়েছে, ১১ মার্চ থেকে ১০ মে পর্যন্ত প্রতি মাসে ১০ দিনের একটি চক্র বাদ দিয়ে গ্যারান্টিযুক্তভাবে বাংলাদেশ ও ভারত ৩৫ হাজার কিউসেক করে পানি পাবে।
হাইড্রলজি বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রেজাউল করিম মনে করেন, 'বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষাপটে পানি চুক্তি নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।'
Comments