বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস

‘কুষ্ঠ রোগের হার বেশি চা শ্রমিকদের মধ্যেই, বেশি ঝুঁকিতে নারীরা’

‘কুষ্ঠ রোগী হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার ভয়ে আক্রান্ত অনেকে চিকিৎসকের কাছে যান না। অনেকে আবার কবিরাজসহ বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসা নেন। এসব কারণে সব রোগীকে চিকিৎসার আওতায় আনতে সময় লাগে।’
চা-শ্রমিক পরিবারের ঘর। ছবি: শেখ নাসির/স্টার

রূপম ভূমিজের শরীরের বিভিন্ন স্থানের চামড়া বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছিল। তিনি সেদিকে মনোযোগ দেননি। পরে দেখেন যে তার পায়ের আঙ্গুলে আলসার হয়ে যাচ্ছে এবং চা-পাতা তুলতে চা বাগানে যাওয়ার সময় সমস্যা হচ্ছে।

৫৩ বছর বয়সী রূপম বলেন, 'আমি বুঝতে পারছিলাম না যে কী হচ্ছে।'

রূপম যখন চিকিৎসার জন্য গেলেন, ততদিনে বেশ দেরি হয়ে গেছে। তার বাম পা অকেজো হয়ে গেছে, যার চিকিৎসা করানো তার পক্ষে সম্ভব নয়।

তিনি বলেন, 'এলাকায় এই খবর ছড়িয়ে পড়ার পর প্রতিবেশীরাও আমার সঙ্গে বিভিন্ন ধরণের সামাজিক বৈষম্য করছে।'

রূপম জানান, তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে ক্ষত রয়েছে। ধীরে ধীরে তিনি বাম পায়ে সংবেদন হারিয়ে ফেলেন।

রূপম ভূমিজ কোনো ব্যতিক্রম উদাহরণ না। সরকারি কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি কুষ্ঠ রোগের হার চা-শ্রমিকদের মাঝেই।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত বছর সিলেট কুষ্ঠ হাসপাতালে ২ হাজার ৯৫৯ জন কুষ্ঠ রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। মৌলভীবাজারে গত বছর নতুন করে ২৫৭ জন কুষ্ঠ আক্রান্ত হয়েছেন। এ কারণে জেলাটিকে 'রেড জোন' হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

এ ছাড়া সিলেটে ১৮০ জন, হবিগঞ্জে ১১৭ জন এবং সুনামগঞ্জে ১০৩ জন নতুন কুষ্ঠ আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের অধিকাংশই চা শ্রমিক কিংবা তাদের পরিবারের সদস্য।

কুষ্ঠ রোগের ঝুঁকিপূর্ণ জেলাগুলো হলো—মৌলভীবাজার, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, নীলফামারী, পঞ্চগড়, রংপুর, ঠাকুরগাঁও, জয়পুরহাট ও মেহেরপুর।

মৌলভীবাজারের সিভিল সার্জন চৌধুরী জালাল উদ্দিন মুর্শেদ জানান, জেলায় ৯২টি চা-বাগান রয়েছে। এই চা-বাগানের শ্রমিকরা অপুষ্টি ও অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করেন। এ কারণে তাদের মাঝে কুষ্ঠ রোগের প্রকোপ বেশি। তবে নারী শ্রমিকদের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।

চা-বাগানে কুষ্ঠ রোগ শনাক্তকরণ কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। এ কারণে রোগী শনাক্তের হার বেড়েছে। সরকার তাদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দিচ্ছে।

চৌধুরী জালাল উদ্দিন মুর্শেদ জানান, কুষ্ঠ বংশগত নয়। এটি সংক্রামক। কুষ্ঠ রোগ বাতাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তবে রোগী চিকিৎসার আওতায় এলে জীবাণু ছড়ায় না। চিকিৎসায় দেরি হলে রোগীর হাত, পা ও চোখ বিকৃত হয়ে যায়। হালকা ফ্যাকাশে বা সাদা দাগ, ত্বকে পিণ্ড বা পিম্পল—এগুলো কুষ্ঠ রোগের প্রাথমিক লক্ষণের মধ্যে অন্যতম।

তিনি বলেন, 'কুষ্ঠ রোগের কিছু লক্ষণ প্রকাশ পেলেও মানসিক ও সামাজিক লাঞ্ছনার শিকার হওয়ার ভয়ে রোগীরা প্রাথমিক পর্যায়ে হাসপাতালে আসেন না। তবে সচেতনতার মাধ্যমে কুষ্ঠ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।'

সিলেটের সিভিল সার্জন ডা. মনিসার চৌধুরী বলেন, 'কুষ্ঠ রোগী হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার ভয়ে আক্রান্ত অনেকে চিকিৎসকের কাছে যান না। অনেকে আবার কবিরাজসহ বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসা নেন। এসব কারণে সব রোগীকে চিকিৎসার আওতায় আনতে সময় লাগে।'

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সংজ্ঞা অনুসারে, একটি দেশকে 'কুষ্ঠ মুক্ত' ঘোষণা করা যেতে পারে যদি জনসংখ্যার প্রতি ১০ হাজার জনে একজনের কম কুষ্ঠ রোগী থাকে। সে হিসেবে, ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ 'কুষ্ঠ মুক্ত' দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হলেও এখনো প্রতি বছর বহু মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।

বাংলাদেশ চা সংসদের (চা বাগান মালিকদের সংগঠন) সিলেট চ্যাপ্টারের চেয়ারপারসন জিএম শিবলী বলেন, 'সামাজিক অবহেলা ও কুসংস্কারের কারণে চা শ্রমিকরা কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন এবং তাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে রোগবালাই।'

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. মোহাম্মদ নূরে আলম শামীমও বলেন, চা-বাগানে কুষ্ঠ রোগের সংক্রমণ বেশি। চা শ্রমিকদের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে।

সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্টের (সেড) গবেষক ও পরিচালক ফিলিপ গাইন বলেন, 'চা-বাগানের শ্রমিকদের অপুষ্টির সমস্যা, ভালো পরিবেশে বসবাস না করা, চা শ্রমিকদের কম মজুরি, বহু প্রজন্ম ধরে কম খাওয়া—এসব কারণে তাদের মধ্যে কুষ্ঠ রোগ হওয়ার হার বেশি। যদিও আমরা এই বিষয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক কোনো গবেষণা খুঁজে পাইনি। এর জন্য বিশদ গবেষণা প্রয়োজন।'

চা শ্রমিক রূপম ভূমিজ বলেন, 'হীড বাংলাদেশের স্টাফরা দ্য লেপ্রসি মিশন ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের অর্থায়নে আমাকে কুষ্ঠ রোগী হিসেবে চিহ্নিত করে সরকারি চিকিৎসার আওতায় আনে। কিন্তু ততদিনে আমার বাম পায়ে আলসার হয়ে গেছে। এখন দ্য লেপ্রসি মিশন ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সহায়তায় চিকিৎসা চলছে এবং আলসার কমাতে বিশেষ জুতা ব্যবহার করছি।'

স্ট্যাটিস্টিক্যাল হ্যান্ডবুক অন বাংলাদেশ টি ইন্ডাস্ট্রি ২০১৯ অনুসারে, দেশে ১৬৬টি চা-বাগান রয়েছে, যেখানে মোট এক লাখ ৪০ হাজার ১৬৪ জন চা শ্রমিক নিযুক্ত রয়েছে। সিলেট বিভাগের তিনটি জেলায়,  ১৩৫টি চা-বাগান রয়েছে, যেখানে ৪৬ হাজার ৪৫০ জন নিবন্ধিত নারী শ্রমিক ও ১৫ হাজার ১৫৩ জন নৈমিত্তিক নারী শ্রমিক কাজ করেন। যেখানে আরও পাঁচ লাখ মানুষ এই শ্রমিকদের ওপর নির্ভরশীল।

Comments

The Daily Star  | English

Floods cause Tk 14,421 crore damage in eastern Bangladesh: CPD study

The study highlighted that the damage represents 1.81 percent of the national budget for fiscal year (FY) 2024-25

2h ago