৬৪ বছরে চমেক হাসপাতালে সাধারণ শয্যা বেড়েছে ২০৮০, আইসিইউ মাত্র ৫২টি
চট্টগ্রামের রোগীদের জন্য নতুন আশা নিয়ে গত শনিবার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ৩২ শয্যা বিশিষ্ট নিবিড় পরিচর্যার দ্বিতীয় ইউনিট যাত্রা শুরু করেছে।
গত কয়েক দশক ধরে চমেক হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা খুব দ্রুত বাড়লেও আইসিইউ শয্যার সংখ্যা শামুকের গতিতে বেড়েছে।
ক্রমবর্ধমান রোগীর চাপ সামলাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পাঁচ দশকে সাধারণ শয্যার সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করলেও আইসিইউ শয্যা সংখ্যা নামমাত্র বেড়েছে।
চমেক হাসপাতাল ১৯৫৭ সালে আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতাল থেকে যাত্রা শুরু করে ও পরে ১৯৬০ সালে নগরীর কেবি ফজলুল কাদের রোডে মাত্র ১২০ শয্যা ও কয়েকটি সরঞ্জাম পরিষেবাসহ বর্তমান অবস্থানে স্থানান্তরিত হয়। তখন হাসপাতালে আইসিইউ সেবা ছিল না।
বিগত ছয় দশকে চমেক হাসপাতালকে কয়েক ধাপে ১৯৬৯ সালে ৫০০ শয্যায়, ১৯৯৬ সালে ৭৫০ শয্যায় এবং ২০০১ সালে এক হাজার ১০ শয্যার হাসপাতালে উন্নীত করা হয়। কিন্তু তখনো হাসপাতালে কোনো আইসিইউ সেবা চালু করা হয়নি।
চমেক হাসপাতালে সর্বপ্রথম আইসিইউ সেবা চালু হয় ২০০৫ সালে। শুরুতে মাত্র ছয়টি শয্যা ও সীমিত জনবল নিয়ে আইসিইউ সেবা দিয়ে যাচ্ছিল হাসপাতালটি। রোগীদের প্রচণ্ড চাপ সামাল দিতে এবং গণদাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালে শয্যা সংখ্যা নয়টি এবং ২০১৩ সালে ১২টিতে উন্নীত করা হয়।
পরবর্তীতে চমেক হাসপাতালকে ২০১৩ সালে এক হাজার ৩১৩ শয্যায় এবং ২০২২ সালের জুনে দুই হাজার ২০০ শয্যার হাসপাতালে উন্নীত করা হয়। তবে, এই সময়ের মধ্যে আইসিইউতে শয্যা সংখ্যা তেমন একটা বাড়েনি। ২০২০ সালের অক্টোবরে মাত্র আটটি শয্যা বৃদ্ধি করে আইসিইউকে ২০ শয্যার ইউনিটে উন্নীত করা হয়।
তারপরও রোগীদের ক্রমবর্ধমান চাপ সামলাতে পারছিল না চমেক হাসপাতালের আইসিইউ।
উদাহরণস্বরূপ, অবসরপ্রাপ্ত পোস্টমাস্টার নুর মোহাম্মদ চৌধুরী যখন ২০ জানুয়ারিতে মারাত্মক হৃদরোগে আক্রান্ত হন, তখন পরিবারের সদস্যরা তাকে দ্রুত চমেক হাসপাতালে নিয়ে যান। রোগীকে পরীক্ষা করার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে আইসিইউতে ভর্তির পরামর্শ দিলেও সে সময় চমেক হাসপাতালের ২০ শয্যার আইসিইউতে কোনো শয্যা খালি না থাকায় তিনি ভর্তি হতে পারেননি।
আইসিইউতে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা পরিবারের সদস্যদের জানান, ভর্তি হওয়া রোগীদের কেউ মারা না যাওয়া বা সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত নুর মোহাম্মদকে আইসিইউতে শয্যার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তবে নূর মোহাম্মদ বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে পারেননি। পরদিন তিনি মারা যান।
নুর মোহাম্মদের মতো চমেক হাসপাতালের আইসিইউতে শয্যা না পেয়ে প্রতিদিন অনেক রোগী মারা যান। চমেক হাসপাতালের কর্মকর্তাদের মতে, আইসিইউতে শয্যা না পেয়ে প্রতিদিন কমপক্ষে ১৫ জন রোগী মারা যান।
তবে চমেক হাসপাতালে ৩২ শয্যা বিশিষ্ট নিবিড় পরিচর্যার দ্বিতীয় ইউনিট চট্টগ্রামের রোগীদের জন্য নতুন আশা নিয়ে এসেছে।
'নিবিড় পরিচর্যার দ্বিতীয় ইউনিটের মাধ্যমে রোগীদের চাপ অনেকাংশেই সামাল দেওয়া যাবে। তবে দুই হাজার ২০০ শয্যার চমেক হাসপাতালে বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় দ্বিগুণ রোগী ভর্তি থাকে। রোগীর সংখ্যার অনুপাতে এখানে কমপক্ষে ১০০ শয্যা বিশিষ্ট আইসিইউ প্রয়োজন।'
শনিবার প্রধান অতিথি হিসেবে এই ইউনিটের উদ্বোধন করেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন।
উদ্বোধনের সময় মন্ত্রী বলেন, তিনি চমেক হাসপাতালের আইসিইউতে শয্যা সংখ্যা আরও বাড়ানোর উদ্যোগ নেবেন।
সর্বশেষ শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধির পর চমেক হাসপাতালের আইসিইউ ৫২ শয্যায় উন্নীত হলো। এটিকে চমেক হাসপাতালের আইসিইউর ইতিহাসে একটি বড় উদ্যোগ বলে মনে করছেন কর্মকর্তারা।
যোগাযোগ করা হলে চমেক হাসপাতালের অ্যানেস্থেসিয়া অ্যান্ড ইনটেনসিভ কেয়ার বিভাগের প্রধান ডা. হারুন-উর-রশিদ বলেন, 'শ্বাসযন্ত্রের সমস্যায় ভুগছেন এমন রোগীদের আইসিইউতে চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। তাছাড়া হার্ট অ্যাটাক, ব্রেইন স্ট্রোক, বার্ন ইনজুরি, কিডনি ডায়ালাইসিস, ট্রমা এবং দুর্ঘটনার অনেক রোগী, যারা মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছেন, তাদের অনেকেরই নিবিড় পরিচর্যার সহায়তায় চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।'
গত বৃহস্পতিবার দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'চমেক হাসপাতালের আইসিইউতে প্রতিদিন অন্তত ১৫ জন রোগী ভর্তি হতে আসেন, কিন্তু শয্যা স্বল্পতার কারণে আমরা তাদের মধ্যে বড় জোর দু-একজনকে ভর্তি করতে পারি। আমরা একজন রোগীকে তখনই শয্যা দিতে পারি, যখন একজন চিকিৎসাধীন রোগী সুস্থ হয়ে ওঠেন অথবা মারা যান।'
তিনি আরও বলেন, 'আইসিইউতে ভর্তি হওয়া অনেক রোগী দুই থেকে তিন মাস পরে সুস্থ হয়ে ওঠেন। তাই অনেক রোগী চমেক হাসপাতালের আইসিইউতে শয্যা না পেয়ে যথাযথ চিকিৎসার অভাবে মারা যায়।'
'৩২ শয্যা বিশিষ্ট নিবিড় পরিচর্যার দ্বিতীয় ইউনিট অবশ্যই চট্টগ্রামের রোগীদের জন্য নতুন আশা নিয়ে আসবে। আমরা এখন আরও বেশি রোগীকে শয্যা ও চিকিৎসা দিতে সক্ষম হবো,' যোগ করেন তিনি।
গত রোববার হাসপাতালে দেখা যায়, উদ্বোধন হওয়া ইউনিটে এখনো রোগী ভর্তি করা হয়নি। কর্তব্যরত নার্সরা জানান, পুরো ইউনিটটি আগে জীবাণুমুক্ত করা হবে এবং তারপরে রোগী ভর্তি করা হবে। এতে দুই থেকে তিন দিন সময় লাগতে পারে।
চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান বলেন, 'আইসিইউতে বেড না পেয়ে প্রতিদিন কমপক্ষে ১৫ রোগী চমেক হাসপাতালে মারা যান। দরিদ্র রোগীরা প্রাইভেট হাসপাতালে আইসিইউয়ের খরচ বহন করতে পারে না। এমনকি সচ্ছল রোগীরাও বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউতে শয্যা পেতে হিমশিম খান। কারণ, চট্টগ্রামের বেশিরভাগ হাসপাতালেই আইসিইউ সেবা নেই।'
তিনি আরও বলেন, 'নিবিড় পরিচর্যার দ্বিতীয় ইউনিটের মাধ্যমে রোগীদের চাপ অনেকাংশেই সামাল দেওয়া যাবে। তবে দুই হাজার ২০০ শয্যার চমেক হাসপাতালে বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় দ্বিগুণ রোগী ভর্তি থাকে। রোগীর সংখ্যার অনুপাতে এখানে কমপক্ষে ১০০ শয্যা বিশিষ্ট আইসিইউ প্রয়োজন।'
'আগামী দিনে আমরা ধীরে ধীরে আইসিইউতে শয্যা সংখ্যা আরও বৃদ্ধি করবো,' যোগ করেন তিনি।
Comments