পাকিস্তানের পারমাণবিক বোমার ‘কারিগর’ কেন নায়ক, কেন খলনায়ক

আব্দুল কাদির খান। ছবি: এএফপি

সাবেক সিআইএ পরিচালক জর্জ টেনেটের মতে, তিনি ছিলেন 'ওসামা বিন লাদেনের মতোই বিপজ্জনক'। আর মোসাদের সাবেক প্রধান শাবতাই শাভিত তাকে হত্যা না করতে পারার জন্য আক্ষেপ করেছিলেন।

কিন্তু পাকিস্তানের প্রায় ২৫ কোটি মানুষের কাছে আবদুল কাদির খান একজন কিংবদন্তি ও জাতীয় বীর। পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচির এই জনক অনেকটা একাই দক্ষিণ এশিয়ার দেশটিকে পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

শুধু তাই নয়, তিনি ইরান, লিবিয়া ও উত্তর কোরিয়ার মতো দেশকে পারমাণবিক কর্মসূচিতে সহায়তা করার জন্য একটি অত্যাধুনিক ও গোপন আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কও পরিচালনা করতেন।

পাকিস্তানিদের কাছে 'একিউ খান' নামে পরিচিত এই বিজ্ঞানী বিশ্বাস করতেন, পারমাণবিক বোমা তৈরি করে তিনি তার দেশকে বিদেশি হুমকি, বিশেষ করে পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী ভারত থেকে রক্ষা করেছেন। আজও তার দেশের বহু নাগরিক তেমনটাই বিশ্বাস করেন।

কেন 'ইসলামী বোমা'

১৯৭৪ সালের ১৮ মে ভারত 'স্মাইলিং বুদ্ধ' সাংকেতিক নামে তাদের প্রথম পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালায়। এর পরপরই পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো নিজের দেশের জন্য পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রতিজ্ঞা করেন। তিনি বলেছিলেন, 'প্রয়োজনে আমরা ঘাস বা পাতা খেয়ে থাকব, এমনকি ক্ষুধায় কষ্ট পাব, কিন্তু আমরা নিজেদের বোমা তৈরি করবই।'

ভুট্টো ঘোষণা করেন, 'খ্রিষ্টানদের বোমা আছে, ইহুদিদের বোমা আছে, এখন হিন্দুদেরও বোমা হলো। তাহলে ইসলামী বোমা থাকবে না কেন?'

তার এই স্বপ্ন পূরণের দায়িত্বে এগিয়ে আসেন আবদুল কাদির খান। ১৯৩৬ সালে ব্রিটিশ ভারতে জন্মগ্রহণ করা কাদির খান করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি অর্জনের পর বার্লিনে ধাতুবিদ্যা প্রকৌশল নিয়ে পড়াশোনা করেন। এরপর তিনি নেদারল্যান্ডস ও বেলজিয়ামেও উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন।

১৯৭৪ সালের দিকে তিনি আমস্টারডামে ইউরোপের পারমাণবিক চুল্লির জন্য ইউরেনিয়াম সরবরাহকারী একটি প্রধান কোম্পানি 'ইউরেনকো'-এর সাবকন্ট্রাক্টর হিসেবে কাজ করছিলেন। সেখানে বিশ্বের সেরা সেন্ট্রিফিউজের নকশা ও গোপনীয় তথ্য তার হাতের নাগালে চলে আসে। এই সেন্ট্রিফিউজ ব্যবহার করেই ইউরেনিয়ামকে বোমার জ্বালানিতে পরিণত করা হয়।

১৯৭৬ সালের জানুয়ারিতে তিনি হঠাৎ করেই নেদারল্যান্ডস ত্যাগ করেন। পরে তার বিরুদ্ধে ইউরেনিয়াম সেন্ট্রিফিউজের নকশা চুরির অভিযোগ ওঠে। পাকিস্তানে ফিরে তিনি রাওয়ালপিন্ডিতে একটি গবেষণা পরীক্ষাগার স্থাপন করেন এবং গোপনে পারমাণবিক অস্ত্রের জন্য ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার কাজ শুরু করেন।

কয়েক বছর ধরে এই কার্যক্রম সম্পূর্ণ গোপনে চলেছিল। কাঁচামাল আমদানি করা হতো টেক্সটাইল মিলের যন্ত্রাংশের নামে। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী এই প্রকল্পে পূর্ণ সমর্থন দিলেও জুলফিকার আলী ভুট্টো ছাড়া বেসামরিক সরকারের কেউই এ বিষয়ে কিছুই জানত না। এমনকি ভুট্টোর মেয়ে ও পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোও ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক প্রযুক্তি বিনিময়ের বিষয়ে অন্ধকারে ছিলেন। ১৯৮৯ সালে তেহরানে ইরানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে এক বৈঠকে তিনি প্রথম এ কথা জানতে পেরে হতবাক হয়ে যান।

হত্যার হুমকি ও অন্তর্ঘাতের চেষ্টা

১৯৭৯ সালে একটি ম্যাগাজিনে কাদির খানের কার্যক্রম ফাঁস হয়ে গেলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ইসরায়েল এই কর্মসূচিতে বাধা দেওয়ার জন্য বহু চেষ্টা করে। কাদির খানের সঙ্গে ব্যবসা করা ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তাদের টার্গেট করা হয়। পশ্চিম জার্মানির এক ব্যবসায়ীর কাছে লেটার বোমা পাঠানো হয়, যাতে তিনি বেঁচে গেলেও তার কুকুরটি মারা যায়।

ঐতিহাসিকদের মতে, ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ কাদির খানকে হত্যার চেষ্টাসহ নানাভাবে হুমকি দিয়েও পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচি ঠেকাতে ব্যর্থ হয়।

গত শতাব্দীর আশির দশকের শুরুতে ইসরায়েল ভারতের সঙ্গে মিলে পাকিস্তানের কাহুটা পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা ফেলার পরিকল্পনাও করেছিল। তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এই হামলায় সম্মতিও দিয়েছিলেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ভারতের জামনগর বিমানঘাঁটি থেকে ইসরায়েলি এফ-১৬ ও এফ-১৫ বিমান উড়ে গিয়ে হামলা চালাত। তবে শেষ মুহূর্তে ইন্দিরা গান্ধী পিছিয়ে যাওয়ায় সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।

ভারত ও ইসরায়েলের বিরোধিতা সত্ত্বেও পাকিস্তান এই প্রকল্পে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের গোপন সহায়তা পেয়েছিল। আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসনের পর পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হয়ে ওঠে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচির দিকে চোখ বন্ধ করে রাখে এবং বিজ্ঞানীদের কারিগরি প্রশিক্ষণও দেয়।

নায়ক থেকে গৃহবন্দী

১৯৯৮ সালের ১১ মে ভারত পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালালে এর জবাবে পাকিস্তানও একই মাসের শেষে বেলুচিস্তান মরুভূমিতে সফল পরীক্ষা চালায়। এর মাধ্যমে পাকিস্তান বিশ্বের সপ্তম পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং কাদির খান জাতীয় বীরে পরিণত হন। তার গাড়িবহরের আকার ছিল প্রধানমন্ত্রীর মতোই এবং তাকে সেনাবাহিনীর কমান্ডোরা নিরাপত্তা দিত।

কিন্তু পর্দার আড়ালে কাদির খান আরও একটি দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করছিলেন। আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে তিনি একটি আন্তর্জাতিক পারমাণবিক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন, যা ইরান, উত্তর কোরিয়া ও লিবিয়ায় প্রযুক্তি ও নকশা পাঠাত।

২০০৩ সালে লিবিয়ার স্বৈরশাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পাওয়ার আশায় কাদির খানের এই নেটওয়ার্ক ফাঁস করে দেন। তিনি সিআইএ এবং এমআই-৬ কে জানান, কাদির খান তার সরকারের জন্য পারমাণবিক স্থাপনা তৈরি করছেন। এরপরই তদন্তে বেরিয়ে আসে সব চাঞ্চল্যকর তথ্য।

২০০৪ সালে কাদির খান টেলিভিশনে এসে এই নেটওয়ার্ক পরিচালনার কথা স্বীকার করে বলেন, তিনি একাই এই কাজ করেছেন এবং পাকিস্তান সরকার এর সঙ্গে জড়িত নয়। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ তাকে 'আমার নায়ক' বলে অভিহিত করে সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষমা করে দেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের চাপে তাকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ইসলামাবাদে গৃহবন্দী করে রাখা হয়।

কাদির খান পরে বলেছিলেন, 'আমি পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র তৈরি করে প্রথমবার দেশ বাঁচিয়েছি এবং সব দোষ নিজের কাঁধে নিয়ে দ্বিতীয়বার দেশকে রক্ষা করেছি।'

২০২১ সালে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তাকে 'জাতীয় প্রতীক' হিসেবে আখ্যা দেন। আজও পাকিস্তানে তিনি এভাবেই স্মরণীয় হয়ে আছেন।

Comments

The Daily Star  | English

Yunus promises election on time

Chief Adviser Prof Muhammad Yunus yesterday reaffirmed his commitment to holding the 13th national election in the first half of February next year.

8h ago