গাজায় ত্রাণ নিতে গিয়ে বেঁচে ফেরা এক ফিলিস্তিনির অভিজ্ঞতা

গাজায় ত্রাণ নিতে গিয়ে প্রতিনিয়ত প্রাণ হারাচ্ছেন ফিলিস্তিনিরা। গত ২৭ মে থেকে এ পর্যন্ত ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রগুলোয় খাবারের জন্য অপেক্ষারত অন্তত ৫৮৩ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। এই মৃত্যু উপত্যকায় যখন দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি, তখন প্রতিদিনই হত্যা করা হচ্ছে নিরন্ন মানুষদের।
সম্প্রতি গাজা সিটিতে ত্রাণ নিতে গিয়েছিলেন ৪০ বছর বয়সী ইউসেফ আল-আজুরি। তিনি নিজের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন মিডিল ইস্ট আইয়ের ফিলিস্তিনি সাংবাদিক আহমেদ দ্রেমলিকে। অনুবাদের সংক্ষিপ্ততা ও স্পষ্টতার জন্য তার দেওয়া বিবরণ সম্পাদনা করা হয়েছে।
ইউসেফ আল-আজুরির ভাষ্য
আমার বাচ্চারা সারাক্ষণ ক্ষুধার জ্বালায় কাঁদে। ওরা রুটি চায়, ভাত চায়—খাওয়া যায় এমন যেকোনো কিছু চায়। অথচ কিছুদিন আগেও আমার ঘরে আটা ও অন্যান্য খাবার ছিল। এখন সব শেষ। আমরা এখন ত্রাণ সংস্থার খাবারের ওপর নির্ভরশীল। ওখানে যে মসুর ডাল দেয় তাতে আমার সন্তানদের ক্ষুধা মেটে না।
আমি স্ত্রী, সাত সন্তান ও মা-বাবাকে নিয়ে গাজা সিটির আল-সারায়া এলাকায় তাঁবুতে থাকি। ২০২৩ সালের অক্টোবরে উত্তর গাজায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর আগ্রাসনের সময় জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরে আমাদের বাড়িটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়।
যুদ্ধের আগে ট্যাক্সি চালাতাম। জ্বালানি তেলের অভাব আর ইসরায়েলিদের অবরোধের কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ত্রাণ আনতে যাইনি, কিন্তু খাদ্যসংকট এখন অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। তাই সিদ্ধান্ত নেই, সালাহ আল-দিন সড়কে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তাপুষ্ট গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশনের ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে যাব।
আগেই শুনেছিলাম, ওখানে যাওয়া বিপজ্জনক। সেখানে মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে। এরপরও যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। একজন বলেছিল, যদি সাত দিনে একবারও যাওয়া যায়, তবে হয়তো পরিবারের জন্য খাবার জুটে যেতে পারে।
জুন ১৮, রাত প্রায় ৯টা। শুনতে পেলাম পাশের তাঁবুতে পরিবারের পুরুষ সদস্যরা ত্রাণকেন্দ্রে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমি আমার ৩৫ বছর বয়সী প্রতিবেশী খলিল হাল্লাসকে বললাম, আমিও সঙ্গে যেতে চাই। খলিল আমাকে ঢিলেঢালা পোশাক পরতে বলল, যাতে দৌড়াতে পারি।
সে জিনিসপত্র বয়ে আনার জন্য ব্যাগ নিতে বলল। প্রচণ্ড ভিড়ের কারণে ত্রাণের বাক্স বয়ে আনা সম্ভব হয় না।
স্ত্রী আসমা (৩৬) ও মেয়ে দুয়া (১৩) আমাকে যেতে উৎসাহ দেয়। তারা খবরে দেখেছে যে নারীরাও ত্রাণ আনতে সেখানে যাচ্ছেন। তারাও আমার সঙ্গে যেতে চায়। আমি তাদেরকে বললাম, জায়গাটা অত্যন্ত বিপজ্জনক।
আমি আরও পাঁচজনের সঙ্গে রওনা হলাম, তাদের একজন প্রকৌশলী ও অন্যজন শিক্ষক। আমাদের কয়েকজনের জন্য ওটাই ছিল প্রথম যাওয়া। আমরা 'টুকটুকে' চড়ি। গুণে দেখি মোট ১৭ জন। তাদের মধ্যে ১০-১২ বছর বয়সী শিশুও ছিল।
গাড়িতে থাকা এক যুবক, যে আগেও ওই পথ দিয়ে গিয়েছিল, আমাদের ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর নির্ধারিত রাস্তা দিয়ে যেতে নিষেধ করল। সে বলল, ওই পথে প্রচণ্ড ভিড় থাকে। ওদিক দিয়ে গেলে কোনো ত্রাণই পাব না। সে আমাদের নির্ধারিত রাস্তার কাছাকাছি বিকল্প পথ দিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিল।
টুকটুকটি আমাদের মধ্য গাজার নুসেইরাতে নামিয়ে দেয়। সেখান থেকে আমরা প্রায় এক কিলোমিটার হেঁটে সালাহ আল-দিন সড়কের দিকে যাই।
রাস্তাটা ছিল ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকার। আমরা টর্চলাইট ব্যবহার করতে পারছিলাম না, কারণ তাতে ইসরায়েলি স্নাইপারদের নজরে পড়ার আশঙ্কা ছিল। একটু খোলা জায়গা আমাদের হামাগুড়ি দিয়ে পার হতে হয়েছে।
হামাগুড়ি দেওয়ার সময় আমি পাশে তাকিয়ে অবাক হয়ে দেখলাম, বেশ কয়েকজন নারী ও বয়স্ক মানুষও আমাদের মতোই হামাগুড়ি দিচ্ছেন।
এক পর্যায়ে আমার চারপাশে বৃষ্টির মতো গুলি শুরু হয়। আমরা একটি বিধ্বস্ত ভবনের আড়ালে গিয়ে লুকাই। যে-ই নড়াচড়া করছিল বা চোখে পড়ার মতো কিছু করছিল, স্নাইপাররা সঙ্গে সঙ্গে তাকে গুলি করছিল।
আমার পাশেই হালকা চুলের লম্বা এক যুবক তার ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে পথ দেখছিল। অন্যরা তাকে চিৎকার করে আলো নিভাতে বলে। কয়েক সেকেন্ড পরেই তাকে গুলি করা হয়।
সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সে মারা যায়। কাছের কয়েকজন লোক পরে তার মৃতদেহ তার সঙ্গে আনা খালি বস্তাটি দিয়ে ঢেকে দেয়। আমি মাটিতে পড়ে থাকা আরও অন্তত ছয়জনের লাশ দেখেছি।
রাত প্রায় ২টায় ত্রাণকেন্দ্রে ঢুকতে দেওয়া হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই দূরে একটি বড় সবুজ আলো জ্বলে উঠে। সেটা ছিল ত্রাণকেন্দ্র খোলার সংকেত। সঙ্গে সঙ্গে লোকজন সেদিকে দৌড়াতে শুরু করে। আমিও যত দ্রুত পারলাম দৌড়াতে শুরু করি।
বিশাল ভিড় দেখে হতবাক হয়ে যাই। আমি জীবন বাজি রেখে সেখানে গিয়েছিলাম, অথচ হাজার হাজার মানুষ আমার আগেই পৌঁছে গেছে। আমি ভাবতে শুরু করলাম, তারা কীভাবে সেখানে পৌঁছাল? তারা কি ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সঙ্গে কাজ করে? নাকি তারা আমাদের মতোই বা তার চেয়েও বেশি ঝুঁকি নিয়ে এখানে এসেছে?
আমি সামনে এগোতে চেষ্টা করেও পারলাম না। ভিড়ের কারণে কেন্দ্রটি আর দেখা যাচ্ছিল না।
মানুষ ধাক্কাধাক্কি করছিল। সিদ্ধান্ত নিলাম, এর মধ্য দিয়েই যেতে হবে—অন্তত আমার সন্তানদের জন্য। আমার জুতো খুলে ব্যাগে রাখলাম এবং জোর করে ভিড়ের মধ্যে ঢুকতে শুরু করলাম। আমার ওপরে মানুষ ছিল, আমিও অন্যদের ওপরে ছিলাম। দেখলাম, পদদলিত এক মেয়ের প্রায় দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমি তার হাত ধরে বাইরে ঠেলে দিলাম।
আমি ত্রাণের বাক্স হাতড়াতে শুরু করলাম। একটা ব্যাগ ধরে মনে হলো চাল হবে হয়ত। কিন্তু যেই আমি সেটা ধরলাম, অন্য একজন আমার হাত থেকে তা ছিনিয়ে নিল। আমি ধরে রাখার চেষ্টা করলাম, কিন্তু সে আমাকে ছুরি মারার হুমকি দিল। সেখানে বেশিরভাগ লোকের কাছেই ছুরি ছিল। হয়ত নিজেদের রক্ষা করার জন্য অথবা অন্যদের খাবার কেড়ে নেওয়ার জন্য।
অবশেষে, আমি চারটি ক্যান, এক কেজি গম ও আধা কেজি পাস্তা জোগাড় করতে পারলাম।
মুহূর্তের মধ্যেই বাক্সগুলো খালি হয়ে গেল। নারী, শিশু ও বৃদ্ধসহ বেশিরভাগ মানুষই কিছু পেল না। খালি শক্ত কাগজের বাক্স ও কাঠের তক্তাগুলো মানুষ নিয়ে যাচ্ছিল, রান্নার জন্য জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করার জন্য। যারা কিছু পেল না, তারা হুড়োহুড়ির সময় মাটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা খাবার কুড়াতে শুরু করল।
আমি মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম, ১০-২০ মিটার দূরে ইসরায়েলি সেনারা দাঁড়িয়ে আছে। তারা একে অপরের সঙ্গে কথা বলছিল, ফোন ব্যবহার করছিল এবং আমাদের ভিডিও করছিল। কেউ কেউ আমাদের দিকে অস্ত্র তাক করে রেখেছিল।
আমার কোরিয়ান টিভি শো 'স্কুইড গেম'র এক দৃশ্যের কথা মনে পড়ল, যেখানে মানুষ হত্যা ছিল বিনোদন—খেলা।
তারা আমাদের শুধু তাদের অস্ত্র দিয়েই হত্যা করছিল না, ক্ষুধা আর অসম্মান করেও হত্যা করছিল, আর তারা তা দেখে হাসছিল।
আমাদের বন্ধু ওয়ায়েলের হাতে আঘাত লাগায় আমি, খলিল ও আরও কয়েকজন নুসেইরাতের আল-আওদা হাসপাতালে গেলাম।
হাসপাতালে যা দেখলাম, তাতে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। এক কক্ষে কমপক্ষে ৩৫ জনের লাশ পড়েছিল। এক ডাক্তার আমাকে বললেন, এদের সবাইকে একদিনে আনা হয়েছে। ত্রাণকেন্দ্রের কাছে লাইনে দাঁড়ানোর সময় তাদের প্রত্যেককে মাথায় বা বুকে গুলি করা হয়েছে। তাদের ছেলেমেয়েরা অপেক্ষা করছিল যে তারা খাবার নিয়ে বাড়ি ফিরবে। এখন তারা লাশ। আমি ওই পরিবারগুলোর কথা ভেবে ভেঙে পড়লাম। নিজেই নিজেকে বললাম: সন্তানদের খাওয়ানোর জন্য কেন আমাদের মরতে হচ্ছে?
সেই মুহূর্তে, আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমি আর কখনো সেসব জায়গায় যাব না। আমরা চুপচাপ হেঁটে ফিরলাম। বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে সাতটার দিকে আমি বাড়ি পৌঁছালাম।
স্ত্রী-সন্তানরা আমার অপেক্ষায় ছিল, এই আশায় যে আমি নিরাপদে ও জীবিত ফিরেছি এবং খাবার নিয়ে এসেছি। আমাকে প্রায় খালি হাতে ফিরতে দেখে তারা হতাশ হলো।
এটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন দিন। সেদিনের মতো অপমান আমি আর কখনো বোধ করিনি।
আমার তিন বছরের ছেলে ইউসেফ ঘুম থেকে উঠে কেঁদে বলে, সে খেতে চায়। আমাদের তাকে দেওয়ার মতো কিছুই নেই। সে কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে চুপ হয়ে যায়।
আমি দিনে একবার খাই, বা কখনো কখনো কিছুই খাই না, যাতে বাচ্চারা খেতে পারে। এটা জীবন নয়। ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া।
Comments