বিশ্লেষণ

মমতার ‘ভাষা আন্দোলন’ শুধুই কি রাজনৈতিক

তৃণমূল কংগ্রেসের সমাবেশে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফাইল ছবি; এএফপি
তৃণমূল কংগ্রেসের সমাবেশে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফাইল ছবি; এএফপি

বাংলা ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম ভাষা। সরকারি তথ্য বলছে—প্রায় ১৪৩ কোটি দেশটির ৯ কোটি ৭০ লাখের বেশি মানুষ বাংলায় কথা বলেন। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামের বরাক উপত্যকায় সরকারি ভাষা বাংলা। ঝাড়খণ্ডে এটি দ্বিতীয় সরকারি ভাষা। এ ছাড়াও, কেন্দ্র-শাসিত আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জেও বাংলা ব্যাপক ব্যবহৃত হয়।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই ভাষায় সাহিত্য রচনা করেছিলেন। বাংলায় তারই লেখা গান আজকের ভারতের জাতীয় সংগীত। এখন প্রশ্ন—এই বাংলা কীভাবে ভারতে বিদেশিদের ভাষা হয়ে গেল?

সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে—হরিয়ানা, দিল্লি, উড়িষ্যা, গুজরাট ও রাজস্থানসহ অন্যান্য রাজ্যে অবৈধ বাংলাদেশি সন্দেহে বাঙালিদের নিপীড়নের অভিযোগ উঠছে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেসের অভিযোগ বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলোয় বাঙালিরা নিগৃহীত হচ্ছেন। পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দাদের 'বাংলাদেশি' ও 'রোহিঙ্গা' হিসেবে সন্দেহ ও আটক করা হচ্ছে। কাঁটাতার টপকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার পর 'ভুল' হয়েছে বলে অনেককে ভারতে ফেরত নেওয়া হচ্ছে।

বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক লড়াই শুরু হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যে। রাজনৈতিক ময়দান থেকে খেলার ময়দানেও ছড়াচ্ছে এই বিতর্ক। প্রতিবাদ জানিয়ে ইস্ট বেঙ্গল ফুটবল দলের নির্ধারিত গ্যালারির ব্যানারে লেখা হয়েছে—

ভারত স্বাধীন করতে সেদিন পরেছিলাম ফাঁসি!

মায়ের ভাষা বলছি বলে, আজকে 'বাংলাদেশী'?

প্রতীকী ছবি: সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি: সংগৃহীত

অন্যদিকে, বিজেপি নেতা ও আইটি সেলের প্রধান অমিত মালব্যের ভাষ্য, 'আসলে বাংলা নামে কোনো ভাষা নেই'। তার মতে, 'বেঙ্গলি' বলতে জাতি বোঝায়, কোনো 'ভাষাগত সাদৃশ্য' বোঝায় না।

তিনি এ কথা বলে দিল্লি পুলিশের চিঠিতে 'বাংলাদেশি ভাষা' লেখার প্রতি সাফাই গেয়েছেন। তার ওই বক্তব্যের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচিত বিজেপির রাজ্যসভার সদস্য শমীক ভট্টাচার্য।

এই পরিস্থিতিতে বিজেপিকে 'বাংলাবিরোধী' আখ্যা দিয়ে ভাষা আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন মমতা।

গত ৪ আগস্ট দ্য হিন্দু জানায়—পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতার প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এমকে স্ট্যালিন। দক্ষিণ ভারতের এই নেতা বাংলাকে দিল্লি পুলিশের চিঠিতে 'বাংলাদেশি ভাষা' বলার প্রতিবাদ করেছেন। তিনি বলেন, 'যে ভাষায় আমাদের জাতীয় সংগীত লেখা হয়েছে এটি সেই ভাষার প্রতি সরাসরি অপমান।'

অ-হিন্দি ভাষাগুলোর ওপর ক্ষমতাসীন বিজেপির এমন 'আক্রমণের' প্রেক্ষাপটে মমতা পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ও ভাষার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন বলেও মন্তব্য করেন স্ট্যালিন।

গত ২৮ জুলাই ভারতীয় গণমাধ্যম জানায়—ভারতে বাংলা ভাষা রক্ষায় পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার বোলপুর-শান্তিনিকেতন থেকে 'দ্বিতীয় ভাষা আন্দোলন' শুরু করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নিজের হাতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবি ও নেতা-কর্মী-সমর্থকদের হাতে বাংলা অক্ষরের 'কাট-আউট' নিয়ে দীর্ঘ মিছিল করেন মুখ্যমন্ত্রী।

রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের এক বছরের কম সময় আগে তিনি রাজ্যজুড়ে এই আন্দোলন শুরু করলেন। জনসভাগুলোয় মমতা বলছেন, বিজেপির মনে 'বাংলাভীতি' ঢুকেছে। তিনি বাংলা তথা পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলা ভাষাকে বিজেপির 'রোষ' থেকে রক্ষা করতে চান।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা। ছবি: স্টেটসম্যান
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা। ছবি: স্টেটসম্যান

তবে মমতার এই আন্দোলনকে 'ভোটব্যাংকের রাজনীতি' বলে কটাক্ষ করছেন বিজেপি নেতারা। অমিত মালব্যের ভাষ্য, দেশের সুরক্ষার সঙ্গে সমঝোতা করছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। তার ভাষ্য, মমতা 'ভাষা'কে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন।

তবে 'বাংলা নামে কোনো ভাষা নেই' বলে বিজেপি যে এখন রাজনৈতিকভাবে 'ব্যাকফুটে' আছে তা বোঝা গেল রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ দিবসে অমিত মালব্যের টুইটে। গত শুক্রবার তিনি রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ দিবসে বিশ্বকবি, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও জাতীয় চেত‍না গঠনে বাংলা ভাষার ভূমিকার কথাও সমান গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করেন।

তবে অমিত মালব্যের কথায় যে 'ক্ষতি' হয়েছে তা তার পরের টুইটে ঢাকা যায়নি। বিজেপির সভাপতি জগৎ প্রকাশ নাড্ডার কাছে বিজেপি বাঁচাও কমিটির চিঠিতে বলা হয়েছে, 'অমিত মালব্যকে পশ্চিমবঙ্গে পাঠাবেন না'।

'বাঙালি অস্মিতা' নাকি বাংলার রাজনীতি

গত ২২ জুলাই আগের দিনের ঘটনা নিয়ে সংবাদ প্রতিদিনের এক ভিডিও প্রতিবেদনে বলা হয়—'বাংলা ভাষার ওপর সন্ত্রাস চলছে। একুশের মঞ্চ থেকে ভাষা আন্দোলনের ডাক মমতার।' সেই মঞ্চ থেকে তিনি 'বাংলা ও বাংলা মাকে' রক্ষার আহ্বান জানান। সেই মঞ্চে বাংলা ভাষা ও বাঙালির অস্মিতা রক্ষার প্রসঙ্গ তুলে ধরেন তিনি।

প্রতিবেদনটিতে মমতার 'ভাষা আন্দোলন'র প্রেক্ষাপটে বুদ্ধিজীবীদের বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার সংবাদমাধ্যমটিকে জানান, বাংলাভাষী শিক্ষক-চিকিৎসকরা আক্রান্ত হচ্ছেন না। গরিব-দুর্বল মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। তাদের দুর্বলতা কাটানোর ও তাদেরকে নিজেদের রাজ্যে কাজ দেওয়ার উপায় বের করতে হবে। শুধু ভাষার ওপর নজর দিলে হবে না।

পশ্চিমবঙ্গের বাজেট অধিবেশনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা। ছবি: স্টেটসম্যান
পশ্চিমবঙ্গের বাজেট অধিবেশনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা। ছবি: স্টেটসম্যান

সাহিত্যিক স্বপ্নময় চক্রবর্তী মনে করেন, শুধু 'অস্মিতা'র কথা বলে লাভ নেই। তার প্রশ্ন 'গত কুড়ি বছর কী দিয়েছি? বাঙালির অবদানটা কোথায় আছে? নতুন করে ভাষা আন্দোলন করতে হলে তার ছক কী? কিভাবে আন্দোলনটা হবে?'

সাহিত্যিক বিনোদ ঘোষাল বলেন, 'বাঙালির আত্মপরিচয় হচ্ছে বাংলা ভাষা। ফলে পৃথিবীর যেখানেই আমাদের মাতৃভাষার প্রতি কোনো অবমাননা হবে, ভাষার কারণে যদি ভারতবর্ষে কোথাও কোনো বাঙালিকে অপমানিত হতে হয়, সেটা অবশ্য প্রতিবাদযোগ্য।'

'বাংলাদেশি ভাষা বলে কোনো ভাষা নেই,' উল্লেখ করে সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় আনন্দবাজার পত্রিকাকে বলেন, 'বাংলা ভাষা কোনটা আর বাংলাদেশি ভাষা কোনটা এটা আইডেনটিফাই করার ভার কোনো পুলিশ কর্তৃপক্ষের নেই। এটা স্বভাবতই আমরা বাঙালিরা ডিসাইড করবো কোনটা বাংলা আর কোনটা বাংলা নয়। বাংলাদেশে বাংলা ভাষাই বলা হয়। আমাদের দেশে বাংলা ভাষা বলা হয়।'

পরিযায়ী শ্রমিকদের হেনস্থা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'পরিযায়ী শ্রমিক সব দেশেই আছে। পশ্চিমবঙ্গে বাইরের অনেক পরিযায়ী শ্রমিক আসে। কোনো রকমের গণ্ডগোল তো হয় না।'

গত ৫ আগস্ট সংবাদমাধ্যমটির অনলাইনে প্রকাশিত ভিডিওতে তিনি এসব কথা বলেন। সেই ভিডিওতে ভাষ্যকার বলেন, 'বাংলা ভাষার অবমাননায় প্রতিবাদ জানিয়েছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে শুধু প্রশাসনিক স্তরেই নয়, সাধারণ বাংলাভাষী মানুষও ব্যথিত, অপমানিত এবং ক্ষুব্ধ।'

তার প্রশ্ন—বাংলাদেশি চিহ্নিত করতে গিয়ে তবে কি আত্মঘাতী গোল করে ফেললো দিল্লি পুলিশ আর বিজেপি?

এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা ভাষা ও বাঙালি নিয়ে কথা বলেছেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। মুখ খুলেছেন বলিউডের কাজল থেকে শুরু করে টলিউডের প্রসেনজিৎ।

বক্তব্য রাখছেন তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা মমতা। ছবি: স্টেটসম্যান
বক্তব্য রাখছেন তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা মমতা। ছবি: স্টেটসম্যান

আগামী বছর পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন। বিজেপির দাবি—মমতাকে চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় দেখতে চায় না রাজ্যবাসী। মুখে মমতা 'অস্মিতা'র কথা বললেও বাস্তবে বাংলা ও বাঙালির জন্য তিনি কী করেছেন?

মমতা-বিরোধী অনেকের মত—ভাষা আন্দোলনের ডাক দেওয়া হলেই কি বাংলা ও বাঙালি বেঁচে যাবে? পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষার উন্নয়নে কী করছে রাজ্য সরকার?

আর তৃণমূল নেত্রীর মতো তার দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকরা বলছেন, পশ্চিমবঙ্গে ভোটে সুবিধা করতে পারছে না বলেই বাংলা ও বাঙালির ওপর বিজেপির এত ক্ষোভ।

তাহলে সেই প্রশ্নই মনে জাগছে আবার— মমতার 'ভাষা আন্দোলন' শুধুই কি রাজনৈতিক?

 

Comments

The Daily Star  | English

Bangladesh, Malaysia to take part in regional peace mission to Myanmar

Securing peace in Myanmar is a great priority, said Malaysian Prime Minister Anwar Ibrahim at a joint press conference today

1h ago