‘গণহত্যা’র স্বীকৃতি দিলেন নেতানিয়াহু, কিন্তু...

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ছবি: এএফপি
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ছবি: এএফপি

অবশেষে 'গণহত্যা'র বিষয়টি স্বীকার করে নিলেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তবে গাজায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে নয়। এমনকি, ইসরায়েলেরও কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই সেই গণহত্যায়।

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে আর্মেনীয়, আসিরীয় ও গ্রিক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তুরস্কের ওসমানীয় (অটোম্যান) সাম্রাজ্যের শেষ দিনগুলোয় সাম্রাজ্যের ভেতর 'গণহত্যা'র আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছেন নেতানিয়াহু।

আজ বুধবার ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমগুলোতে এই তথ্য জানানো হয়েছে।

পডকাস্টে স্বীকৃতি দিলেন নেতানিয়াহু

ইসরায়েল কেন আর্মেনীয় 'গণহত্যা'র স্বীকৃতি দেয়নি?—এই প্রশ্নের জবাবে নেতানিয়াহু বলেন, 'আমার মনে হয় আমরা (স্বীকৃতি) দিয়েছি। আমার ধারণা, নেসেটে (ইসরায়েলি পার্লামেন্ট) এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।'

তবে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, আদতে এ ধরনের কোনো বিল বা আইন নেসেটে পাস হয়নি।

প্যাট্রিক বেত-ডেভিড তার পডকাস্টে নেতানিয়াহুকে আবারও প্রশ্ন করেন, 'কেন এখন পর্যন্ত কোনো ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ওই গণহত্যার স্বীকৃতি দেননি?' এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'এই মাত্রই তো আমি স্বীকৃতি দিলাম।'

মার্কিন-ইরানি দ্বৈত নাগরিক বেত-ডেভিডের পূর্বপুরুষ আসিরীয় বংশোদ্ভূত ও খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী।

এর আগে, ২০০১ সালে তুরস্ক-ইসরায়েলের মধ্যে যখন দহরম মহরম ছিল তখন তৎকালীন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী শিমন পেরেস আর্মেনীয় 'গণহত্যা'র অভিযোগকে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। তিনি একে 'আর্মেনিয়ার ষড়যন্ত্র' বলে অভিহিত করেন।

২০১৮ সালে নেসেটে আর্মেনীয় 'গণহত্যা'র স্বীকৃতি দেওয়ার বিল উত্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও যথেষ্ট সমর্থনের অভাবে বিষয়টি নিয়ে ভোট হয়নি।

২০১৯ সালে মার্কিন কংগ্রেস স্বীকৃতির পর নেসেটে বিষয়টি নিয়ে ভোটের দাবি তোলেন ইয়ার লাপিদ ও গিডিওন সা'আরের মতো নেতারা। কিন্তু, সমর্থনের অভাবে সেবারও এতে কোনো কাজ হয়নি।

২০২৩ সালে হাইফা ও পেতাহ টিকভা শহরের কাউন্সিলে আর্মেনীয় 'গণহত্যা'র আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়। এটাই ইসরায়েলের স্থানীয় পর্যায়ে ওই 'গণহত্যা'র প্রথম স্বীকৃতি।

আর্মেনিয়ার দীর্ঘদিনের দাবি ও তুরস্কের সংবেদনশীলতা

উসমানীয় সাম্রাজ্যে জাতিগত নিধনে ১৫ লাখেরও বেশি আর্মেনীয় নিহত হন। দীর্ঘ সময় ধরে আধুনিক আর্মেনিয়া ওই 'গণহত্যা'র আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চেয়ে এসেছে।

তবে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা উসমানীয়দের উত্তরসূরি তুরস্ক। হালে তুর্কিয়ে নামে পরিচিত দেশটি আর্মেনীয় 'গণহত্যা' চালানো, দেশটির জনগণকে বন্দি করে রাখা ও ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিজেদের ভূখণ্ড থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করে।

ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়া আর্মেনীয় গ্রাম শেজালানে অসংখ্য মাথার খুলির ছড়াছড়ি। ফাইল ছবি: এএফপি/যাদুঘর থেকে সংগৃহীত
ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়া আর্মেনীয় গ্রাম শেজালানে অসংখ্য মাথার খুলির ছড়াছড়ি। ফাইল ছবি: এএফপি/যাদুঘর থেকে সংগৃহীত

অপরদিকে আর্মেনিয়া বরাবরই বলে আসছে, তুর্কীদের পূর্বপুরুষরা পৃথিবীর বুক থেকে তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিল। যেমনটা ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে থাকেন।

১৯৬৫ সালের ২০ এপ্রিল প্রথম দেশ হিসেবে ওই গণহত্যার স্বীকৃতি দেয় উরুগুয়ে।

১৯১৫ থেকে ১৯২৩ সালের মধ্যে ঘটে যাওয়া ওই 'কালো অধ্যায়কে' বেশিরভাগ দেশই স্বীকৃতি দেয়নি। এখন পর্যন্ত মাত্র ৩৩টি দেশ উরুগুয়ের পথ অনুসরণ করেছে।

এর পেছনে মূল কারণ তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা। ন্যাটো জোটে যুক্তরাষ্ট্রের পর সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাবাহিনী তুরস্কের।

ভূমধ্যসাগরের তীরের ইউরোপীয় ভাবধারার চর্চাকারী মুসলিম দেশটিকে কেউ সহজে ঘাটাতে চায় না। এর প্রতিফলন দেখা যায় খুবই কম সংখ্যক দেশের স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে।

তুরস্ক-ইসরায়েল সম্পর্ক

বেশ কয়েক বছর ধরে তুরস্ককে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য ও নিরাপত্তা অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করে ইসরায়েল। তবে গাজার যুদ্ধ শুরুর পর দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি হয়।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বরাবরই হামাসের পক্ষে কথা বলে এসেছেন। বিশ্বমঞ্চে ইসরায়েলের কট্টর সমালোচক হিসেবেও তিনি সুপরিচিত।

এরদোয়ান-নেতানিয়াহুর মধ্যে সম্পর্ক এখন একেবারেই শীতল। ফাইল ছবি: রয়টার্স
এরদোয়ান-নেতানিয়াহুর মধ্যে সম্পর্ক এখন একেবারেই শীতল। ফাইল ছবি: রয়টার্স

প্রতিবেদন মতে, আঙ্কারা বেশ কয়েকবার ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার প্রশংসা করেছে। ওই হামলায় এক হাজার ২০০ ইসরায়েলি নিহত ও হামাসের হাতে ২৫১ জন জিম্মি হন।

সেদিনই গাজায় গণহত্যামূলক পাল্টা হামলা শুরু করে ইসরায়েল। সমগ্র গাজা অবরুদ্ধ করে ত্রাণ প্রবেশে বাধার সৃষ্টি করে নেতানিয়াহু ও তার প্রশাসন। অনেক মানুষ অনাহারে, অপুষ্টিতে ও চিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছেন।

বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে এই যুদ্ধ 'অর্থহীন', গাজাবাসীর কাছে 'অবিচার', আর জাতিসংঘ বলছে, ক্ষুধাকে অস্ত্র বানিয়েছে ইসরায়েল।

তুরস্কের নেতা এরদোয়ান গাজা যুদ্ধের শুরুতে উভয় পক্ষকে 'ধৈর্য'ধরতে বলেছিলেন।

২৫ অক্টোবর তিনি পার্লামেন্টে ইসরায়েলের পাল্টা হামলাকে 'গণহত্যা' আখ্যা দেন।

পরবর্তীতে ইস্তাম্বুলে ফিলিস্তিনপন্থিদের এক বিক্ষোভ মিছিলে এরদোয়ান আরও তীব্র ভাষায় সমালোচনা করেন। ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড অবৈধ বসতি স্থাপনের জন্য তিনি ইসরায়েলের সমালোচনা করেন। পাশাপাশি, ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিক মহলের কাছে 'যুদ্ধাপরাধী' হিসেবে তুলে ধরার অঙ্গীকারও করেন তিনি। ফিলিস্তিনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে এরদোয়ান মত দেন, ইসরায়েলের সঙ্গে সম্ভবত তুরস্ক সম্পর্কচ্ছেদ করতে চলেছে।

ওসমানীয় সাম্রাজ্যের ঐতিহ্য উদযাপন করছেন এরদোয়ান। ফাইল ছবি: ডয়চে ভেলে
ওসমানীয় সাম্রাজ্যের ঐতিহ্য উদযাপন করছেন এরদোয়ান। ফাইল ছবি: ডয়চে ভেলে

২০২৫ সালের জুলাইয়ে এরদোয়ান ইসরায়েলকে 'আইন ভঙ্গকারী, বিশৃঙ্খল, রক্তপিপাসু ও জঙ্গি রাষ্ট্র' আখ্যা দেন।

গত ২১ আগস্ট এরদোয়ান ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁকে বলেন, যেকোনো মূল্যে ইসরায়েলের গাজা দখলের পরিকল্পনা বানচাল করতে হবে।

সব মিলিয়ে বলা যায়, দুই দেশের সম্পর্ক আজ তলানিতে।

এরদোয়ানের ওপর চাপ সৃষ্টি করে নিজের চাপ কমাতে চান নেতানিয়াহু?

প্রায় এক বছর ১০ মাস ধরে চলা ইসরায়েলি হামলায় গাজায় ৬২ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। বিশ্বজুড়ে এই আগ্রাসনকে জাতিগত নিধন ও 'গণহত্যার' সঙ্গে তুলনা করা হলেও বরাবরই তা অস্বীকার করছেন নেতানিয়াহু।

বিশ্লেষকরা বলছেন, নিজে 'গণহত্যা' চালিয়ে অন্যের 'গণহত্যা'র স্বীকৃতি দিলেন নেতানিয়াহু

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। ফাইল ছবি: রয়টার্স
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। ফাইল ছবি: রয়টার্স

গাজা যুদ্ধের শুরুতে 'অন্ধ সমর্থন' পেলেও ইসরায়েলের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মিত্র ফিলিস্তিনের পক্ষ নিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রকে পাশে পেলেও একে একে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের মতো প্রভাবশালী দেশগুলো।

বিশ্লেষকদের মতে, এই পরিস্থিতিতে নিজের ওপর থেকে চাপ কমাতে, বা 'সমালোচক' এরদোয়ানের ওপর চাপ সৃষ্টি করতেই হয়তো হঠাৎ করেই শতবর্ষ আগে সংঘটিত গণহত্যার স্বীকৃতি দিলেন নেতানিয়াহু।

এমনও হতে পারে, নিজের সেনাবাহিনীর গণহত্যামূলক কার্যক্রমকে ঢাকতে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অপরাধকে ব্যবহার করতে চাচ্ছেন আন্তর্জাতিক অপরাধী আদালতে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত নেতানিয়াহু। এ যেন 'শাক দিয়ে মাছ ঢাকা'র সামিল।

Comments

The Daily Star  | English
new initiative for govt hospitals

Digital monitoring system for medical equipment by Dec

In the first phase, 300 medical devices in 114 government hospitals across the country will be brought under the "Medical Equipment Maintenance Information and Monitoring System"

2h ago