যে কারণে এত জনপ্রিয় মুক্তাগাছার মণ্ডা

মুক্তাগাছার মণ্ডা। ছবি: স্টার

মৈমনসিংহ গীতিকা, মহুয়া, মলুয়া, দেওয়ানা মদীনা, চন্দ্রাবতী, কবিকঙ্ক- এর জন্য প্রসিদ্ধ ময়মনসিংহ জেলা। তবে এসব কিছুর মধ্যেও ময়মনসিংহ বললেই যে নামটি সবার মনে আসে, তা হলো মুক্তাগাছার মণ্ডা।

ময়মনসিংহ শহরের অদূরে অবস্থিত 'মুক্তাগাছা' উপজেলাটি জমিদার মহারাজা সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীর রাজবাড়ী ছাড়াও মণ্ডার জন্য বেশ বিখ্যাত।

মুক্তাগাছার মণ্ডা, কুমিল্লার রসমালাই, টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম, বগুড়ার দই, নাটোরের কাঁচাগোল্লা, নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টি- জায়গার সঙ্গে প্রসিদ্ধ খাবারের নাম যেন সবার মুখে মুখে থাকে। চ্যাপ্টা আকৃতির মণ্ডা দুধের ছানা ও চিনির রসায়নে প্রস্তুতকৃত এক ধরনের সন্দেশ। সর্বপ্রথম যার হাত দিয়ে মণ্ডা তৈরি হয় তার নাম গোপাল পাল।

বলা হয়, এই মণ্ডার প্রস্তুত প্রণালি কখনই মূল প্রস্তুতকারকের পরিবারের বাইরে যায়নি। পূর্বপুরুষদের আদেশ মেনেই যুগ যুগ ধরে এই রীতি মেনে মণ্ডা বানানো চলছে।

মুক্তাগাছার মণ্ডা নাম নিয়ে ব্যাঙের ছাতার মত প্রচুর মণ্ডার দোকান গজিয়ে গেলেও বিখ্যাত সেই গোপাল পালের মণ্ডাকে টেক্কা দিতে পারে এখনো তেমন মণ্ড বাজারে নেই বললেই চলে।

ইতিহাস

মুক্তাগাছার প্রসিদ্ধ মণ্ডার জনক গোপাল পাল ১৮২৪ সালে প্রথম এই মণ্ডা তৈরি করেন। গোপাল তার নব উদ্ভাবিত মণ্ডা পরিবেশন করেন মুক্তাগাছার জমিদার তৎকালীন মহারাজা সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীর রাজদরবারে। মণ্ডা খেয়ে মহারাজা গোপালের ওপর তুষ্ট হলেন। পরবর্তীতে এটি জমিদারবাড়ির দৈনন্দিন খাবারের তালিকায় জায়গা করে নেয়। শুধু তা-ই নয়, জমিদারবাড়িতে কোনো অতিথি আসলে তাদের মণ্ডা দিয়ে আপ্যায়ন করা হতো। জমিদারেরা উপহার হিসেবেও বিশিষ্টজনদের কাছে এই মণ্ডা পাঠাতেন। এভাবেই মুক্তাগাছার ছোট্ট গণ্ডি পেরিয়ে এর অতুলনীয় সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয় মণ্ডার যাত্রা।

মণ্ডার প্রসারের সঙ্গে মুক্তাগাছার জমিদারেরা তাই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন। মণ্ডার মূল উপাদান দুধ ও চিনি । এক কেজি মণ্ডার প্যাকেটে ২০টি মণ্ডা থাকে। যার বর্তমান বাজার মূল্য ৪০০ টাকা। মণ্ডা তৈরির পর ফ্রিজে সংরক্ষণ করতে হয় না। স্বাভাবিক তাপমাত্রায় গরমের সময় ৩-৪ দিন ও শীতকালে ১০-১২ দিন ভালো থাকে।

মণ্ডার প্রশংসায় পঞ্চমুখ বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ

মুক্তাগাছার মণ্ডা খেয়ে প্রশংসা করেছেন ইতিহাসের অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ। সেই তালিকায় আছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান থেকে শুরু করে অনেক স্বনামধন্য রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।

উপমহাদেশের প্রখ্যাত ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধানচন্দ্র রায়, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী,রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ প্রমুখ ব্যক্তিদের মুক্তাগাছার জমিদার বাড়িতে আপ্যায়ন করা হয়েছিল এই মণ্ডা দিয়ে। আবদুল হামিদ খান ভাসানী মণ্ডার স্বাদে মুগ্ধ হয়ে তিনি চীনের মাওসে-তুং এর জন্যও উপহার হিসেবে নিয়ে গিয়েছিলেন। মাওসে তুংও মণ্ডার ভূয়সী প্রশংসা করেন।

জিয়াউর রহমান, কাদের সিদ্দিকী ও কামাল হোসেনের প্রিয় খাবারের তালিকায়ও ছিল মুক্তাগাছার এই মণ্ডা। চলচ্চিত্র জগতের রাজ্জাক, আনোয়ার হোসেন, সোহেল রানা, বুলবুল আহমেদ, কবরী, শাবানা, ববিতাসহ আরও অনেক বিখ্যাত অভিনেতা এই দোকানে বসে মণ্ডা খেয়ে সুনাম করেছেন।

কীভাবে সংগ্রহ করবেন মণ্ডা

 ১৮২৪ সালে মণ্ডার দোকানটির বর্তমান নাম 'গোপাল পালের প্রসিদ্ধ মণ্ডার দোকান'। মণ্ডা তৈরির ব্যবসা প্রায় ২০০ বছর ধরে বংশানুক্রমে চলে আসছে এক পুরুষ থেকে আরেক পুরুষে। মণ্ডা তৈরির মূল রেসিপিটা পারিবারিক হওয়ায় মণ্ডার নামে এখানে-সেখানে যা বিক্রি হয়, তা কোনোভাবেই আসল মণ্ডার দোকান নয়। তাছাড়া ময়মনসিংহ, ঢাকাসহ দেশের কোথাও কোনো শাখা-প্রশাখা, বিক্রয়কেন্দ্র না থাকায় আসল মণ্ডার স্বাদ পেতে হলে মুক্তাগাছায় যেতে হবে।

Comments

The Daily Star  | English

Cops get whole set of new uniforms

The rules were published through a gazette yesterday, repealing the previous dress code of 2004

2h ago