উত্তেজিত না হয়ে সমালোচনার উপায়

মনে আঘাত না দিয়ে বা অপেক্ষাকৃত কম আঘাত দিয়েও একজন মানুষকে এমনভাবে তার ভুল-ত্রুটিগুলো বোঝানো সম্ভব, যাতে করে সে পরবর্তী সময়ে সেই কাজে উন্নতি করতে পারে। আর সমালোচনার এই গুণ রপ্ত করতে প্রয়োজন যথেষ্ট অনুশীলন।
ছবি: সংগৃহীত

সমালোচনা আমাদের জীবনের এক অপরিহার্য অংশ। আমাদের যেকোনো কাজ বা সিদ্ধান্তে আরও ভালো ফলাফল আনতে সমালোচনা খুব দরকারি। তবে যত ভালো কিছুই নিয়ে আসুক, সমালোচনা শুনতে আমরা সচরাচর কেউই পছন্দ করি না।   

গঠনমূলক সমালোচনা করতে পারা একটা শিল্পের মতো। কাউকে কষ্ট না দিয়েও সমালোচনা করে মন জয় করতে প্রয়োজন সহমর্মিতা ও সংবেদনশীলতা। মনে আঘাত না দিয়ে, বা অপেক্ষাকৃত কম আঘাত দিয়েও একজন মানুষকে এমনভাবে তার ভুল-ত্রুটিগুলো বোঝানো সম্ভব, যাতে করে সে পরবর্তী সময়ে সেই কাজে উন্নতি করতে পারে। আর সমালোচনার এই গুণ রপ্ত করতে প্রয়োজন যথেষ্ট অনুশীলন।

চলুন দেখে নিই সহমর্মিতার মাধ্যমে কেমন করে গঠনমূলক সমালোচনা করবেন।  

বাচনভঙ্গি নিয়ে সতর্ক থাকুন

আমরা কী বলতে চাচ্ছি আর তার উদ্দেশ্য কী – সেটা অনেকাংশেই নির্ধারিত হয় কথার সুর বা টোনের ওপর। হয়তো কখনো কখনো গলা চড়িয়ে কথা বলার প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই শান্ত স্বরে, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ও কণ্ঠস্বরে শ্রোতার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই কথা বলা যায় এবং সেটাই করা উচিত। 

আমাদের কিছু অভ্যাস অপর প্রান্তের মানুষটির মনে কথা শোনায় অনীহা এনে দেয় কিংবা না শোনার জন্য অজুহাত সৃষ্টি করে। যেমন কথা বলার সময় বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে রাখা, চোখেমুখে রাগী ভাব প্রকাশ করা অথবা গম্ভীরভাবে ২ হাত বুকের ওপর আড়াআড়ি করে ধরে রাখা। এসব ছোটছোট আচরণ এড়িয়ে চলতে পারলে যাকে বলছেন তার জন্য আপনার কথা গ্রহণ করা অপেক্ষাকৃত সহজ হয়ে উঠবে।

সবার সামনে সমালোচনা করবেন না 

সবার সামনে যদি কারো সমালোচনা করা হয়, সে নিশ্চিতভাবেই লজ্জিত হয় এবং বিব্রত বোধ করে৷ তাই অন্য কারো সামনে না বলে আলাদা করে শুধু সেই ব্যক্তিটিকে বলাই সবচেয়ে ভালো উপায়।

অকপটে ও সুনির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে কথা বলুন

সমালোচনা করতে গিয়ে অস্পষ্ট ও অপ্রয়োজনীয় কথায় কোনো লাভ হয় না। আক্রমণাত্মক হয়ে দোষারোপ করার চেয়ে সরাসরি মূল সমস্যা নিয়ে অকপটে আলোচনা করা সবদিক দিয়েই ভালো। কারণ আক্রমণাত্মকভাবে বললে যাকে বলা হচ্ছে সে আঘাত পেতে পারে। পরবর্তী সময়ে তার মনে আক্রোশ জন্ম নেওয়াও অস্বাভাবিক কিছু না।

আবার সোজাসুজি বলে ফেলা মানেই যে রূঢ়ভাবে বলা, তাও কিন্তু নয়। সোজাসুজি সৎভাবে কথা বলার শান্ত ও ভদ্র উপায়ও রয়েছে। নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে ফিডব্যাক দেওয়ার মাধ্যমে অপর মানুষটি স্পষ্টভাবে বুঝতে পারে তাকে কেন ও কোন পরিবর্তন আনতে বলা হচ্ছে। তাই সমালোচনা বা ফিডব্যাকে শুধু সেই বিষয়টির ওপরই আলোকপাত করুন, যা কি না জটিলতা সৃষ্টি করছে।

এই যেমন কোনো একজন কর্মী একটি মিটিংয়ে ২০ মিনিট দেরি করে এলে তাকে 'আপনি সবসময় দেরি করে আসেন' বলার চেয়ে 'আপনি গতকাল মিটিংয়ে ২০ মিনিট দেরিতে এসেছেন' বলা ভালো।

সময় বুঝে প্রতিক্রিয়া জানান

কোনো বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানানোর বেলায় সময়ের ব্যাপারে সতর্ক থাকুন। কোনো ঘটনার সঙ্গেসঙ্গে সমালোচনা না করা ভালো। এমন সময় বলা উচিত যখন সেই ব্যক্তি কাজ বা কিছু নিয়ে কোনো চাপে কিংবা কোনো কিছু নিয়ে নিবিষ্ট হয়ে নেই। চেষ্টা করুন ঘটনার ২ থেকে ৭ দিনের মধ্যে আপনার প্রতিক্রিয়া জানানোর। কারণ এই সময়ের মধ্যে উভয় পক্ষেরই ঘটনাটি ভালোভাবে মনে থাকে।

যেমন যদি আপনার কোনো কর্মী নিয়মিত ভুল করতে থাকে, তবে তাকে ফিডব্যাক দেওয়ার জন্য মাস শেষ হওয়ার অপেক্ষা করবেন না। বরং সেই সপ্তাহের মাঝেই তার সঙ্গে সময় করে আলাদাভাবে কথা বলুন। তার ভুলগুলো নিয়ে এবং সেসব সমাধানের ব্যাপারে আলাপ করুন।

ব্যক্তির বদলে তার কাজের দিকে নজর দিন

সরাসরি ব্যক্তিগত সমালোচনা অবশ্যই তিক্ত লাগবে এবং আপনি যে পরিবর্তন আনার জন্য সমালোচনা করছেন সেটি হয়তো আর হবেই না৷ তাই কখনোই ব্যক্তিকে বা তার ব্যক্তিত্বের সমালোচনা করবেন না। নির্দিষ্ট কাজ বা ভুল নিয়েই কথা বলুন। যেমন 'আপনি খুব অলস' বলার পরিবর্তে বলতে পারেন 'আমি লক্ষ্য করেছি আপনি সময়ের মধ্যে অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করেননি। অতিরিক্ত কাজের চাপে পড়তে না চাইলে ডেডলাইনের মাঝেই কাজ শেষ করুন।'

'আপনি'র পরিবর্তে 'আমি' দিয়ে শুরু করুন

গঠনমূলক সমালোচনা এমন কোনো কথা দিয়ে শুরু করা উচিত নয় যার শুরুতেই 'আপনি' থাকে। এতে করে ওই ব্যক্তির কাছে এটি ব্যক্তিগত আক্রমণ মনে হতে পারে। বরং কথাটি যদি 'আমি' দিয়ে শুরু হয় সেক্ষেত্রে সে ব্যক্তিগতভাবে বিষয়টি নেবে না। এতে মনে হবে না যে আপনি আপনার বিশ্বাস তার ওপর চাপিয়ে দিতে চাচ্ছেন। মনে হবে আপনার অভিজ্ঞতা এবং চিন্তার কথা জানাচ্ছেন, যা কি না পরবর্তী সময়ে তাকে অনুপ্রাণিত করবে বিষয়টিকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার।

এই যেমন 'আপনি কখনোই আমার কথা শোনেন না' কথাটি দিয়ে যেন অপর পক্ষের ব্যক্তিত্বকে খাটো করতে দোষারোপ করা হচ্ছে। এর বদলে বলার চেষ্টা করুন 'আমার মনে হয়, আপনি আমার কথা ঠিকমত শোনেন না!' কিংবা 'আমার মনে হয়, আমি কথা বলার সময় আপনি যথেষ্ট মনোযোগ দেন না!'

নির্দেশ না দিয়ে পরামর্শ দিন

সমালোচনা করার সময় কোমলভাবে কথা বলুন, এমনকি আপনার কর্মস্থলের অধীনস্থদের সঙ্গেও। উঁচু পদে থাকলে অনেক সময় প্রতিক্রিয়াকে আদেশ বা নির্দেশ হিসেবে বলার প্রবণতা তৈরি হয়। কোনো কোনো জরুরি মুহূর্তে এমন করার প্রয়োজন হতে পারে, তবুও অধিকাংশ সময়েই ফিডব্যাক দেওয়া উচিত পরামর্শ হিসেবে। এতে সেই পরামর্শ মানার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। 'আপনাকে অবশ্যই অন্যভাবে কাজটি করতে হবে' এ কথা বলার চেয়ে 'আমার ধারণা এভাবে না করে অন্যভাবে কাজটি করলে আরও ভালো ফল পাওয়া সম্ভব' বলা বেশি কার্যকরী।

সমালোচনায় ভালো ভালো কথাও রাখুন

সমালোচনা মানেই কেবলমাত্র নেতিবাচক মন্তব্য নয়। অপর প্রান্তের মানুষটির কিছু প্রশংসাও যদি আপনার সমালোচনায় থাকে, তাহলে তার কাছে আপনি সাহায্যকারী হিসেবেই থাকবেন। এতে ওই ব্যক্তি যেমন নিজের সামর্থ্য বাড়াতে উৎসাহিত হবে, তেমনি তার দুর্বলতাগুলোও কাটিয়ে উঠতে পারবে।

তাকেও কথা বলতে দিন

সমালোচনা কখনোই একপাক্ষিক কথা হওয়া উচিত না। আলোচনা হওয়া উচিত ২  পক্ষেরই নিজস্ব মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি জানানোর মাধ্যমে। ওই  ব্যক্তিকেও তার দিক থেকে ঘটনার ব্যাখ্যা করতে দেওয়া উচিত। তার ব্যাখ্যা শুনুন ও সমস্যার পেছনের কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করুন। প্রয়োজন হলে গঠনমূলক বিতর্ক করুন এবং তার চিন্তা ও আবেগকে মূল্যায়ন করার চেষ্টা করুন। এতে পুরো বিষয়টিই অনেক সহজ হয়ে উঠবে।

গঠনমূলক সমালোচনার এই কৌশলগুলো রপ্ত করলে আপনি যেমন যার সমালোচনা করছেন তার জীবনে ইতিবাচক প্রভাব রাখতে পারবেন, তেমনি কর্মক্ষেত্রে নিজের ভাবমূর্তি ঠিক রেখে অনেক ব্যক্তিকেই সফল হতে সহায়তা করতে পারবেন।

অনুবাদ করেছেন আনজিলা জেরিন আনজুম

Comments