যুক্তিতে তর্ক
স্বামী-স্ত্রী, বন্ধু বা পরিবারের অন্য কোনো সদস্য হোক– যেকোনো সম্পর্কের ক্ষেত্রেই নিজেদের মধ্যকার দূরত্ব ঘোচাতে এবং কোনো বিষয়ে সম্মতিতে পৌঁছাতে তর্ককে ভালোভাবে কাজে লাগানো যায়।
তবে সব তর্কই কিন্তু সমানে সমানে হয় না। যেসব তর্ক নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, সেগুলোর ফলে সম্পর্কে ফাটল ধরতে পারে এবং সেই সঙ্গে মনের ওপর বাড়তি চাপ পড়ার সম্ভাবনা থাকে। এ লেখায় আমরা কিছু সফল ও কার্যকর তর্কের কৌশল নিয়ে কথা বলব।
সমস্যা চিহ্নিত করুন
কোনো বিষয়ে বিতর্ক শুরু করার আগে প্রধান সমস্যাটি চিহ্নিত জরুরি। এতে করে কথোপকথনের কেন্দ্রবিন্দু স্থির থাকে এবং অপ্রাসঙ্গিক আলাপে জড়িয়ে পড়া থেকে বিরত থাকা যায়। তাই সমস্যার ধরনটা চিহ্নিত করে কেন তা আপনার জন্য জরুরি, সেটি আগে ঠিক করুন।
কিছু নিয়ম ঠিক করুন
বিতর্কে জড়িয়ে পড়ার আগে কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম ঠিক করে নিলে ভালো। যেমন, পালা করে কথা বলতে হবে, কারো কথার মধ্যে কথা না বলা এবং মূল বিষয়েই মনোযোগ দেওয়া ইত্যাদি। এতে করে আলোচনা মার্জিত হবে এবং সেই সঙ্গে কার্যকরও হবে।
আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে
আবেগের দিক দিয়ে শক্ত অবস্থানে থাকতে পারলে কথা বলা সহজ হয়। তাই আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আবেগী হয়ে পড়তে থাকলে গভীর শ্বাস নিয়ে নিজেকে সম্পূর্ণ স্থির রাখতে হবে। কিছুটা বিরতি নিয়ে আবার ভালো বোধ করলে তারপর কথোপকথনে ফিরতে হবে।
সমস্যার দিকে মনোযোগ, ব্যক্তির দিকে নয়
তর্ক চলাকালীন কারো ব্যক্তিত্ব বা চরিত্র নিয়ে আক্রমণ করবেন না। এর বদলে বর্তমান সমস্যার দিকে নজর দিয়ে উভয় পক্ষ মিলে একটি সমাধান বের করার চেষ্টা করুন। কোনো ধরনের অনুমান বা সাধারণীকরণ করে ফেলার আগে সত্য ঘটনা ও বিষয় ব্যবহার করে নিজের বক্তব্য তুলে ধরুন।
'আমি'র ব্যবহার হোক বেশি
দ্বিতীয় পুরুষ তথা তুমি বা তুই বা আপনি সম্বোধনে বেশি কথা না বলে নিজের বিষয়ে কথা বলুন। নিজের দৃষ্টিভঙ্গি অপরপক্ষকে বোঝাতে চেষ্টা করুন। 'তুমি আমাকে সবসময় কষ্ট দাও' না বলে বরং 'যখন এমনটা ঘটে, তখন আমি কষ্ট পাই' – এ ধরনের বাক্য বেছে নিন।
কথোপকথন হোক পালাবদলে
বারবার হস্তক্ষেপ না করে একে অন্যকে কথা শেষ করার এবং তাদের বক্তব্য পুরোপুরি উপস্থাপনের সুযোগ দিতে হবে। এতে করে দুই পক্ষের দৃষ্টিভঙ্গিই বিবেচনায় নিয়ে ভালোভাবে শোনা হবে।
সময়সীমা বেঁধে দেবেন না
তর্ক চলাকালীন, উত্তেজনাকর সময়ে কোনোরূপ সময়সীমা বেঁধে দেওয়া বা হুমকি দেওয়ার ফলে হিতে বিপরীত হতে পারে। 'তুমি এটা না করলে আমি চলে যাব' – এমন বাক্য বলার বদলে দুই পক্ষ মিলে একটি সমঝোতা বা সমাধানে পৌঁছাবার চেষ্টা করতে হবে।
আলোচনার সাধারণ বিন্দুতে পৌঁছান
এমন সাধারণ কিছু বিষয় তুলে আনতে হবে, যাতে দুজনেই একমত এবং সেগুলোকে সমাধানের পথে যেতে কাজে লাগান। এতে করে সম্পর্কে সহযোগিতার মনোভাব ও শ্রদ্ধাবোধ বৃদ্ধি পাবে।
ক্ষমা চাইতে শিখুন
যদি আপনি বুঝে থাকেন যে ভুলটি আপনারই ছিল বা আপনিই নেতিবাচক কথা বলে ফেলেছেন, তাহলে তখনই নিজের দায় স্বীকার করে ক্ষমা চাইতে প্রস্তুত থাকুন।
শ্রোতা হিসেবে সক্রিয় থাকুন
অপর পক্ষের কথার দিকে মনোযোগ দেওয়া এবং তার শব্দচয়ন ও আবেগে কোনোরূপ হস্তক্ষেপ না করে, অপমানজনক মন্তব্য না করে শোনাটাই হচ্ছে একজন সক্রিয় শ্রোতার কাজ। এতে করে অন্য মানুষটিরও সহমর্মিতা বৃদ্ধি পাবে এবং আপনার মতামতের প্রতি একটি গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হবে। অপর ব্যক্তির বক্তব্য যে আপনি ভালোভাবে শুনেছেন, তা বোঝাতে চোখে চোখ রেখে মাঝে মাঝে পুনরাবৃত্তি করা যায় এবং মাথা নাড়ানোর মতো অবাচনিক যোগাযোগ কৌশলও ব্যবহার করা যায়।
সহমর্মিতার চর্চা
সহমর্মিতা অর্থ হচ্ছে অপর ব্যক্তির অনুভূতি বোঝা এবং তা অনুভব করার ক্ষমতা। তর্ক চলাকালেও নিজেকে অন্যের জায়গায় রেখে ভাবতে চেষ্টা করুন। এতে করে তাদের অবস্থান থেকে সমস্যাটির স্বরূপ বুঝতে এবং সুবিধাজনক সমাধান বের করে আনতে সহজ হবে।
সমঝোতার মন-মানসিকতা
একটি পক্ষ প্রায়ই তর্কের ফলে যা চায়, তা পায় না। এজন্য ছাড় দিতে প্রস্তুত থাকুন এবং এমন একটি সমাধান চিহ্নিত করুন, যা সবাইকেই কোনো না কোনোভাবে উপকৃত করবে। আলোচনার সময় একটি মাঝামাঝি জায়গা খুঁজে বের করা বা সমাধানের জন্য নতুন ধারণা নিয়ে আসা এক্ষেত্রে কাজে লাগতে পারে।
নিজের কাজের দায়িত্ব নিন
নিজের কাজের দায়িত্ব নিজে নিতে প্রস্তুত থাকুন এবং কোনো ভুল হয়ে থাকলে বা খারাপ কিছু বলে থাকলে ক্ষমা চেয়ে নিতে ভুলবেন না। এতে করে মনে আত্মবিশ্বাস আসবে এবং দ্বন্দ্বের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণের বাইরেও চলে যাবে না।
শেষটা হোক ইতিবাচক
আলাপের মাধ্যমে পুরোপুরি সমাধান না হলেও শেষটা ইতিবাচকভাবেই করুন। যদি একত্র চেষ্টার মধ্য দিয়ে সমাধান খোঁজা হয়, তবে একে অপরের কথা শোনার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন। এতে করে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির পাশাপাশি সমস্যা সমাধানে যে আপনার সম্পূর্ণ প্রচেষ্টা ছিল, সেটিও প্রকাশ পাবে।
সক্রিয় শ্রোতা হিসেবে ভূমিকা, সহমর্মিতা ও সমঝোতার মনোভাব রাখা যেকোনো জোরদার তর্কের জন্যই আবশ্যক। নির্দিষ্ট কিছু নিয়মের মধ্য দিয়ে একটি গঠনমূলক ও মার্জিত সংলাপ পাওয়া সম্ভব এবং এতে করে নিজের পক্ষে অনুকূল ফলাফলও আনা যায়। তর্ক চলাকালীন সম্পূর্ণভাবে সমস্যার সমাধান না করা গেলেও নিজের কাজের জন্য নিজেকেই দায়িত্ব নিতে হবে– এ কথাটি সবসময় মনে রাখতে হবে এবং কথোপকথনের শেষটায় কোনো তিক্ততা না রেখে ইতিবাচক সুরে শেষ করতে হবে।
অনুবাদ করেছেন অনিন্দিতা চৌধুরী
Comments