অতি আত্মবিশ্বাস কেন ভালো নয়

ছবি: সংগৃহীত

মনে করুন, আপনি একটি শক্তিশালী ভালুকের সঙ্গে খালি হাতে একা লড়াই করছেন। জিততে পারবেন? অথবা মনে করুন লড়াই করছেন একটি কুমির, বা একটি কিং কোবরা সাপ কিংবা একটি ঈগলের সঙ্গে খালি হাতে লড়ছেন। পারবেন?

যুক্তরাষ্ট্রে ২০২১ সালে মোট ১ হাজার ৭০০ মানুষের ওপর ইউগভ পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, ৬ শতাংশ মানুষ বলেছেন ভালুকের সঙ্গে লড়াইয়ে তারা জয়ী হবেন। আর কুমিরের সঙ্গে লড়াইয়ে জিতবেন বলেছেন ৬ শতাংশের চেয়ে সামান্য বেশি কিছু মানুষ। ২৩ শতাংশ মানুষ বলেছেন, তারা কিং কোবরা সাপের সঙ্গেও জিতবেন। ৩৮ শতাংশ মানুষ বলেছেন, তারা লড়াইয়ে ঈগলকে হারাতে পারবেন।

ভেবে দেখুন তো, আসলেই কি এই প্রাণীগুলোর সঙ্গে লড়াই করে জেতা সম্ভব? জিতলেও কয়জন তা পারবেন? যে কয়জন মনে করছেন তারা জিতে যাবেন তারা কি নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখেন? না, রাখেন না। এই যে নিজের সামর্থ্য বা সক্ষমতার চেয়ে বেশি সক্ষমতা আছে বলে মনে করা, এটাই অতি আত্মবিশ্বাস।

জীবন চলার পথে আত্মবিশ্বাস, নিজের ওপর আস্থা থাকা জরুরি। কিন্তু নিজেকে যদি ঠিকভাবে না বুঝে সক্ষমতার বাইরে বিরাট কিছু ভেবে অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেন, তবে কিন্তু বিপদ আসন্ন। হয়ে উঠতে পারেন অন্যের বিরক্তির কারণও।

 

 

অতি আত্মবিশ্বাসীদের চিনবেন যেভাবে

সব বিষয়ে নিজের মতামত প্রকাশ

অতি আত্মবিশ্বাসীরা সব বিষয়ে নিজের মত প্রকাশ করতে চান, সেটি যদি হয় কোনো বিতর্কিত বিষয় তাহলে তো কোনো কথাই নেই। কেউ তার বক্তব্য জানতে না চাইলেও নাক না গলানো পর্যন্ত শান্ত হন না। তা সেই বিষয়ে তার কিছু জানা থাকুক, বা না থাকুক।

নিজের সামর্থ্য বিষয়ে ধারণা না থাকা

যতটুকু সামর্থ্য আছে, অতি আত্মবিশ্বাসীরা নিজেকে তারচেয়ে বেশি সক্ষম মনে করেন। ফলে তারা নিজের ক্ষমতার বাইরে গিয়ে অনেক গুরু দায়িত্ব হাতে নিতে চান। সেই দায়িত্ব পেলে স্বাভাবিকভাবেই সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে পারেন না। 

নিজের যুক্তি প্রমাণের আপ্রাণ চেষ্টা

গুরুত্বপূর্ণ কিংবা তুচ্ছ ঘটনা, যেকোনো বিষয়ে নিজের যুক্তি প্রমাণ করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন অতি আত্মবিশ্বাসীরা। কখনো কখনো আলোচনার সমাপ্তি টানার পরও নিজের অবস্থানকে পুনরায় সমর্থন করতে থাকেন তারা। ব্যর্থ হলে সময় নিয়ে খুঁটিনাটি তথ্য জোগাড় করে পরবর্তী আলোচনায় আবার একই যুক্তি উপস্থাপন করেন।

প্রশংসা শুনতে চাওয়া

অন্যদের কাছ থেকে প্রশংসা না শোনা পর্যন্ত স্থির হতে না পারা অতি আত্মবিশ্বাসের লক্ষণ। অন্যের চোখে নিজের মূল্য বাড়ানোর জন্য পরিস্থিতি নিজের অনুকূলে ঘুরিয়ে আনতেও বেশ পারদর্শী তারা। এমনকি অন্যের পরিশ্রমের কাজকে নিজের বলেও চালিয়ে দিতে দ্বিধাবোধ করেন না।

সারাক্ষণ অন্যের সমালোচনা

কেউ ছোটোখাট ভুল করলেই তাকে অদক্ষ, দুর্বল প্রতিপন্ন করেন অতি আত্মবিশ্বাসীরা। এ ধরনের ব্যক্তিরা অন্যদের নিয়ে ঠাট্টা ও হেয় করতে ভালোবাসেন। মূলত নিজেকে সেরা প্রমাণ করতেই এমন করে থাকেন তারা। ক্ষেত্রবিশেষে অন্যকে সাহায্য করার আড়ালে ত্রুটি খুঁজে বের করাই তাদের উদ্দেশ্য থাকে।

নিজেকে অতি বুদ্ধিমান ভাবা

নিজে খুব একটা জ্ঞানী, প্রভাবশালী না হলেও কথাবার্তায় তা ফুটিয়ে তুলতে চান অতি আত্মবিশ্বাসীরা। অন্যদের থেকে নিজেকে স্মার্ট মনে করেন তারা। কোনো কাজে প্রয়োজনীয় সময়, প্রচেষ্টা, দক্ষতা বিনিয়োগ করতেও নারাজ থাকেন। অন্যদের ওপর থেকে নিজের নিয়ন্ত্রণ সরানোর কথা ভাবতেও পারেন না।

অতি আত্মবিশ্বাস কেন ভালো নয়

নিউজিল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব ওয়াইকাটোর গবেষক কায়লা জর্ডান এক সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের প্রশ্ন করেন, যাত্রীবাহী একটি উড়ন্ত উড়োজাহাজ জরুরি ভিত্তিতে নিরাপদভাবে অবতরণ করাতে হবে। পারবেন কি না?

অর্ধেক অংশগ্রহণকারী বলেন, নিরাপদে বিমানটি মাটিতে নামাতে পারবেন এমন সম্ভাবনা ২০ শতাংশ। তারপর তাদের ৩ মিনিটের একটি ভিডিও দেখানো হয়, যেখানে একজন পাইলট একটি বিমান মাটিতে নামিয়ে আনছেন। তখন তাদের আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে গেল।

তারা বললেন, বিমানটি নিরাপদে নামানোর সম্ভাবনা ৩০ শতাংশ। আর ২৫ শতাংশ উত্তরদাতা তো আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী। তারা বললেন, তাদের সাফল্যের সম্ভাবনা ৬০ শতাংশ।

কিন্তু উড়ন্ত উড়োজাহাজ কারো সাহায্য ছাড়া নিরাপদে মাটিতে নামিয়ে আনা খুবই চ্যালেঞ্জিং একটা কাজ, এর জন্য দক্ষতার প্রয়োজন। অথচ এতগুলো মানুষ, যাদের কোনো দক্ষতাই নেই, তারা মনে করছেন জরুরি পরিস্থিতিতে তারা একটি উড়োজাহাজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সেটিকে নিরাপদে অবতরণ করাতে পারবেন কারো সাহায্য ছাড়াই!

অতি আত্মবিশ্বাসীরা যেমন অন্যের ক্ষতি করেন, তেমনি নিজেরও বিপদ ডেকে আনেন। চলুন জেনে নিই কী ধরনের হতে পারে সেই বিপদ-

ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ

অতি আত্মবিশ্বাসীরা অনেক বেশি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। কোনো বিষয়ে তাদের যুক্তি না মিললে তা মানতে চান না, অন্যের পরামর্শ শুনতে চান না, ভুল স্বীকার করতে চান না। নিজের ক্ষমতার বাইরে বাড়তি ঝুঁকি নিতেও দেখা যায় অতি আত্মবিশ্বাসীদের, যা বড় বিপদের কারণ হতে পারে।

ব্যর্থতা

অত্যাধিক আত্মবিশ্বাসী হওয়ার আরেকটি সমস্যা হলো আত্মতুষ্টি। অর্থাৎ কেউ যদি নিজেকে অন্যদের চেয়ে সেরা মনে করেন তখন নিজের প্রতি অতিরিক্ত সন্তুষ্টি চলে আসে। কোনো কাজ সামনে আরও ভালোভাবে করার আগ্রহের ঘাটতি দেখা দেয়। যা কর্মক্ষেত্রসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলে এবং এক সময় ব্যর্থতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

সবার অপ্রিয় ও বিরক্তির কারণ হয়ে উঠা

অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসীদের কেউ পছন্দ করেন না। কারণ তারা নিজেকে সেরা মনে করেন, অন্যকে অসম্মান করেন। অন্যের কাজে অযাচিত হস্তক্ষেপ করেন ও মতামত দিতে আসেন। নিজে পারবেন না সেটা না বুঝে অনেক কাজ হাতে নিয়ে নেন এবং যেনতেনভাবে সেই কাজটি করেন। ফলে মানুষ তার ওপর ক্রমাগত বিরক্ত হতে থাকে।

মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি

অতি আত্মবিশ্বাসীরা অবাস্তব লক্ষ্য নির্ধারণ করে থাকেন। ফলে দিনশেষে হতাশা ছাড়া আর কিছুই থাকে না তাদের জন্য। এটি মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

প্রতারিত হওয়া

আত্মবিশ্বাসের কারণে মানুষ যেমন আর্থিকভাবে স্বনির্ভর হতে পারে, তেমনি অতিআত্মবিশ্বাসী হলে দেউলিয়াও হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে৷ বাস্তবিক প্রেক্ষাপট যাচাই না করে নিজের বুদ্ধিমত্তার ওপর ভরসা করেই যত্রতত্র বিনিয়োগ করে নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার উদাহরণ রয়েছে।

তথ্যসূত্র: হ্যাক স্পিরিট, বিবিসি

Comments

The Daily Star  | English

What are we building after dismantling the AL regime?

Democracy does not seem to be our focus today. Because if it were, then shouldn’t we have been talking about elections more?

11h ago