মিস ওয়ার্ল্ড ২০২৫ এর মঞ্চে আলো ছড়ানো বাংলাদেশের কণিকার গল্প

খুব পরিকল্পনা করে প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে যাননি তিনি, সঙ্গে ছিল না কয়েক মাস ধরে তৈরি করা ডিজাইনার পোশাকও। আসলে আকলিমা আতিকা কণিকার মিস ওয়ার্ল্ড ২০২৫ মঞ্চের উদ্দেশে যাত্রা শুরু হয়েছিল একদম শেষ মুহূর্তে।
বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার মঞ্চে এভাবে যে যাওয়া যায়, তা হয়তো অনেকে বিশ্বাসই করতে চাইবেন না। আর হয়তো এটাই তার গল্পকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে তুলেছে।
স্টার লাইফের সঙ্গে দীর্ঘ আর খোলামেলা আলাপে আকলিমা আতিকা কণিকা কথা বলেন নানা বিষয় নিয়ে।

অভিনন্দন। মিস ওয়ার্ল্ডের মতো আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে পেরে আপনার কেমন লেগেছে?
কণিকা: সত্যি বলতে, আমি এখনও বিষয়টা উপভোগ করছি। প্রতিযোগিতায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে আমার হাতে মাত্র এক সপ্তাহ সময় ছিল। তাই সবকিছু খুব দ্রুত সারতে হয়েছে। কিন্তু যখন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমি বাংলাদেশের পতাকা বহন করেছিলাম এবং নিজের নামের নিচে বাংলাদেশ লেখা দেখলাম তখন যেন একটা ধাক্কা খেলাম। সেই সময় থেকে আমি আর কেবল কণিকা ছিলাম না, আমি ছিলাম পুরো একটি জাতির প্রতিনিধি।
প্রতিযোগিতার মুকুটটি সবাই দেখতে পান, কিন্তু এর পেছনের প্রত্যয়টি খুব কম মানুষের চোখেই ধরা পড়ে। এই প্রতিযোগিতায় কোন মূল্যবোধগুলো আপনি দৃঢ়ভাবে ধরে রেখেছিলেন?
কণিকা: বিশ্বাসযোগ্যতা বা সত্যতা। আমি সবসময় নিজের প্রতি সৎ থেকেছি। আমি একজন গর্বিত বাঙালি নারী, যে শাড়িতে আত্মবিশ্বাসী বোধ করে। এমনকি বিশ্বমঞ্চেও, বাংলাদেশ আমার হৃদয়েই ছিল। আমার একটি সাপোর্ট সিস্টেম ছিল, যাদের সহয়াতা ছাড়া এই যাত্রা সম্ভব হতো না। যার মধ্যে রয়েছেন আমার ন্যাশনাল ডিরেক্টর আজরা মাহমুদ ট্যালেন্ট ক্যাম্পের আজরা মাহমুদ, ২০২৪ সালের মিস ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ইফা তাবাসসুম। ইফা তো আমার সঙ্গে নিজের পোশাকও শেয়ার করেছিলেন। এছাড়া অনলাইনে মানুষ যে ভালোবাসা আমার প্রতি দেখিয়েছিলেন, তাও আমাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।

আন্তর্জাতিক কোনো প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুতি নেওয়াটা অবশ্যই কঠিন। আপনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং এবং সবচেয়ে উৎসাহদ্দীপক অংশ কোনগুলো ছিল?
কণিকা: শুরুটা তো খুবই বিশৃঙ্খল ছিল। অনুষ্ঠানের মাত্র কয়েকদিন আগে আমার যাওয়া নিশ্চিত হয়। ফলে শেষ মুহূর্তে আমাকে পোশাক নির্বাচন করতে হয়েছে, স্পন্সর খুঁজে বের করতে হয়েছে। তবে এতসব চাপের পরেও আমি শেষ পর্যন্ত সব গুছিয়ে যেতে পেরেছি। আমি জুরহেমের মেহরুজ মুনিরের কাছে কৃতজ্ঞ, তিনি আমার চূড়ান্ত পর্ব এবং টপ মডেল রাউন্ডের গাউন ডিজাইন করে দিয়েছেন। ফ্যাশন ল্যাবের ফারদিন বায়েজিদ, বিশ্বজিৎ এবং তৃষা তখন আমার পাশে ছিলেন যখন আর কেউ ছিল না। তদের অবদান ভোলার নয়।
মিস ওয়ার্ল্ড যাত্রায় আপনি নিজের সম্পর্কে সবচেয়ে আশ্চর্য কোন বিষয়টি শিখেছেন?
কণিকা: আমি জেনেছি যে, এখনও নিজেকে অবাক করে দিতে পারি আমি। আমি কোনো অভিযোগ না করেই নিজের সীমা অতিক্রম করে যেতে পারি, এমনকি তা খুব সীমিত সময়ের মধ্যেও। নিজের চরিত্রের এই স্থিতিস্থাপকতাটুকু নিয়ে আমি সত্যিই গর্বিত।
মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতা জোর দেয় সৌন্দর্য এবং এর সঙ্গে কিছু উদ্দেশ্যের ওপর। কোন সামাজিক কাজটি আপনার হৃদয়ের সবচেয়ে কাছের? আর এই প্রতিযোগিতার পরেও কীভাবে সেই কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছেন আপনি?
কণিকা: মানসিক স্বাস্থ্য, বিশেষ করে শিশুদের জন্য। আমার উদ্যোগ 'ইয়ং মাইন্ডস ম্যাটার' এ সংক্রান্ত সচেতনতা তৈরির বিষয়ে কাজ করছে। আমি মনে করি এটা মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যা নিরাময়ের প্রথম ধাপ। প্রায়ই নিউরোডাইভার্জেন্ট শিশুরা ভুল বোঝাবুঝির শিকার হয়। আমি নিজেও দেখেছি যে, এ কারণে প্রাথমিক পর্যায়ে কীভাবে তাদের আত্মসম্মান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমার লক্ষ্য হলো, এই শিশুরা যেন নিজেকে দোষারোপ করতে করতে বড় না হয়।

আগেও আমরা অনেক খেতাবপ্রাপ্তকে নানা ধরনের প্রতিশ্রুতি দিতে দেখেছি। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তাদের সেসব প্রতিশ্রুতি ম্লান হয়ে গেছে। তাদের সঙ্গে আপনার প্রতিশ্রুতির কী পার্থক্য রয়েছে?
কণিকা: আমি অনেক বড় বড় প্রতিশ্রুতি দেব না, কারণ জীবন প্রতি মুহূর্তে বদলায়। কিন্তু এ মুহূর্তে আমি বলতে পারি যে, আমি সত্যিই এই কাজটি চালিয়ে যেতে চাই। এমনকি যদি এখনই বড় পরিসরে কিছু করতে না পারি তবুও এটি চালিয়ে যাওয়ার উপায় খুঁজে বের করব আমি। আর এই প্রতিশ্রুতিই আমি নিজের কাছে করেছি।
এই পর্যায়ে পৌঁছে আপনি কি মডেলিং চালিয়ে যেতে চান? নাকি সামনে অন্য কোনো পথ বেছে নেবেন?
কণিকা: আসলে কোভিড-১৯ মহামারির পর থেকে আমি পরিকল্পনা করা বন্ধ করে দিয়েছি। আমি একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হতে চেয়েছিলাম, কখনও ভাবিনি যে মিডিয়ায় কাজ করব। কিন্তু এখন মডেলিং আমার ভালোবাসায় পরিণত হয়েছে। তাই আমি এটি নিয়ে আরও অনেক দূর এগোতে চাই। তবে এটাও ঠিক, জীবন আমাকে যেদিকেই নিয়ে যাক না কেন, আমি তার জন্য প্রস্তুত থাকব। জীবনের বাঁকে বাঁকে পাওয়া এসব বিস্ময় আমি উপভোগ করছি।
মিস ওয়ার্ল্ডে অংশ নেওয়ার স্বপ্ন দেখছেন এমন কাউকে আপনি কী পরামর্শ দিতে চান?
কণিকা: প্রথমেই নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন যে, কেন আপনি সেখানে যেতে চান? নিজের কাছে সৎ এবং স্পষ্ট থাকুন। এরপর নিজের এমন ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলুন যেখানে একজন মিস মিস ওয়ার্ল্ড বিজয়ীর প্রতিফলন দেখা যায়। একটি কারণ খুঁজে বের করুন যেটি আপনার জন্য সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ। সবকিছুর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, নিজের ভেতর সততা থাকা, খাঁটি হওয়া। মিস ওয়ার্ল্ড বাস্তব জীবনকে গুরুত্ব দেয়। তাই পুরোপুরি নিজেকে উপস্থাপন করুন, কোনো রকম শর্ত ছাড়াই।
আমি এখনও শিখছি, জ্ঞান আহরণ করছি যেন পরে এই পথে যে হাঁটবেন, তাকে সাহায্য করতে পারি। আমি যদি নাও জয়ী হই তবুও এই ধারা অব্যাহত রাখতে চাই।
ছবি: সৌজন্যে প্রাপ্ত
অনুবাদ করেছেন শেখ সিরাজুম রশীদ
Comments