ঢাকা শহরের ঘোড়সওয়ারেরা

ঘোড়ায় চড়া

ঢাকার মানুষও ছুটির দিনে রূপকথার রাজপুত্রের মতো ঘোড়ায় চড়ে বেড়ায়, এ কথাও কি বিশ্বাস করা যায়? চারদিকে হর্নের আওয়াজ আর আঁটসাঁট জীবনে, ঘোড়ায় চড়ার কথা তো অন্য এক সময়, কিংবা অন্য এক স্থানের গল্প বলে মনে হয়।

তবে আমাদের জানার সীমানার অন্যপাড়ে কিন্তু এই ঢাকা শহরেই খুব ছোট করে হলেও গড়ে উঠছে ঘোড়সওয়ারদের একটি দল। শখ হোক বা খেলার ছল, আর নয়তো নিজের মনের শান্তির জন্য— ঘোড়ায় চড়ার বিষয়টি এই জের ধরে আর ইতিহাস বা ঔপনিবেশিকতার নস্টালজিয়ায় বাঁধা পড়ে নেই।

ঘোড়া

শুধুই বিলাসবহুল অবসর নয়

বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে যদিও ঘোড়ার চড়ার বিষয়টি রাজকীয় মাত্রা পায়, তবে তার অন্য দিকও আছে।

হর্স রাইডিং ট্রেইনিং সেন্টারের (এইচআরটিসি) প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ জাহেদুল ইসলাম বলেন, 'ঘোড়সওয়ারি এক ধরনের শারীরিক ও মানসিক ব্যায়াম। তরুণ প্রজন্মের স্ক্রিনটাইম থেকে সরে এসে নিজের শরীর ও মনের মধ্যে সংযোগ করার জন্যও দারুণ একটি সুযোগ করে দিতে পারে এই চর্চা। ঘোড়সওয়ারিতে একইসঙ্গে বৃদ্ধি পায় মানসিক শক্তি, ভারসাম্য ও আত্মবিশ্বাস। একইসঙ্গে এটি রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে মনোযোগ বাড়িয়ে তোলে।'

শহুরে বাংলাদেশে ঘোড়সওয়ারি যদিও বেশ নতুন বিষয়, তবে এর চাহিদা অনেক। স্কুলগামী বাচ্চাদের থেকে শুরু করে ভার্সিটিপড়ুয়া শিক্ষার্থী, পেশাজীবী লোকজন— কেউই আসলে বাদ পড়ছেন না ছকবাঁধা জীবনের একঘেয়েমি দূর করার এই নতুন সুযোগটি থেকে।

জাহেদুল আরও বলেন, 'আমার মনে হয় মানুষজন বুঝতে শুরু করেছে যে এটি কোনো বিলাসিতা নয়, বরং স্বাস্থ্যের জন্য বেস উপকারী একটি শরীরচর্চা।'

জাদুর শহর, নয় জিনের শহর

ঢাকায় এত কম খোলামেলা সবুজ জায়গা যে এখানে ঘোড়সওয়ারি করাটা বেশ কঠিন। কিন্তু বোধহয় সে কারণেই এ শহরে এই চর্চার সুযোগ আরো বাড়ানো উচিত।

ঘোড়া

২০২৩ সালে শুরু হওয়া বুরাক হর্স রাইডিং স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা সাদাত উজ্জ্বল বলেন, 'জায়গা খুঁজে পাওয়াটা সবচেয়ে কষ্টের ছিল। আমরা এমন অংশীদারও খুঁজে পাচ্ছিলাম না, যারা আমাদের উদ্দেশ্যটি বুঝতে পারবে। আর ঢাকায় তো ভেটেরিনারি সহায়তা, অভিজ্ঞ কেয়ারটেকার আর এ ধরনের কাজের অবকাঠামোও নেই আসলে।'

আর এ কারণে এমনকি ঘোড়াকে খাওয়ানো, সওয়ারির সময়সূচি ঠিক করা, আর্দ্র আবহাওয়ায় ঘোড়াকে সুস্থ রাখার মতো খুব প্রয়োজনীয় কাজগুলোকেও মনে হবে ছোটখাটো সেনাদল পরিচালনার মতো।

তবে এত বাধাবিপত্তির পরেও উজ্জ্বল ও জাহেদুল— দুজনেই নিজেদের কাজে নাছোড়বান্দার মতো লেগে ছিলেন। তাদের শিক্ষার্থীরাও। তাই নিছক শখ হিসেবে শুরু হওয়া সেই ঘোড়সওয়ারির দৌড় এখন যেন বাস্তবিক এক আন্দোলনে রূপ নিচ্ছে। শুধু জমায়েতি দর্শকের উৎসাহেই নয়, বরং অর্থপূর্ণ কিছুর সঙ্গে যুক্ত হবার আগ্রহ নিয়ে চলছে এ যাত্রা।

পরিচয় হয়ে উঠেছে ঘোড়সওয়ারি

ঢাকায় ঘোড়সওয়ারির বিষয়টিতে অংশগ্রহণই বড় কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘোড়সওয়াররা শুধু ইনস্টাগ্রামে ছবি তোলার জন্য 'পোজ' দিচ্ছেন না। তারা বরং শব্দের চেয়ে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন নীরবতার যোগাযোগকে। নিজের শরীর ও মনের সঙ্গে, অন্য একটি সত্তার সঙ্গে— যে কি না কথা বলতে জানে না।

ঘোড়া

উজ্জ্বল বলেন, 'এতে কোনো শর্টকাট নেই। ঘোরার সঙ্গে মিথ্যে আত্মবিশ্বাস দেখিয়েও লাভ নেই। ওটা সময়ের সঙ্গে আসে। আসে ধীর মনের স্বভাবের সঙ্গে।'

মানুষের মন বড় চঞ্চল। যেকোনো সময় অন্যদিকে চলে যায়। অনেক ঘোরসওয়ারই হয়তো জীবনে কোনো বিষয় থেকে পালিয়ে বেড়াতে চাইছেন, একটু অন্য ভঙ্গিমায়, একটু অন্যদিকে মন দিয়ে। আর নিজের সেই রুখে দাঁড়ানোই এখানে বড় প্রভাবক।

জাহেদুলের কথায় তার ছাপ পাওয়া যায়, 'মানুষের মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। তারা আরো বেশি মনোযোগী হয়ে ওঠেন। হতে পারে, অনেকেই সওয়ারিতে খুব পারদর্শী হন না, কিন্তু তারাও অভিজ্ঞতা থেকে শেখেন।'

শখ, খেলা নাকি আরো বেশি কিছু?

তাহলে, বাংলাদেশে ঘোড়সওয়ারির ভবিষ্যৎ কী? সপ্তাহান্তে একটুখানি সময় কাটানো নাকি এর চেয়ে বেশি কিছু?

বেশিরভাগ ঘোড়সওয়াররাই অবশ্য অত কিছু না ভেবে শুরু করেন, তবে এখন বিষয়টি আরো বহুমাত্রিক হচ্ছে। যেমন অনেকেই টেন্ট পেগিং, শো জাম্পিং ইত্যাদি বিভিন আন্তর্জাতিক কৌশলের চর্চা করছেন।

জাহেদুল ইসলাম বলেন, 'আমি চাই না, এটি শুধু শখ হয়ে থাকুক। আমার স্বপ্ন হচ্ছে ঘোড়সওয়ারিকে অলিম্পিকসে নিয়ে যাওয়া। যেহেতু বিশ্বব্যাপী ড্রেসেজ ও টেন্ট পেগিংয়ের মতো চর্চাগুলো স্বীকৃতি পাচ্ছে, সেহেতু আমি মনে করি, সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগের মাধ্যমে আমাদের তরুণরা এ পথে এগিয়ে যেতে পারে।'

বুরাকের শুরুর কাজকর্মটা অনেকটা এগিয়ে গেছে।

উজ্জ্বল বলেন, 'আমরা এর মধ্যে ৩৫০ জনকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। এর মধ্যে কিছু শিক্ষার্থী পেশাদার ঘোড়সওয়ার হতে ইচ্ছুক। আমরা এখানে সার্টিফিকেট দিই, যদিও এটি এখনো জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি পায়নি। তবে অনেকেরই বিদেশযাত্রার জন্য, বিশেষত কানাডা ও পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলগুলোতে যাওয়ার জন্য এ প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন।'

তবে দুই প্রতিষ্ঠাতাই বিশ্বাস করেন যে খেলাধুলা শুধু একটি পথ। ঘোড়সওয়ারি তরুণদের জন্য ইতিবাচক ও বহুমাত্রিক একটি চর্চা। এরা দুজনেই স্বীকার করেন যে এর আগে বাংলাদেশে ঘোড়সওয়ারির সংস্কৃতি চালু ছিল না। এখন যেটুকুই হয়েছে, তা বারবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং ভুলচুকের মধ্য দিয়ে শুধু ইচ্ছাশক্তির কারণে তৈরি হয়েছে।

শূন্য থেকে শুরু

জাহেদুল ইসলাম বলেন, 'সৌদি আরবের মতো দেশগুলোতে ঘোড়সওয়ারি তাদের সংস্কৃতির একটি অংশ। আমরা এখানে এই সুযোগটি নতুন তৈরি করছি। অনেকেরই ধারণা ছিল না, শুরুটা কীভাবে করা যায়। এখন তারা অন্তত শুরুটা করতে পারবেন।'

জাহেদুলের জন্য এই পথটা কখনো একার যাত্রা ছিল না।

তিনি বলেন, 'সবকিছুর জন্যই আমি আমার বাবা মোহাম্মদ ফারুখুর রহমানের কাছে ঋণী। যখন কেউ আমার সঙ্গে ছিল না, তখন তিনি আমাকে সমর্থন করেছেন।'

বাংলাদেশের ক্রীড়াজগতে ঘোড়সওয়ারি অতটা পরিচিত নয়। তবে জাহেদুল ও উজ্জ্বলের মতো উদ্যোক্তাদের জন্য এখন আমাদের মানচিত্রেও ঘোড়ার খুরের টগবগ শোনা যাচ্ছে।

ছবি: বুরাক হর্স রাইডিং স্কুল; হর্স রাইডিং ট্রেইনিং সেন্টার (এইচআরটিসি)

অনুবাদ করেছেন অনিন্দিতা চৌধুরী

 

Comments

The Daily Star  | English

Economy to face challenges in Jul-Dec: BB

BB highlights inflation, NPLs, and tariff shocks as key concerns

2h ago