বুক রিভিউ

সুফিয়া কামালের 'কেয়ার কাঁটা'র নারীরা কেমন 

সুফিয়া কামালের 'কেয়ার কাঁটা'কে  কেউ বলেন স্মৃতিকথা, কেউ গল্পগ্রন্থ, আবার কারো কাছে গদ্যগ্রন্থ। যদি বলা হয় 'কেয়ার কাঁটা' মূলত হলুদ রঙা সরষে ফুলের উপর এক খণ্ডাংশ চিলতে রোদ কিংবা শ্রাবণের ধারা স্নাত একটা সতেজ প্রভাত তাহলে বোধ হয় ভুল হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

জননী সাহসিকা সুফিয়া কামাল বিশ্বযুদ্ধের হিন্দোল হিল্লোলে দুলতে দুলতে বড় হওয়া নারী। হলফ করে বলা যেতে পারে অধিকাংশই সুফিয়া কামাল কে চিনে থাকেন 'তাহারেই পড়ে মনে'কবিতার মাধ্যমে। কেয়ার কাঁটা'' উপলব্ধি করায় সুফিয়া কামাল স্রেফ কবি নন, তিনি সাহিত্যিক। তিনি জানেন কীভাবে দুর্লভ এক গুচ্ছ কেয়ার কলি'র মতো নারীর ব্যক্তিত্বকে প্রকাশ করা যায়,তিনি জানেন দুঃখ কে কীভাবে কলমের বশবর্তী করে শব্দের মাধ্যমে কান্না করানো যায়, কীভাবে আ-কার কিংবা  ঈ-কারের দুকূল ছাপিয়ে এ কান্না প্লাবিত করে পাঠকের হৃদয়।

এইসব ক্রন্দনরত শব্দ-গুচ্ছের প্রতিফলন এই কেয়ার কাঁটা। পনেরোটা গদ্য নিয়ে বই, কেবল গদ্য দিয়ে বিশেষায়িত করলে হবে না বরং বইয়ের ভেতরকার পত্রসাহিত্য আর নাটকজুড়েই পুরো বই। প্রথম গদ্যের আদলেই বইয়ের নাম, সুফিয়া কামাল শব্দের বেড়াজালে বন্দি করলেন ভানু নামের এক নারীকে। যিনি তার অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ধরে রেখেছেন গদ্যের শেষ অব্দি। যিনি তার সুদূর প্রিয়তমের বিরহ বেদনা কল্পনার আলপনায় সুন্দর করে করে এঁকে আপন মনে নিবিড় করে পেতে চেয়েছিলেন। এমন সময় তার নিকট এক মুগ্ধ পরাজিত প্রেমপ্রার্থী হাজির হলেও তেহরানের ফোটা দুর্লভ হলুদ রঙা টিউলিপের মতো ব্যক্তিত্ব নিয়ে ফিরিয়ে দিলেন তাকে।

গদ্যে মূলত সুফিয়া কামাল দেখিয়েছেন প্রিয়তমের পরকীয়ার কথা জেনেও নিজস্ব ব্যক্তিত্ব শতভাগের একভাগও ছাড় দিতে  নেই।ভানুর কথিত অকথিত বাণী রচনা করেছে অসংখ্য অনিন্দ্য কথার মালা,যে মালা দুঃখ জাগানিয়া হয়ে যায়, হয়ে যায় এক লাইনের একটা দীর্ঘতম কবিতা।ঠিক এই মুহূর্ত এসেই সুফিয়া কামাল লিখেন রূপকথা অথবা বাস্তবতার মাঝামাঝি অবস্থান করা কিছু লাইন -

"তোমরা পুরুষ,তোমরা চাও বিস্মরণী,কিন্তু নারী চায় অতীতের মাধুর্য দিয়ে তৈরি নব নব সৃষ্টি,চায় অতীত কে নিয়েও স্মৃতির বেদনায় তাকে মাধুর্য দিয়ে নব নব কল্পনার আনন্দ পেতে।"

এরপরের গদ্য 'যে নদী মরু পথে হারালো ধারা। ''কেবল নদী নয়,হারায় মানুষও।অসংখ্য অপ্রাপ্তির বেড়াজালে আবদ্ধ মানুষের জীবন নদীর চেয়ে কম কিসে?মানব জীবন কে নদীর সঙ্গে তুলনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সুফিয়া কামাল এ গদ্যে অবশ্য তেমন কিছু বলেন নি।তিনি জুড়ে দিয়েছেন বেদনা বিদুর পত্রের আদলে লেখা মূলত কয়েকটা উদাসীনতার ছাপ।একজন স্বামী পরিত্যক্তার জোড়ালো ব্যক্তিত্ব, কত-শত বছরের প্রথা ভেঙে জবাব দিয়েছেন-

'কেন,আমার স্বামী কি আমার দ্বারা পরিত্যক্ত হতে পারেন না?'

সব রিক্ততা পূর্ণ করে,সব কাঠিন্যকে কোমল করে, সকল শুষ্ককে মঞ্জরিত করে এগিয়ে যান এই নারী।এই গদ্যে এসে মিল পাওয়া যায় গ্রামসির আধিপত্যতত্ত্ব, ফ্রয়েডবাদীদের চিরাচরিত আখ্যান এবং অনগ্রসর সমাজব্যবস্থার এক করুণ রূপ।ধ্বংসের মুখপ্রান্ত থেকে ফিরে আসা এই নারীর আর্তনাদের বিজ্ঞপ্তির একখানা চিঠি,প্রতি উত্তর এবং অন্তরালে প্রচ্ছন্ন ব্যক্তিত্বের নবীন সম্ভার।

এসব তত্ত্বের দুর্বোধ্যতা ঠেলে সুফিয়া কামাল এর পর আনেন শরতের শেফালি ঝরা প্রভাতের নতুন ঊষার ন্যায় একজন বিজয়িনীকে। বইয়ের তৃতীয় তম গদ্য- বিজয়িনী। পৃষ্ঠা উল্টানোর সঙ্গে দেখা হয় আসমত আলী সাহেবের সঙ্গ, যে কিনা ঘোড়ায় চড়ে সকাল সন্ধ্যা ভৈরব নদের হাওয়া খেতে যান। প্রসঙ্গক্রমেই একদিন হঠাৎ আবিষ্কার করেন, বেহুশ হয়ে পড়ে থাকা বাল্যবন্ধু কাশেমকে, সেবা যত্নের তাগিদেই নিয়ে আসেন বাড়িতে। এখানেও এক ভিন্ন নারী চরিত্র মাসুমার সঙ্গে পুনরায় দেখা হয় কাশেমের। সুফিয়া কামাল এসব ঘটনাপ্রবাহ এগিয়ে নিতে লিখেন এক লাইনের বাক্য 'দুঃখ দিয়েছিলেন,দুনিয়া চিনলুম'।বুঝি দুঃখ দিয়েই পৃথিবী চেনা যায়?এসব লাইন মনে করায় বুদ্ধের চিরাচরিত বাণী- 'সর্বম দুঃখম'।এসবের প্রতিফলন ঘটে মাসুমার মুখে,প্রস্ফুটিত হয়ে নতুন দুঃখবাণী। প্রশ্ন জাগতেই পারে কেয়ার কাঁটা কি তবে কেবল দুঃখেরই গাঁথা?উত্তর হবে - না। 

কেয়ার কাঁটা আদতে চঞ্চল প্রবাহ স্মৃতিভরা গন্ধবিধুর অন্ধকার একটা কক্ষ। যে কক্ষের একটা কোণে এসে পরিচয় হয় মোমতাজ নামের এক যুবকের সাথে,যিনি প্রিয়জন হারিয়ে আনন্দ বেদনার স্মৃতি পারাবারে উদ্বেলিত। এমন স্মৃতিচারণার ছিটেফোঁটা পাওয়া যায় পরবর্তী পত্রসাহিত্যেও।বইয়ের ঠিক এ অংশে এসেও প্রশ্ন জাগবে,এটা কি আদৌ একটা গদ্যগ্রন্থ নাকি পত্র সংকলন!

অবশ্য এটা মুখ্য বিষয় নয়,মুখ্য বিষয় এই দীর্ঘায়িত পত্র জুড়ে একজন বিস্মিত ব্যথিত প্রেমিকের দীর্ঘশ্বাসের শব্দ।প্রেমিকের নাম নসিম,তিনি জানান জীবনে একেকটা সময় আসে তখন তার যা কিছু সবই হয়ে উঠে দুর্বার অদম্য।এরপরেও পরাজয়ের ঘ্রাণ ভেসে বেড়ায় জীবন-জুড়ে আর সুফিয়া কামাল নসিমের আদলে লিখেন "কত দুর্জয় ছিল আমার মন,দৃঢ় ছিল আমার প্রতিজ্ঞা,কত উচ্চ ছিল আমার আশা, কিন্তু একটিমাত্র নারী সামান্য শক্তির যে অধিকারিণী আজ আমার সবকিছুর মাধুর্য হরণ করে নিল পরম হেলায়।'

নসিমের সাথে মিল পাওয়া যায় পরের গদ্যের চরিত্র আজম নামের যুবকের সাথে। 'সত্যিকার' নামক এই পত্রসাহিত্য মূলত আজম নামের যুবক আর 'সারা' নামের মেয়ের জীবনের খণ্ডাংশ দেখানো হয়েছে।দুজনেরই পুষ্পিত জীবনে কাঁটার মতো কুন্ঠিত হওয়া প্রেম নামক ব্যধি ছড়ায়, রিক্ততার ব্যথায় ছেয়ে যায় তাদের জীবন। এরপরের গদ্যে সুফিয়া কামাল নিয়ে যান আঁকাবাঁকা ঢেউ খেলানো গিরিপথ বেয়ে একটা পাহাড়ি অঞ্চলে, চেনা যায় বিলেত ফেরত একজন ইঞ্জিনিয়ার হামিদ কে, যার জীবনের অপার স্মৃতির কোনো উপলক্ষ নেই।  এই অপার স্মৃতি হঠাৎ এক চরিত্রকে সম্মুখীন করায়।

সুফিয়া কামাল লিখেন '' দিন বারো কাটিয়াছে। দানেশ চিঠি লিখিয়াছে,মালেকা নাই।' মালেকা'র থাকা কিংবা না থাকার উপর হামিদের ভালো থাকার নির্ভরশীলতা।মালেকার গত হয়ে যাওয়া এসব মায়াময় তীব্র অভাববোধ পরিবর্তন করায় হামিদের জীবনের রুদ্ধশ্বাস গতিপথ। এসব চরিত্রের গিরিপথ বেয়ে বেয়ে চোখে পড়ে হারেম শহর। তৎক্ষণাৎ চোখে ভেসে উঠে শ্রীপাস্থের 'হারেম' বইটি। অপরাহ্ণের হারেম কেমন দেখতে হয়? বুঝি মেহের উন নিসা'র সেতার বাজানোর শব্দে কেটে যায় পুরো হারেমের অপরাহ্ণ? 

ঝিম ধরানো সময় আটকে থাকে শুভ্রবেশা বিধবার শাড়ির আঁচলে,সুফিয়া কামাল তার নাম দেন- মেহের উন নিসা। বিষণ্ণ সুন্দর মুখ যার,প্রাসাদে পড়া করুণ রোদের মতো খানিকটা।বলা যায় সাদাসিধা অথবা সুরুচিপূর্ণ। যেমন ঝরা পাতার মড়মড় শব্দ শুনতে শুনতে চৈত্র কেটে যায় তেমনি মেহের উন নিসার সেতার বাজানোর শব্দে শেষ হয় কেয়ার কাঁটা,কখনো তীব্র উচ্ছ্বাস আবার কখনো নির্জীব। 

'কেয়ার কাঁটা'য় উল্লেখিত প্রতিটা নারী চরিত্রের ব্যক্তিত্ব হতে পারে সিলভিয়া প্লাথের অতীন্দ্রিয় বিকল্প। যেন উদাসীন বিকেলের গল্প এবং এই সময়ের সঙ্গে অনেক প্রাসঙ্গিক। চরিত্রগুলো সংকটের কথা বলে। 

Comments

The Daily Star  | English

Is the govt backing the wrongdoers?

BNP acting Chairman Tarique Rahman yesterday questioned whether the government is being lenient on the killers of a scrap trader in front of Mitford hospital due to what he said its silent support for such incidents of mob violence.

4h ago