প্রতিক্রিয়া

মহিউদ্দিন আহমদের 'লালসন্ত্রাস'

প্রজন্মের কাছে ইতিহাস কতভাবে যে পৌঁছায়, তার যথাযথ জানা নেই। কিন্তু ভাষা ও চিন্তার ভিন্নতা থাকলে অনেক পুরনো ইতিহাসও সাময়িক মনে হয়। যেমন লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদের লাল সন্ত্রাস বইটি। এতে পরিষ্কার হয়েছে ইতিহাসের অনেক জটিলতা। খুলেছে পথ ও নানান মতের জানালা।

ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির উত্থানপর্ব চলছিলো অনেকদিন থেকে। যার স্ফুলিঙ্গ দেখা যায় ১৯৬৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের নকশালবাড়িতে। নকশালবাড়ি আন্দোলনের ঝাপটা এসে লাগে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনেও। আর সে সময় সিরাজ সিকদার নামক তরুণের হাত ধরে শুরু হয় পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন। যারা পূর্ব বাংলা স্বাধীন করার কথা ভাবে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে।

সিরাজ সিকদার বাংলাদেশের রাজনীতি এক আলোচিত নাম। বুয়েট পড়ুয়া মেধাবী তরুণ। যুক্ত ছিলেন বাম ঘরানার রাজনীতির সাথে। নকশাল বাড়ির ঝাপ্টা আর পাকিস্তানের উপনিবেশিক আচরণে এ দেশে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে তাদের উৎখাত করার কথা ভাবেন। তাদের আদর্শ ছিলো মাও সে তুং। চীনা বিপ্লব তাদের উৎবুদ্ধ করেছিলো ভীষণভাবে।

ধীরে ধীরে পার্টির পরিসর বাড়তে থাকে। তার দলে ভিড়তে থাকে তরুণেরা যাদের প্রায় সবাই উচ্চ শিক্ষিত। কেউ বুয়েটে কেউ মেডিকেলে কিংবা খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সারাদেশকে কয়েকটি সেক্টরে ভাগ করে গোপনে চলে তাদের কার্যক্রম। মূলত তাদের কার্যক্রম চালানোর উর্বরভূমি ছিলো বরিশাল। পাকিস্তান শাসনামলে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বোমা হামলা চালিয়ে জানান দেয় নিজেদের অস্তিত্বের কথা। হৈচৈ ফেলে দেয় তৎকালীন রাজনৈতিক অঙ্গনে। 

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো তারাও যোগ দিলো। তবে আওয়ামীলীগকে তারা দেশের শত্রু মনে করাতো। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ তারা ভারতে  নিয়ে গেছে বলে দোষারোপ করতো। তারা ভাবতো একমাত্র সশস্ত্র বিপ্লবই দেশকে মুক্ত করতে পারে। তারা পাক আমলেই সর্বপ্রথম পতাকা তৈরি করে ফেলেন,যার ডিজাইনার ছিলেন সফিউল্লাহ্ আজমী। তারাই প্রথম প্রকাশ্যে স্বাধীনতার কথা বলেন। তারা শত্রু খমতের নামে আওয়ামীলীগের লোক হত্যা করে। তারাও ছেড়ে দেবার পাত্র না পাল্টা খুনখারাবি চলতে থাকে। 

মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে সিরাজ সিকদার ঢাকা ত্যাগ করে। চলে যান বরিশালে। বিস্তীর্ণ পেয়ারা বাগানে গঠন করেন জাতীয় মুক্তিবাহিনী। পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলে। শত্রু খতমের মিশনে নেমে পড়ে। তাদের বেশ কয়েকটি অভিযান সফল হয়। তেল জল যেমন মিশ খায়না তেমনি  তারাও আওয়ামীলীগের সাথে মুক্তি আন্দোলনে এক কাতারে নামেনি। শত্রুতা তখনো চরমে। 

দেশ যখন স্বাধীন হয়। ১৬ ডিসেম্বর পাক বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। তারা মনে করে দেশ পাকিস্তানের হাত থেকে এসে ভারতের হাতে পড়েছে। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় তারা মানতে পারেনি। স্বাধীনতার পরের বছরে ১৬ ডিসেম্বর হরতাল  ডেকে বোমা হামলা করে। দেশ স্বাধীনের পর তারা বিপ্লবের নামে খুনোখুনির মিশন শুরু করে। শত্রু খমতের নামে তাদের হাতে নিহত হয় অনেকে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ স্থিতিশীল ছিলো না। সর্বত্র অস্ত্রের ঝনঝনানি। জানা যায় ১৯৭২ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯৭৩ সালের মে পর্যন্ত দেশে গুপ্তহত্যার শিকার হয় ৪ হাজার ৯২৫ জন।

ইতোমধ্যে পার্টির নাম পাল্টে যায়। পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন থেকে পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টি। [৩রা জুন ১৯৭১]সর্বহারা পার্টি চট্টগ্রাম বরিশাল ময়মনসিংহ সহ উত্তরাঞ্চলে তাদের উপস্থিতি জানান দেয়। বিপ্লবের জন্য শুরু হয় থানায় হামলা। অস্ত্র লুট। তাতে মারা পরে বিপ্লবী পুলিশ উভয়ই। অর্থের জন্য শুরু হয় ব্যাংক ডাকাতি। সিরাজ শিকদারের পার্টি সর্বত্র আলোচনায়। পত্রিকার বড় বড় শিরোনাম। অপরদিকে তার পার্টির পরিচয় ব্যবহার করে হত্যা ডাকাতিতে সরকারি দলের লোকেরাও মেতে উঠে। 

কমিউনিস্টদের মধ্যে বেশ কয়েকটি লাইন থাকলেও তারা নিজেদের সঠিক লাইন মনে করতো। জাসদকে ভাবতো অন্যতম শত্রু হিসেবে।পার্টির কাজ চলতো অতি গোপনে। প্রকাশ্য কার্যক্রম হতো খুব কম। বাহির থেকে তাদের জানার সুযোগও ছিলো কম। অনেকেই তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলো। বিপ্লবের নেশায় দলে দলে তরুণেরা সর্বহারা পার্টিতে ভিড়ে। পার্টির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব কিংবা শৃঙ্খলাভঙ্গের নামে নিজ দলের কর্মীদের খতমেও পিছ পা হতো না তারা। এ ক্ষেত্রে ঢাবির বাংলার লেকচারার হুমায়ুন কবির হত্যাকাণ্ড অন্যতম। 

সিরাজ সিকদার কারো চোখে বিপ্লবী কারো চোখে সন্ত্রাসী। আরও জানার সুযোগ আছে আমাদের। দেখা যায়, পার্টির একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে উঠেন তিনি। সরকারের কাছে মোস্ট ওয়াটেন্ট অপরাধী। তাকে গ্রেফতারের জন্য চলে জোরেশোরে তোড়জোড়। অবশেষে চট্টগ্রামে পুলিশের জালে ধরা পড়েন তিনি। কয়েকজনের বর্ণনায় জানা যায় বিমানযোগে ঢাকায় এনে হাজির করা হয় বঙ্গভবনে। শেখ মুজিবের সামনে হাজির করা হয় তাকে, চলে বাদানুবাদ। তারপর রক্ষীবাহিনীর কাছে করা হয় হস্তান্তর। ভোররাতে অস্ত্র ও গোপন আস্তানা উদ্ধারের নামে ঢাকার সাভারে গুলিতে হত্যা করা হয়। খবরে আসে পালানোর সময় হত্যা। এটিই  স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ক্রসফায়ার ছিলো। যা নিয়ে তর্কবিতর্ক এখনো চলমান। সিরাজের মৃত্যুর পর সরকার সমর্থক পত্রিকা 'বাংলার বাণী' তাকে নিয়ে যে সম্পাদকীয় লিখেছিলো তা শেষ হয় তার কবিতার লাইন দিয়ে—

"বিদায় বেলা মনে রেখো একটি কথা
ঘাত-প্রতিঘাত,সংঘাত-প্রতিকূলতা 
কিন্তু আমাদের আছে একটি কামনা
সে হলো নিঃস্বার্থ জনসেবা।" 

সিরাজ শিকদারের মৃত্যুর পর পার্টি আর মাথা তুলে দাড়াতে পারেনি। নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। অনেকে ধরা পড়ে কারাভোগ করেন। তাদের কেউ কালো জীবন থেকে বেড়িয়ে আসে প্রকাশ্যে। এভাবেই সর্বহারা পার্টির যবনিকাপাত ঘটে। কিন্তু স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে সিরাজ সিকদার ও সর্বহারা পার্টি আলোচিত এক নাম। যাদের নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই।কিন্তু হ্যামিলিয়নের বাঁশিওয়ালার মতো সিরাজ সিকদার সে সময়ের শিক্ষিত তরুণের মনোজাগতে দারুণভাবে জায়গা করে নেয়। 

ব্যক্তি জীবনে বিপ্লবকে ধারণ করতেন খুব তিব্রভাবে। বুয়েটে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে হতে পারতেন অধ্যাপক কিংবা বড় প্রকৌশলী। কিন্তু বিপ্লবের নেশায় বুদ হয়ে হয়ে গেলেন বিপ্লবী। প্রাণটাও বধ হলো। হয়তো তাদের পথ ছিলো ভুল। লেখক তাদের পার্টির কার্যক্রমের  ভুলগুলো পাঠকের চোখে তুলেছেন।পাহাড় অরণ্য সিরাজ সিকদারের প্রিয় ছিলো। গেরিলা যুদ্ধের ঘাঁটি হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ব্যবহার করেছেন। ব্যক্তি জীবনে তিনি প্রচুর পড়াশোনা করতেন। পার্টির মুখবন্ধ লালঝাণ্ডা প্রকাশের পাশাপাশি কর্মীদের পাঠ্যসূচি তিনিই নির্ধারণ করে দিতেন। কবিতাও লিখতেন তবে সেসবেও বিপ্লবের মন্ত্রণা থাকতো। তিনি লিখেছে—

"এই বন-পাহাড়
বাঁশের কোঁড়,আলু
ঝর্ণার মিষ্টি পানি
মাছ বন্যজন্তু
নিপীড়িত পাহাড়ি
গেরিলাদের স্বর্ণভূমি।"

প্রায় সাড়ে চারশো পৃষ্ঠার এ বইয়ে অর্ধেক অংশ পার্টি কার্যক্রম ও সিরাজ সিকদারকে নিয়ে। বাকি অর্ধেক সর্বহারা পার্টিতে যুক্ত থাকা নানাজনের সাক্ষাৎকার। সবমিলিয়ে "লালসন্ত্রাস " সর্বহারা রাজনীতি আর সিরাজ সিকদার সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা দিতে পেরেছে।তবে লেখকের ব্যক্তিগত আবেগকে পেছনে রেখে লেখালেখি বেশ কঠিন। পাঠক হিসেবে বাকি বিবেচনা আমাদের।

বই শুরু হয়েছিলো জীবনের জয়গান, বিপ্লব আর নতুন সূৃর্যোদয়ের আশা নিয়ে আর শেষ হলো মৃত্যুর মিছিল দিয়ে। শেষ করবো বইয়ে বারংবার উল্লেখ্য করা লাইনগুলো দিয়ে
'মুক্তির মন্দির সোপানতলে
কত প্রাণ হলো বলিদান
লেখা  আছে অশ্রুজলে।

শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। 

Comments

The Daily Star  | English
rooppur-nuclear-power-plant

Power division gets 30% lower budget allocation

The allocation for the power division in the national budget for fiscal year 2025-26 is around 30 percent less than that of the previous fiscal year, while it has been nearly doubled for the energy and mineral resources division. .The government has decided to cut electricity production c

2h ago