বইমেলা বিশেষ- ১

রাষ্ট্রীয় পুরস্কারগুলো চরম বিতর্কিত হয়ে পড়েছে

পাঠক কমছে না বাড়ছে এরকম কোনো পরিসংখ্যান কিন্তু নেই। এগুলো আন্দাজে বলা।

চলছে অমর একুশে বইমেলা ২০২৪। প্রতিদিন মেলায় আসছে নতুন বই। এর মধ্যে প্রকাশ হয়েছে কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক আহমাদ মোস্তফা কামালের বই-জলের অক্ষরে লেখা, প্রকাশ করেছে পাঠক সমাবেশ। নতুন বই ও নিজের লেখালেখি-বইমেলা নিয়ে তিনি কথা বলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে।

প্রায় বলা হয়,  পাঠক কমছে, বই বিক্রি নেই। কিন্তু  বাস্তবতা হচ্ছে মাসব্যাপী বইমেলায় প্রতি বছর প্রকাশনা স্টল বাড়ছে। লেখক হিসেবে কী বলবেন? 

আহমাদ মোস্তফা কামাল : পাঠক কমছে না বাড়ছে এরকম কোনো পরিসংখ্যান কিন্তু নেই। এগুলো আন্দাজে বলা। পাঠক কমা বা বাড়ার সঙ্গে প্রকাশনীর সংখ্যা বাড়া বা কমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি এমন অনেক তরুণ প্রকাশককে চিনি যাঁরা প্রচলিত প্রকাশনার মান বা কাজকর্ম নিয়ে সন্তুষ্ট নন এবং অনেক স্বপ্ন নিয়ে, ভালো কিছু করার স্বপ্ন নিয়ে প্রকাশনায় এসেছিলেন। কিন্তু আসার পর বাস্তবতাটা বুঝেছেন, কেউ কেউ সংগ্রাম করে সফল হয়েছেন, কেউ স্রোতে গা ভাসিয়েছেন এবং ধান্দাবাজ হয়ে গেছেন, আবার কেউ ব্যবসা গুটিয়ে চলে গেছেন।

মেলাকেন্দ্রিক প্রকাশনার জন্য আমাদের তোড়জোড় থাকে সবার। এতে অনেক ভুলও হয়। ইভেন্ট কেন্দ্রিক প্রকাশনা, লেখক দিয়ে কতদূর যাবে সাহিত্য? 

আহমাদ মোস্তফা কামাল :যতটুকু এগিয়েছে ততটুকু তো মেলাকে কেন্দ্র করেই এগিয়েছে। তবে এটা কোনো ভালো চর্চা নয়। বইয়ের প্রকাশ সারা বছর হওয়া উচিত। তাতে লেখক-প্রকাশক-সম্পাদক-প্রুফরিডার-ছাপাখানা-বাঁধাইখানা সবার ওপরেই চাপ কমবে। মানে, এই বিরাট আয়োজনের চাপ এক-দুই মাসে না নিয়ে বারো মাসে ভাগ করে দেওয়া যায় এবং সেটিই কাম্য।

প্রকাশনাসংশ্লিষ্ট সবাই তা বোঝেন, কিন্তু হচ্ছে না কেন? হচ্ছে না, কারণ আমাদের বই বিপণনের অবস্থা খুবই খারাপ। ফেব্রুয়ারির মেলা ছাড়া সারাবছর আর কোথাও বাংলাদেশের বই পাওয়া যায় না। দেশে যেসব বড় বুকশপ আছে, যেমন পাঠক সমাবেশ, বাতিঘর, প্রথমা, নির্বাচিত ইত্যাদি, সেখানে কিছু বাংলাদেশি বই পাওয়া গেলেও তা পর্যাপ্ত নয়। ছোট বুকশপগুলোর অবস্থা আরো খারাপ। 

অন্যদিকে সারাদেশে পাঠক আছে কিন্তু তাদের কাছে বই পৌঁছানোর ব্যবস্থা নেই। এই সমস্যা সমাধানের জন্য জেলাশহর এবং উপজেলা সদরগুলোতে অন্তত একটা করে মানসম্পন্ন বইয়ের দোকান থাকা উচিত। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে এবং প্রকাশক সমিতির সহায়তায় তা হতে পারে। এটা করতে পারলে সারাদেশে একটা জাগরণ ঘটবে এবং আমাদের প্রকাশনা জগতের চেহারা আমূল পাল্টে যাবে।

জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র নামে আমাদের একটা প্রতিষ্ঠান আছে। এই জাতীয় প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য-কার্যাবলী অসাধারণ কিন্তু তার বাস্তব প্রয়োগ নেই। অন্য সব জাতীয় প্রতিষ্ঠানের মতোই এটিও একটা অথর্ব প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। অথচ আপনি যেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন, আমরা যেসব সমস্যার সমাধান খুঁজছি তার সবকিছুর দিকনির্দেশনা দেয়া আছে গ্রন্থকেন্দ্রকে। কেন তারা সঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না। বাধা কোথায়? সমস্যা কোথায়? 

জলের অক্ষরে লেখা উপন্যাসে সময় ও সমাজ এসেছে নিশ্চয়। তা নিয়ে পাঠকদের একটু বিস্তারিত বলবেন।

আহমাদ মোস্তফা কামাল : সময় এবং সমাজ তো এসেছেই কিন্তু এই উপন্যাস কেবল সমকাল, সমাজবাস্তবতা, রাজনীতি, অর্থনীতি এসব নিয়েই নয়। ওগুলো আছে প্রচ্ছন্নভাবে। আমার প্রতিটি উপন্যাস আগের উপন্যাস থেকে আলাদা, এই উপন্যাসও আলাদা। মানুষ কেবল সামাজিক জীব নয়, কেবল পরিবারের গণ্ডিতেই আবদ্ধ নয়, কেবল সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের কাছেই দায়বদ্ধ নয়। মানুষ একইসঙ্গে এক মহাজাগতিক পথিকও। সেজন্য সমাজ-সংসারের বাইরেও তার বহুকিছু নিয়ে চিন্তা আছে, প্রশ্ন আছে, অনুসন্ধান আছে, আছে তার একান্ত ব্যক্তিগত নৈঃশব্দ্যের জগতও। এ উপন্যাস সেসব নিয়েও।

প্রায় শুনি লেখক লিখতে পারছেন না, নতুন কিছু ভাবতে পারছেন না— এর থেকে কিভাবে কাটিয়ে উঠেন লেখক? 

আহমাদ মোস্তফা কামাল : লিখতে না পারা মানে কিন্তু ভাবতে না পারা নয়। একজন লেখকের পক্ষে ভাবনাহীন থাকা সম্ভবই নয়। তবে সবসময় লেখা সম্ভব নাও হতে পারে। ব্যক্তিত কারণে, জাতীয় দুর্যোগে, এমনকি আন্তর্জাতিক কোনো বিপর্যয়েও লেখকের লেখা থেমে যেতে পারে। ফিলিস্তিনে, সিরিয়ায়, ইয়েমেনে বা পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে যখন অসংখ্য শিশুর মৃতদেহের ছবি যখন ভেসে আসতে থাকে তখন যেকোনো সংবেদনশীল লেখকের মনে হতেই পারে, তাঁর এইসব লেখালেখির কোনো অর্থই হয় না। তাঁর কলম তখন স্তব্ধ হতেই পারে। 

আবার রাইটার্স ব্লক বলে একটা ব্যাপার আছে, যখন লেখক কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই লিখতে পারেন না। এমন কোনো লেখক নেই যাঁর জীবনে অন্তত একবার এরকম সময় আসেনি। অসহ্য যন্ত্রণা হয় তখন, বর্ণনাতীত যন্ত্রণা। বিষয়টি নিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে, কিন্তু আজ পর্যন্ত তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। এই দুঃসহ সময়টি কাটিয়ে ওঠার পদ্ধতি আমার জানা নেই। তবে এ সময়ে আমি ছোটবেলার প্রিয় বই পড়ি, শিশুদের কাছে যাই, সুযোগ পেলে নিসর্গের সান্নিধ্যে থাকার চেষ্টা করি এবং অপেক্ষা করি।

কেন একজন লেখক পুরস্কার পায় বা দেওয়া হয়, কখন ফিরিয়ে দেওয়া বা প্রত্যাখ্যান করা উচিৎ

আহমাদ মোস্তফা কামাল : পুরস্কার দেওয়া হয় লেখকের সম্মান ও বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের স্বীকৃতির জন্য। এটাই হওয়ার কথা। কিন্তু বিশ্বজুড়ে পুরস্কার দেওয়ার জন্য দুটো প্রধান বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়। একটা হলো, একজন প্রতিষ্ঠিত লেখকের সমাজে, রাষ্ট্রে এবং পরবর্তী প্রজন্মের ওপর প্রভাব বিবেচনা করে। আরেকটি হলো তরুণ-প্রতিশ্রুতিশীর লেখককে উৎসাহ দেবার জন্য। কিন্তু আমাদের দেশে ওসব খুব একটা মান্য করা হয় না। রাষ্ট্রীয় পুরস্কারগুলো চরম বিতর্কিত হয়ে পড়েছে। কারণ, দশজন পুরস্কার পেলে তার মধ্যে দু-তিনজন পান তাদের কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ, কোনো দেনদরবার ছাড়া। বাকি সাত-আটজন পান ধরাধরি, লেনদেন, দেনদরবার করে এবং প্রভাবশালী মহলের সক্রিয় সহায়তায়। এসব আমাদের অজানা থাকে না। রাষ্ট্র এবং রাজনীতি পচে গেলে সবই পচে যায়। নৈতিকতার কোনো বালাই থাকে না। 

সার্বিকভাবে আমাদের নৈতিকতার মান এতটাই নেমে গেছে যে যাঁরা অনৈতিক এবং খারাপ কাজ করেন, তাঁরা মনেই করেন না যে কাজটা ঠিক হচ্ছে না। কোনো অনুতাপ নেই তাঁদের, নেই কোনো অপরাধবোধ। এরাই সবকিছু নষ্ট করে ফেলছে। পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়া বা প্রত্যাখান করা লেখকের বিবেচনার বিষয়। সারা পৃথিবীতেই এর চর্চা হচ্ছে। মূলত অনিয়মের এবং অন্যায়ের প্রতিবাদস্বরূপই প্রত্যখান বা ফিরিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটে।

সংকটে বুদ্ধিবৃত্তিক কণ্ঠস্বর চায় সাধারণ মানুষ। বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ বা লেখকদের নিয়ে অভিযোগ আছে তারা সঙ্কটে থাকেন না। আপনার কি মতামত

আহমাদ মোস্তফা কামাল : আমাদের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর বা আলাপের চর্চা কমে গেছে। সবাই এখন বিচ্ছিন্ন, একা। এবং এটা এই সময়েরই চরিত্র। সামাজিক দায় তো আছেই। আজ পর্যন্ত আমরা একটি উদার, মানবিক, সহিষ্ণু, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, কল্যাণকামী রাষ্ট্র তৈরি করতে পারলাম না। আমাদের রাজনীতি পচেগলে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচার, অনাচার, লুটপাট সীমাহীন বেড়ে গেছে। এসব নিয়ে লেখকরা কথা না বললে আর কে বলবেন? সমস্যা হলো, লেখকরা ভালো কথা বললেও রাষ্ট্রের শত্রু হয়ে যান, যদিও তারা বৃহত্তর কল্যাণের জন্যই বলেন।

Comments

The Daily Star  | English

Will there be any respite from inflation?

To many, especially salaried and fixed-income individuals, this means they will have no option but to find ways to cut expenditures to bear increased electricity bills.

4h ago