সাক্ষাৎকার

‘বঙ্গবন্ধুর কোট আমার গায়ে এই স্মৃতিটা বেশ আলোড়িত করে’

ছবি: সংগৃহীত

বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিজ্ঞানী ও একুশে পদকপ্রাপ্ত লেখক ড. নূরুন নবী। মহান মুক্তিযুদ্ধে যেসব বীর লড়াকু জীবন বাজি রেখেছিলেন, নুরুন নবী তাদের একজন। যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাটিক পার্টির একজন রাজনীতিবীদ এবং নিউ জার্সির প্লেইন্সবোরো শহরের কাউন্সিলর। তিনি কোলগেটের পণ্য 'কোলগেট টোটাল'-এর সহ-উদ্ভাবক এবং বুলেটস অব ৭১- অ্য ফ্রিডম ফাইটার'স স্টোরি বইয়ের লেখক। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এই বীর মুক্তিযোদ্ধার রয়েছে অসামান্য স্মৃতি। দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপে জানালেন তার কিছু অংশ। 

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আপনার পরিচয় কখন ও কোথায়?

নূরুন নবী: ১৯৬৬ সালে ময়মনসিংহ আনন্দ মোহন কলেজে পড়ার সময় দেখা হয়। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, রফিক উদ্দিন ভুঁইয়াসহ স্থানীয় নেতারা। সে সময় কলেজ মাঠে যে বক্তৃতা করেন তাতে আমি বেশ মুগ্ধ হই এবং তাকে পূর্ব বাংলার মানুষের মুক্তির নেতা হিসেবে গ্রহণ করি। 

তারপর ভর্তি হই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে নানা প্রোগ্রাম, মিছিল-মিটিং করার সুবাদে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়। সে সময় ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, উত্তাল সময়ে সত্তরের নির্বাচন। এর মাঝে একটা ঘটনা মনে রাখার মতো- ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়। এটি নিয়ে শাহবাগ হোটেলে বঙ্গবন্ধু প্রেস কনফারেন্স ডাকেন। সেখানে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করার জন্য আমি, আমিন, হাবিবুল্লাহসহ তিনজন ডাক পাই। সেখানে ড. কামাল হোসেনসহ আরও অনেকে ছিলেন। আমরা তিনজন একেবারে পিছনে ছিলাম। সেদিন খুব কাছ থেকে দেখেছি বঙ্গবন্ধুকে।

আপনার জীবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কোনো বিশেষ স্মৃতি কি আছে?

নূরুন নবী :  হ্যাঁ, দারুন একটা স্মৃতি আছে। স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালে ১১ জানুয়ারি কাদেরিয়া বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমরা কয়েকজন আমন্ত্রণ পাই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার। সেদিন ঠিক হয় তিনি টাঙ্গাইলে যাবেন ২০ জানুয়ারি এবং কাদেরিয় বাহিনীর অস্ত্র জমা নেবেন। যথাসময় আমরা প্রস্তুত থাকি। বঙ্গবন্ধু মূল আয়োজন ছাড়াও আরও কয়েক জায়গায় যান। এতে কোন এক সময় তাঁর কোটে  ধূলো লেগে যায়। সার্কিট হাউজে আসার পর একজন মুক্তিযোদ্ধা সেটা পরিস্কার করতে পারছিলেন না। তখন কাদের সিদ্দিকী এগিয়ে এসে বলেন, 'ককোটটা নুরুন নবীর গায়ে পরিয়ে দেন, এতে পরিষ্কার করতে সুবিধা হবে।' তাই করলেন কাদের সিদ্দিকী। বঙ্গবন্ধুর কোট আমার গায়ে এই স্মৃতিটা আমাকে বেশ আলোড়িত করেছে। 

১৯৭১ সালে আপনি ছাত্র ছিলেন। কার সঙ্গে যুক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে গেলেন?

নূরুন নবী :  ২৬ মার্চ প্রতিবাদী ছাত্রদের মিছিলে পাকিস্তানি বাহিনী গুলিবর্ষন করলে আমি বাঁচতে লাফ দিলে পাশের নর্দমায় পড়ে যাই। ইটের সঙ্গে আঘাত লাগে এবং আহত অবস্থাতে টাঙ্গাইল চলে যাই। সুস্থ হওয়ার পরপরই প্রথমে নিজেরা একটা টিম গঠন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু অস্ত্র পাওয়া, ট্রেনিং এসব সহজ ছিল না। সবকিছু বিবেচনা করে  বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তমের নেতৃত্বাধীন কাদেরিয়া বাহিনীতে নাম লেখাই। মুক্তিযুদ্ধে আমার দায়িত্ব ছিল যুদ্ধের কৌশল নির্ধারণ এবং ভারত থেকে অস্ত্র সংগ্রহ ও বহন করে নিয়ে আসা। সেগুলো যমুনা নদী দিয়ে নৌকায় করে ক্যাম্পে নিয়ে আসতাম। 

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সর্ব ডানে ড. নূরুন নবী, ১১ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে। ছবি লেখক

অন্যদিকে কাদেরিয়া বাহিনীর ৯১ কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা টাঙ্গাইলের পাশাপাশি ঢাকা, ময়মনসিংহ জামালপুর, সিরাজগঞ্জ ও পাবনাসহ কয়েকটি জেলায় প্রচণ্ড আঘাত হানেন এবং দখলদার পাকিস্তানিদের পরাজিত করেন।

জেনেছি আপনাকে 'ব্রেইন অব দি ফোর্স' বলে বিবেচনা করা হত।

নূরন নবী: প্রথমে মুক্তাঞ্চল ধরে রাখার মতো আমাদের কোনও সক্ষমতা ছিল না। হিট অ্যান্ড রান কায়দায় যুদ্ধ করেছি। এর মাঝে মুক্তাঞ্চল ধরে রাখার প্রয়োজনীতা দেখা দেয়। যার জন্য প্রচুর গোলাবারুদ ও আধুনিক অস্ত্রের প্রয়োজন। ওই সময় ভারত থেকে কোনও সাপ্লাই লাইনও ছিল না। তাই ভারত থেকে টাঙ্গাইলে অস্ত্র সংগ্রহের দায়িত্ব আমার ওপর বর্তায়। এজন্য আমি তিনবার ভারতে গিয়ে ভারতীয় বাহিনীর জেনারেলদের সাথে আলোচনা করে ৪০টি নৌকা বোঝাই অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে আসি। অবশ্য এ জন্য আমাকে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবদিহি করতে হয়েছিল। এমনকি ভারতীয় জেনারেলদের আস্থা অর্জন করতে হয়েছিল। অস্ত্র ও গোলাবারুদ আনতে পারায় আমাদের মুক্তিবাহিনীর মনোবল বেড়ে যায় এবং শত্রুর বিরুদ্ধে ক্রমাগত জয় অর্জন করতে থাকি।

নির্মাতা নাদিম ইকবাল নির্মিত ড. নূরুন নবী: আজীবন মুক্তিযোদ্ধা

আপনার জীবন নিয়ে 'আজীবন মুক্তিযোদ্ধা' প্রামাণ্যচিত্র। এতে কী দেখবে দর্শক?

নূরুন নবী:  নাদিম ইকবাল নির্মিত প্রামাণ্যচিত্রটির উদ্দেশ্য ছিল নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানানো। মুক্তিযুদ্ধে আমার ঝাঁপিয়ে পড়া থেকে শুরু করে পাক হানাদারদের আত্মসমর্পণ পর্যন্ত ঘটনা প্রবাহ। বিশেষ করে যমুনা নদী দিয়ে নৌকায় অস্ত্র নিয়ে আসা। নদীপথের সে অঞ্চলসহ (ভুঞাপুর ও বাহদুরাবাদ) আসামের গৌহাটি, মেঘালয়ের তুরা ট্রেনিং ক্যাম্প যেখানে ছিল, সেখানের চিত্র।

এমন ঘটনার পরম্পরা দেখলে শিহরিত হবেন দর্শক। এসব ঘটনাবলীর সচিত্র উপস্থাপনায় বাঙালির ত্যাগ এবং গণহত্যার ঘটনাগুলো দৃশ্যমান হবে। বাংলাদেশের মানুষকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য বারবার একাত্তরেই ফিরে যেতে হয়। 

এতে কথা বলেছেন- শাহরিয়ার কবির, মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, কবি আসাদ চৌধুরী, প্রবীণ সাংবাদিক সৈয়দ মোহাম্মদ উল্লাহ, বেলাল বেগ, বীর মুক্তিযোদ্ধা তাজুল ইমাম, 'সাপ্তাহিক বাঙালি'র সম্পাদক কৌশিক আহমেদ, বিশিষ্ট অভিনেত্রী ও আবৃত্তিকার লুৎফুন নাহার লতা প্রমুখ।

অনেক ত্যাগের দেশ ছেড়ে বিদেশ থাকেন। দূর দেশে মুক্তিযুদ্ধ কীভাবে প্রেরণা দেয়?  

নূরুন নবী:  মুক্তিযুদ্ধ যেকোনো জাতির  জীবনে একবারই আসে। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল সেই মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আমাকে এক জীবন তাড়া করে গেছে, যাচ্ছে, যাবে। আজও ধ্যানে ও মনে আমি মুক্তিযুদ্ধকেই লালন করি। দেশের জন্য যেসব কাজ করছি, তা দেশে থাকলে হয়তো করতে পারতাম না। তবে মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণায় পথ চলি। 

Comments

The Daily Star  | English

A budget without illusions

No soaring GDP promises. No obsession with mega projects. No grand applause in parliament. This year, it’s just the finance adviser and his unemotional speech to be broadcast in the quiet hum of state television.

7h ago