বিজয়ের ৫১ বছরেও শহীদ পরিবারের স্বীকৃতি পাননি তারা

বিজয়ের ৫১ বছরেও শহীদ পরিবারের স্বীকৃতি পাননি তারা
বাড়ির সামনে শচীন্দ্র কুমার নাথ। ছবি: আনোয়ারুল হায়দার/স্টার

মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫১ বছর পেরিয়ে গেলেও শহীদ পরিবারের স্বীকৃতি পাইনি। কেউ আমাদের খবরও রাখেনি। পরিবার পরিজন নিয়ে অর্থাভাবে দিনাতিপাত করছি। শত বছর বয়সেও সরকারি কোনো সহযোগিতা পাইনি।

আক্ষেপের সঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের মোহাম্মদপুর গ্রামের শচীন্দ্র কুমার নাথ (৯৯) ও তার ভাতিজা নীগেদ্র চন্দ্র দেবনাথ (৬৮)। গত ১২ ডিসেম্বর বিকেলে তাদের সঙ্গে দ্য ডেইলি স্টারের কথা হয়।

শচীন্দ্র কুমার নাথ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি চারণ করে বলেন, ১৯৭১ সালে ৪ সেপ্টেম্বর আমি আমার বড় ভাই ও পাশের ঘরের মামাত ভাই যতীন্দ্র চন্দ্রনাথ ও মনোরঞ্জন নাথ সকালের স্নান শেষে নাস্তা খাওয়ার জন্য বসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এমন সময় স্থানীয় ২ থেকে ৩ জন রাজাকার ও ৮ থেকে ৯ জন পাকসেনা ঘরে এসে আমার বড়ভাই রাজেন্দ্র চন্দ্র দেবনাথ ও ২ মামাত ভাই যতীন্দ্র চন্দ্র নাথ ও মনরঞ্জন নাথকে অস্ত্রের মুখে ঘর থেকে ধরে নিয়ে যায়। আমি পাশের ঘর থেকে এই দৃশ্য দেখে বুঝতে পেরেছিলাম আমার ভাইদের হত্যা করার জন্য নিয়ে যাচ্ছে। আমি ঘরের পেছনের বেড়া ভেঙ্গে পানি দিয়ে ধানখেতের ভেতর পালিয়ে গিয়ে প্রাণে রক্ষা পাই। মোহাম্মদপুর রাজাবাড়ী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ২০ থেকে ২৫ জনের সঙ্গে আমার ৩ স্বজনকেও পাখির মতো গুলি করে মেরে ফেলে। পরে তাদের লাশ মহেন্দ্রখালে ফেলে দেয়। স্রোতে ভেসে যায় লাশ। ভাইদের মরদেহ দাফন করার সুযোগও পাইনি। আমরা শহীদ পরিবারের সন্তান। স্বাধীনতার ৫১ বছর পেরিয়ে গেলেও শহীদ পরিবারের স্বীকৃতি তো পাইনি বরং আমাদের খবরও কেউ রাখেনি।

ভাঙ্গা ঘরে অর্থাভাবে বাস করছেন তারা। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের পরিবারের ৩ সদস্যকে হত্যা করে পাকিস্তানিরা। ছবি: আনোয়ারুল হায়দার/স্টার

তিনি বলেন, ভাঙ্গা ঘর আর অর্থ ও খাদ্যকষ্টে পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছি। শুনেছি বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধে জীবন দানকারীদের জন্য অনেক সহযোগিতা করছেন। তাহলে আমরা কেন বঞ্চিত?' কথাগুলো বলতে বলতে চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে আসে শচীন্দ্র কুমার নাথের।

শচীন্দ্র কুমার নাথের বাবা মৃত গোবিন্দ কুমার নাথ পেশায় ছিলেন কাপড় ব্যবসায়ী। তাদের পৈত্রিক বাড়ি চাটখিল উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামে।

শচীন্দ্র কুমার বলেন, পৈত্রিক পেশা ছিল তাঁত ও কাপড়ের ব্যবসা। গত ২৫ বছর ধরে বয়সের কারণে দুর্বল হয়ে পড়েছি। চোখে ভালো দেখি না। তাই বাড়িতে অবসর জীবন কাটাচ্ছি। গত ৮ মাস আগে স্ত্রী ব্রজবালা (৯০) অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন। আর্থিক অভাবে তার চিকিৎসা করাতে পারিনি।

তিনি জানান, ১৯৭১ সালে তার বয়স ৪৮ কিংবা ৪৯। তৎকালীন লক্ষ্মীপুর মহকুমার রামগঞ্জ থানার (বর্তমানে চাটখিল উপজেলা) বিভিন্ন হাট বাজারে তিনি কাপড় বিক্রি করতেন। তার বড় ভাই রাজেন্দ্র চন্দ্রনাথ তাঁতের কাপড় বুনতেন। এই ভাবে ভালোই চলছিল তাদের সংসার। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে ব্যবসা মন্দা দেখা দেয়।

স্বাধীনতা যুদ্ধে আমার পরিবারের ৩ জন প্রাণ দিলো কিন্তু স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পেরিয়ে গেলেও শহীদ পরিবার হিসাবে আমরা কোনো স্বীকৃতি তো পাইনি। শত বছর বয়সে এসে আর্থিক সংকটের মধ্যে দিনাতিপাত করছি, যোগ করেন তিনি।

যতীন্দ্র চন্দ্র নাথের ছেলে নীকুঞ্জ দেবনাথ বলেন, শুনেছি বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবার ও বয়স্ক লোকদের জন্য অনেক সুযোগ সুবিধা দিয়ে থাকেন। কিন্তু আমরা তো কিছুই পাইনি। বয়স্কদের জন্য ভাতাও পাইনি। আমার চাচা শচীন্দ্র দেবনাথের বয়স (৯৯)। তাকে বিভিন্ন প্রকার ওষুধ সেবন করতে হয়। আর্থিক অনটনের কারণে তিনি নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে পারছেন না। কোনো সরকারি সহযোগিতাও পান না। আর কত বয়স হলে সরকারের বয়স্ক ভাতা পাবো?

পাকিস্তানিদের হাতে নিহত রাজেন্দ্র চন্দ্র নাথের ছেলে বিনোদ চন্দ্র নাথ (৬০) বলেন, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে আমার বাবা প্রাণ দিল অথচ আমাদের খবর কেউ রাখে না। মরিচা ধরা জীর্ণশীর্ণ একটি দোচালা টিনের ঘরে পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছি।

এ বিষয়ে স্থানীয় মোহাম্মদপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মেহেদি হাসান বাহালুল বলেন, আমি নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান। আমার ইউনিয়নের কোনো বয়স্ক লোক ভাতার বাহিরে থাকবে না। আমি খোঁজ নিয়ে তাদের ব্যবস্থা করবো।

নোয়াখালী-১ আসনের (চাটখিল-সোনাইমুড়ী) সংসদ সদস্য এইচ এম ইব্রাহীম বলেন, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান কিংবা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কেউ আমাকে এই বিষয়টি জানায়নি। শহীদ পরিবারের লোকজন ভাতা পাবেন না এটা তো মেনে নেওয়া যায় না। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। আমি এই বিষয়ে খবর নিয়ে ওই পরিবারগুলোর জন্য ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করবো।

Comments

The Daily Star  | English

Interest payments, subsidies soak up almost half of budget

Interest payments and subsidies have absorbed nearly half of Bangladesh’s total budget expenditure in the first seven months of the current fiscal year, underscoring growing fiscal stress and raising concerns over public finances.

2h ago