২০ ডিসেম্বরের কথা মনে হলে আজও আঁতকে ওঠেন ফনি চন্দ্র শীল

মৌলভীবাজারে অস্ত্রাগারে বিস্ফোরণ
ফনি চন্দ্র শীল। ছবি: মিন্টু দেশোয়ারা/স্টার

ঘটনাটা ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বরের। দেশ স্বাধীন হয়েছে ৪ দিন আগে। যুদ্ধ শেষে ফনি চন্দ্র শীল আর তার সহযোদ্ধারা মৌলভীবাজার সরকারি হাইস্কুলে অবস্থান করছিলেন। সেখানে তাদের অস্ত্রাগারও ছিল। ঘরটিতে ছিল বোমা, মর্টার, মাইনসহ নানান অস্ত্র-গোলাবারুদ।

দুপুরে পাশের রান্নাঘরে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রান্না করছিলেন অনন্ত। অস্ত্রাগারে জহির অস্ত্রগুলো নেড়েচেড়ে দেখছিলেন। সে সময় হঠাৎ বিস্ফোরণে কেঁপে উঠে চারপাশ।

মুহূর্তেই সবার দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। ঘটনাস্থলেই শহীদ হন অন্তত ২০ বীর মুক্তিযোদ্ধা। শরীরে মাইনের স্প্লিন্টার বিঁধে জ্ঞান হারান ফনি চন্দ্র শীল। আর কিছুই মনে নেই তার।

৫১ বছর আগের সেই ঘটনার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে আজও আঁতকে ওঠেন ফনি চন্দ্র শীল (৬৮)।

মৌলভীবাজারে অস্ত্রাগারে বিস্ফোরণ
১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বরের শহীদদের স্মরণে মৌলভীবাজারে স্মৃতিসৌধ। ছবি: মিন্টু দেশোয়ারা/স্টার

মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার মুছেগুল গ্রামের মৃত হরেন্দ্র চন্দ্র শীলের ছেলে ফনি চন্দ্র শীল। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল ১৫ বছর। নবম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন তিনি।

ফনি চন্দ্র শীল দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, যুদ্ধ শুরুর কিছুদিন পর সপরিবারে তারা ভারতে পাড়ি দিলেও, দেশের টানে বাড়ি থেকে পালিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

ফনি চন্দ্র শীল বলেন, '১৯৭১ সালের এপ্রিলে… তারিখটা ঠিক মনে নেই। পাকিস্তান হানাদার বাহিনী বড়লেখায় আসে। ঠিক ওই রাতে আমরা সপরিবারে ভারতে চলে যাই।' 'পরিবারে মা-বাবা আর আমরা ২ ভাই এবং এক বোনের মধ্যে আমি দ্বিতীয় ছিলাম। তাদের শরণার্থী শিবিরে রেখে যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি নিই। এ কথা শুনে মা কাঁদলেন, বাধা দিলেন।'

'পরিবারের বাধা উপেক্ষা করে আমি সেদিন দেশের টানে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য চলে যাই ভারতের লোহারবন্দ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। সেখানে এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) ট্রেনিং নিলাম। এক মাস পর প্রশিক্ষণ শেষে চলে আসি ভারতের রাগনায় (৪ নম্বর সেক্টর) মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে। সেখান থেকে যুদ্ধের জন্য তৎকালীন কুলাউড়া থানার ফুলতলায় আসি। এরপর সিলেট বিভাগের বেশ কয়েকটি স্থানে যুদ্ধে অংশ নিই,' যোগ করেন তিনি।

মৌলভীবাজারে অস্ত্রাগারে বিস্ফোরণ
২০ ডিসেম্বরের শহীদদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ। ছবি: মিন্টু দেশোয়ারা/স্টার

১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর মৌলভীবাজার সরকারি হাইস্কুলে ঘটে যাওয়া ওই লোমহর্ষক ঘটনার কথা উল্লেখ করে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা আরও বলেন, '৮ ডিসেম্বর মৌলভীবাজার হানাদার মুক্ত হয়। এরপর থেকে আমরা মৌলভীবাজার সরকারি হাইস্কুলে থাকতাম। স্কুলের পূর্ব দিকে রান্না ঘরের পাশে অস্ত্রাগার ছিল। পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া আর্টিলারি, বোমা, রকেটের বোম, মাইনসহ নানান ধরনের অস্ত্র-গোলাবারুদ সেখানে রাখা হতো।'

তৎকালীন জিন্নাহ হলে পাকিস্তানিদের ক্যাম্প ছিল জানিয়ে ফনি চন্দ্র শীল বলেন, 'সেখানে আমাদের ২ জনকে পাকিস্তানিদের ক্যাম্প দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয়।'

'২০ ডিসেম্বর ডিউটি থেকে ফিরে আমি অস্ত্র রেখে ভাত খাওয়ার জন্য থালা হাতে নিয়েছি। আমরা বেশ কয়েকজন। সবার নাম মনে নেই। ভাত খাবো। কেউ ভাত নিচ্ছেন, কেউ ডিম নিচ্ছেন। তখন অস্ত্রাগারে জহির অস্ত্রগুলো নাড়াচাড়া করছিলেন।'

'আমি থালাতে যখন ডিম নিয়েছি হঠাৎ বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। রান্না ঘরে অনন্তসহ ২০ জনের মতো ছিলেন। মুহূর্তেই সবার দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যায়। আমার শরীরে তখন মাইনের স্প্লিন্টার এসে বিঁধে। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।'

ফনি চন্দ্র শীলকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরদিন তার জ্ঞান ফেরে। এরপর তিনি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন। সুস্থ হওয়ার পর তিনি বাড়ি ফিরে যান।

দেশ স্বাধীন হওয়ার ৫১ বছর পেরিয়েছে। বৃদ্ধ ফনি চন্দ্র শীল এখন চোখে কিছুটা কম দেখেন। স্ত্রী আর ২ ছেলেকে নিয়েই এখন চলছে তার জীবন।

ফনি চন্দ্র শীল আরও বলেন, 'দেশ স্বাধীন হওয়ার ৫১ বছর হয়েছে। কিন্তু আজও বাড়ি বানাতে পারিনি, হয়তো পারবও না। সরকার থেকে যা ভাতা পাই, তা দিয়ে সংসার আর সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ চলে যায়। আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের যে সম্মান দিচ্ছে, এর জন্য আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞ।'

Comments

The Daily Star  | English

One stabbed among at least four injured in clashes during NCP rally in Bogura

The incident occurred around 4:30pm near the Titu Auditorium in Bogura town during a programme organised by the NCP

1h ago