ঐতিহাসিক চিত্র: বাংলার প্রথম ইতিহাসভিত্তিক পত্রিকা
মাতৃভূমির ইতিহাসচর্চার মহান প্রয়াসে বাংলার সুবিখ্যাত ইতিহাসবিদ অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় নিজ সম্পাদনায় রাজশাহী থেকে প্রকাশ করেন 'ঐতিহাসিক চিত্র'। তিনি ছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঐতিহাসিক চিত্রের প্রধান সারথী। অক্ষয়কুমারের অনুরোধে কবিগুরু ত্রৈমাসিক এই পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় 'সূচনা' নামে ভূমিকা লিখে দেন। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে ঐতিহাসিক চিত্রই ইতিহাসভিত্তিক বাংলার প্রথম পত্রিকা।
আজ ৫ জানুয়ারি। 'ঐতিহাসিক চিত্র'র ১২৩তম প্রতিষ্ঠা দিবস। ১৮৯৯ সালে ৫ জানুয়ারি 'ঐতিহাসিক চিত্র'র প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়।
রাজশাহী মহানগরীর ঘোড়ামারায় অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়ের বাসভবন 'অক্ষয় নিকেতনে' পত্রিকাটির কার্যালয় স্থাপিত হয়েছিল। ছাপা হয়েছে রাজশাহীর 'বাণী প্রেস' থেকে। ছড়াকার সুকুমার রায়ের পিতা ও প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের দাদা বিখ্যাত ছড়াকার শিল্পী উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী ছিলেন 'ঐতিহাসিক চিত্র'র প্রচ্ছদ শিল্পী।
অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় আত্মকথায় লিখেন, 'রবীন্দ্রনাথ "ভারতী" পত্রের সম্পাদনার ভার গ্রহণ করিলে (১৩০৫), তাঁহার সহায়তায় এবং তাঁহার প্রস্তাবে, ঐতিহাসিক চিত্র নামক ত্রৈমাসিক পত্রের সম্পাদনভার গ্রহণ করি।' (শ্রীহরিমোহন মুখোপাধ্যায়, 'বঙ্গভাষার লেখক' গ্রন্থে অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় লিখিত 'আত্মকথা', বঙ্গভাষী কার্যালয়, কলকাতা, ১৯০৪ সাল)
বাঙালির ইতিহাস লিখতে হলে তার বিবরণ সংকলনের প্রয়োজন। এই তাগিদে তাড়িত হয়েই অক্ষয়কুমার পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেন। গৌড়রাজমালা গ্রন্থের উপক্রমণিকাতে অক্ষয়কুমার বলেন, 'ইতিহাসের উপাদান সঙ্কলিত না হইলে, ইতিহাস সঙ্কলিত হইতে পারে না।'
বাংলা ভাষায় আধুনিক ইতিহাসচর্চার প্রয়াস শুরু হয় ইংরেজ আমলা ও ইতিহাসবিদদের হাত ধরে। তবে, কেবলমাত্র ইতিহাসকে বিষয় করে কোনো পত্রিকার তখন পর্যন্ত প্রকাশ ঘটেনি। এ ব্যাপারে প্রথম এগিয়ে আসেন অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, তার 'ঐতিহাসিক চিত্র' নিয়ে।
'ঐতিহাসিক চিত্র' জন্মসূচনার সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য ও প্রভাব সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের জীবনচরিত রচয়িতা শ্রীপ্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বলেন, 'সাহিত্যেও যেমন ইতিহাসের ক্ষেত্রেও বাংলা দেশে তেমনি আত্মপ্রকাশের চেষ্টা চলিতেছিল। ইহার সূত্রপাত করেন পরলোকগত অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়। রবীন্দ্রনাথের বিশেষ প্রস্তাবে তিনি "ঐতিহাসিক চিত্র" প্রকাশ করেন।' (শ্রীপ্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রজীবনী, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৫৫, কলকাতা, ১৯৩৩ সাল)
পত্রিকা প্রকাশের আগের যোগসূত্র ঘটনা। অক্ষয়কুমারের উদ্দেশ্য ছিল একটি সভা স্থাপন করা। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের পরামর্শ চাইলে রবীন্দ্রনাথ পত্রিকা প্রকাশের পরামর্শ দেন। অক্ষয়কুমার বন্ধুর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং নিজেই পত্রিকার নাম 'ঐতিহাসিক চিত্র' রেখে প্রকাশে এগিয়ে যান। আবির্ভাবের আগে পত্রিকাটির উদ্দেশ্য ও আদর্শ নিয়ে একটি প্রস্তাবপত্র মুদ্রিত আকারে প্রকাশ করে অক্ষয়কুমার বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সংবাদপত্রে পাঠান। এই প্রস্তাবপত্রকে তখন 'অনুষ্ঠানপত্র' বলা হতো।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন 'ভারতী' পত্রিকার সম্পাদক। উল্লিখিত প্রস্তাবপত্রটি অক্ষয়কুমার 'ঐতিহাসিক যৎকিঞ্চিৎ' নামে 'ভারতী' পত্রিকায় ছাপানোর জন্য পাঠান। রবীন্দ্রনাথ 'ঐতিহাসিক যৎকিঞ্চিৎ' 'ভারতী'তে (আষাঢ় ১৩০৫, পৃষ্ঠা ৮১-৮৬) প্রকাশ করেন এবং 'ভারতী'র একই সংখ্যায় কবিগুরু 'প্রসঙ্গকথা' নামক সম্পাদকীয়তে (পৃষ্ঠা ৯৩-৯৬) একটি স্বতন্ত্র আলোচনা লিখে দেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উক্তরূপ 'প্রসঙ্গকথা'য় অক্ষয়কুমারকে 'আধুনিক বাঙ্গালী ইতিহাস-লেখকগণের শীর্ষ-স্থানীয়' বলে আখ্যায়িত করেন।
'ঐতিহাসিক যৎকিঞ্চিৎ' ও 'প্রসঙ্গকথা' প্রকাশের ২ মাস পরে 'ঐতিহাসিক চিত্র'র আবির্ভাব উপলক্ষে কবিগুরু 'ভারতী'র ভাদ্র সংখ্যায় পুনরায় 'প্রসঙ্গকথা' লেখেন (পৃষ্ঠা ৪৭৬-৪৭৭)। সেখানে কবিগুরু 'ঐতিহাসিক চিত্র'কে পরম-মমত্বে ডেকেছেন 'নৌযাত্রায়' 'একটি তরণী' বলে।
অক্ষয়কুমারের সম্পাদনার প্রতি পরিপূর্ণ আস্থা রেখে কবিগুরু 'প্রসঙ্গকথা'য় আরও বলেন, 'পরের মুখে নিজেদের কথা না-শুনে ভারতের প্রকৃত ইতিহাস উদ্ধার এবার বুঝি সম্ভব হবে। হৌক বা না-হৌক আমাদের ইতিহাসকে আমরা পরের হাত থেকে উদ্ধার করিব।…আমাদের ভারতবর্ষকে আমরা স্বাধীন দৃষ্টিতে দেখিব, সেই আনন্দের দিন আসিয়াছে। উপযুক্ত সম্পাদক উপযুক্ত সময়ে এ কার্যে অগ্রসর হইয়াছেন ইহা আমাদের আনন্দের বিষয়।'
রবীন্দ্রনাথ ও অক্ষয়কুমার নিবিড় বন্ধুত্বে বহু কাজ একসঙ্গে করেছেন। তারা বটবৃক্ষের মতো একে অপরের ছায়াসঙ্গী ছিলেন। এই রবীন্দ্রছায়ারই ফসল 'ঐতিহাসিক চিত্র'। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে প্রকাশিত বাংলা সাময়িকী হিসেবে তখনকার পণ্ডিত সমাজে 'ঐতিহাসিক চিত্র' সমগ্র বাংলায় সমাদৃত হয়। ইতিহাসবিদ ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার 'ঐতিহাসিক চিত্র' প্রসঙ্গে বলেন, 'বাংলাভাষায় এইরূপ চেষ্টা এই প্রথম।' (ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার, ভারতকোষ, প্রথম খণ্ড, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, কলকাতা, ১৯৬৪ সাল)
'ঐতিহাসিক চিত্র'র প্রথম সংখ্যার সম্পাদকের নিবেদনে সম্পাদকীয়তে অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় দৃঢ়তায় উল্লেখ করেন, 'ঐতিহাসিক চিত্র কোনো ব্যক্তি বা সম্প্রদায় বিশেষের মুখপত্র হইবে না, ইহা সাধারণত ভারতবর্ষের এবং বিশেষত বঙ্গদেশের, পুরাতত্ত্বের উপকরণ সংকলনের জন্যই যথাসাধ্য যত্ন করিবে। সে উপকরণের কিয়দংশ যে পুরাতন রাজবংশে ও জমিদার বংশেই প্রাপ্ত হওয়া সম্ভব, তাহাদের সহিত এদেশের ইতিহাসের ঘনিষ্ঠ সংশ্রব। সুতরাং, প্রসঙ্গক্রমে তাহাদের কথারও আলোচনা করিতে হইবে। যাঁহারা আধুনিক রাজা বা জমিদার তাঁহাদের কথা নানা কারণে ভবিষ্যতের ইতিহাসে স্থান প্রাপ্ত হইবে। সে ভার ভবিষ্যতের ইতিহাস-লেখকের হস্তে রহিয়াছে। ঐতিহাসিক চিত্র-র সহিত তাহার কিছুমাত্র সংশ্রব নাই—পুরাতত্ত্ব সংকলন করাই ইহার একমাত্র উদ্দেশ্য।'
অক্ষয়কুমারের 'ঐতিহাসিক চিত্র' রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ইতিহাস চেতনাকেও প্রভাবিত করেছে। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের জীবনচরিত রচয়িতা শ্রীপ্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের অভিমত, 'ঐতিহাসিক চিত্রের প্রকাশকালে (১৮৯৯) রবীন্দ্রনাথের কবিচিত্তও যে তৎকালীন ঐতিহাসিক চেতনার প্রভাবাধীন হয়ে পড়েছিল তার প্রমাণ পাই তাঁর "কথা" কাব্যে। উক্ত গ্রন্থের অধিকাংশ কবিতাই যে ১৮৯৯ সালের রচনা তা নিতান্তই আকস্মিক নয়। কথা কাব্যের সব কবিতাই কোন না কোন ঐতিহাসিক সূত্র অবলম্বনে রচিত। …কথা কাব্যে ও ঐতিহাসিক চিত্রের মধ্যে যে একটি সূহ্ম যোগসূত্র বিদ্যমান ছিল।' (শ্রীপ্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রজীবনী, প্রথম খণ্ড, কলকাতা, ১৯৩৩ সাল)
গবেষণামূলক রচনা সুসঙ্গতভাবে উপস্থাপনের ব্যাপারে 'ঐতিহাসিক চিত্র'র ভূমিকাই বাংলা ভাষায় প্রথম। 'ঐতিহাসিক চিত্র'তে নিত্যনৈমিত্তিক গবেষণাকর্ম ছাড়াও প্রত্নতাত্ত্বিক বিষয়াবলি প্রকাশে গুরুত্ব পেতো বেশি। স্থানীয় ইতিহাস রচনার উপকরণ সংগ্রহ করে সহজ ও বোধগম্য ভাষায় তুলে ধরা হতো, ফলে সব শ্রেণির পাঠকের কাছে পত্রিকাটি সমাদৃত হয়।
'ঐতিহাসিক চিত্র'তে লেখা পরিবেশনে নবীন-প্রবীণের সমন্বয় ঘটেছিল। ফলে সৃজনশীল লেখক তৈরিতে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে পত্রিকাটির। প্রথম সংখ্যার সূচি (আংশিক): 'সূচনা' শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, 'সম্পাদকের নিবেদন' শ্রীঅক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, 'ইন্ডিকা' শ্রীভবানীগোবিন্দ চৌধুরী, 'রিয়াজ-উস-সালাতিন' (উপক্রমণিকা) শ্রীঅক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, 'মল্লভূমি' শ্রী শশিভূষণ বিশ্বাস, 'নবাবিষ্কৃত তান্ত্রশাসন' প্রসন্ননারায়ণ চৌধুরী, 'জগৎশেঠ' শ্রীনিখিলনাথ রায়।
অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্যে যে নিবিড় সখ্য গড়ে উঠেছিল তা আরও প্রগাঢ় হয়েছিল 'ঐতিহাসিক চিত্র'কে ঘিরেই। অক্ষয়কুমার নিয়মিত কবিগুরুর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন, কবিগুরুও তাকে সাদরে আপ্যায়ন করতেন। সে-সময়ে ঠাকুরবাড়িতে যারা নিয়মিত যাতায়াত করতেন, তাদের মধ্যে অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ছিলেন অন্যতম। 'ঐতিহাসিক চিত্র'কে নিয়েও কবিগুরুর সঙ্গে অক্ষয়কুমারের একাধিক পত্রালাপ রয়েছে।
কবিগুরুর পুত্র রথীন্দ্রনাথ তার আত্মকথায় বলেন, 'রাজশাহী থেকে ঐতিহাসিক অক্ষয় মৈত্রেয় মহাশয় বাবার কাছে মাঝে মাঝে আসতেন। অগাধ তাঁর পাণ্ডিত্য, কিন্তু তাঁর মধ্যে একটুও শুষ্কতা ছিল না। তিনি যখন বাংলাদেশের ইতিহাসের কথা বলতেন, গল্পের মত ফুটে উঠত চোখের সামনে পুরোনো ইতিবৃত্তের কথা। বাবার সঙ্গে ইতিহাস ছাড়াও নানা বিষয়ে আলোচনা হত, যা থেকে তাঁর মনের গভীরতার প্রচুর পরিচয় পাওয়া যেত।' (রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পিতৃস্মৃতি, জিজ্ঞাসা, পৃষ্ঠা ৩১-৩২, কলকাতা, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৩৭৮)
সূচনায় 'ঐতিহাসিক চিত্র'কে 'স্বদেশি কারখানা'র সঙ্গে তুলনা করে কবিগুরু 'ঐতিহাসিক চিত্র'কে 'আমাদের স্বাস্থ্য—আমাদের প্রাণ' বলে উল্লেখ করেন। গভীর উচ্ছ্বাসের সঙ্গে 'সূচনা'য় রবীন্দ্রনাথ লিখেন, 'ঐতিহাসিক চিত্র ভারতবর্ষের ইতিহাসের একটি স্বদেশী কারখানাস্বরূপ খোলা হইল। এখনো ইহার মূলধন বেশী জোগাড় নাই, ইহার কলবরও স্বল্প হইতে পারে, ইহার উৎপন্ন দ্রব্যও প্রথম প্রথম কিছু মোটা হওয়া অসম্ভব নহে, কিন্তু ইহার দ্বারা দেশের যে গভীর দৈন্য, যে মহৎ অভাব মোচনের আশা করা যায়, তাহা বিলাতের বস্তা বস্তা সূক্ষ্ম ও সুনির্মিত পণ্যের দ্বারা সম্ভবপর নহে।' ('সূচনা' রবীন্দ্র-রচনাবলী নবম খণ্ডে আধুনিক সাহিত্য অংশে এবং ইতিহাস গ্রন্থে সংকলিত)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'সূচনা'য় পত্রিকাটির দীর্ঘায়ু কামনা করেছিলেন, 'আশা করি যে, এই পত্র আমাদের দেশে ঐতিহাসিক স্বাধীন চেষ্টার প্রবর্তন করিবে। …সেই চেষ্টাকে জন্ম দিয়া যদি ঐতিহাসিক চিত্রের মৃত্যু হয়, তথাপি সে অমর হইয়া থাকিবে।'
১ বছরে ৪টি সংখ্যা প্রকাশের পর অর্থের অভাবে 'ঐতিহাসিক চিত্র' প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়। সংক্ষিপ্ত জীবনকাল হলেও স্থানীয় ইতিহাসের উপকরণ সংগ্রহ ও সংরক্ষণে 'ঐতিহাসিক চিত্র' গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 'ঐতিহাসিক চিত্র' তখনকার বঙ্গীয় সমাজে সুদূরপ্রসারী প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল।
'ঐতিহাসিক চিত্র'র প্রখ্যাতির কারণে ইতিহাসবিদ নিখিলনাথ রায়ের সম্পাদনায় মাসিক হিসেবে পত্রিকাটি প্রকাশ শুরু করেন পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ থেকে। দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রকাশনা হয় ভাদ্র ১৩১১ থেকে শ্রাবণ ১৩১২ (১৯০৪-১৯০৫ সাল) এবং তৃতীয় পর্যায়ে বৈশাখ ১৩১৪ থেকে ১৩১৮ বঙ্গাব্দ (১৯০৭-১৯১২ সাল)। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ের 'ঐতিহাসিক চিত্র'তে অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় নিয়মিত লিখেছেন।
অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়ের 'ঐতিহাসিক চিত্র'র ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও প্রভাব সম্পর্কে সাহিত্যিক প্রবোধচন্দ্র সেন বলেন, '…এক পর্বে ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য বঙ্কিমচন্দ্র যে প্রেরণা দিয়েছিলেন, তার পরবর্তী পর্বে তাতে শক্তি যোগালেন রবীন্দ্রনাথ। ঐতিহাসিক চিত্রে এই দুই সাহিত্যরথীর ইতিহাস-প্রেরণার একত্রে সমাবেশ ঘটেছিল। ঐতিহাসিক চিত্রের মৃত্যু হয়েছে, তথাপি সে লোকত্রয় জয় করে অমর হয়েছে। ইদানীং কালে (১৯৫০) বঙ্গীয় ইতিহাস পরিষদ্ 'ইতিহাস' নামে যে ত্রৈমাসিক পত্র প্রকাশ করেছেন, অর্ধ শতাব্দীরও পূর্বে ঐতিহাসিক চিত্রই তার পথনির্মাণে ব্রতী হয়েছিল, একথা বিস্মৃত হওয়া উচিত নয়।' (প্রবোধচন্দ্র সেন, বাংলার ইতিহাস-সাধনা, পৃষ্ঠা ৩৯-৪০, জেনারেল প্রিন্টার্স অ্যান্ড পাবলিশার্স লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৫ ভাদ্র ১৩৬০)
স্মরণযোগ্য যে, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়ের জন্ম ১৮৬১ সালের ১ মার্চ কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে (তৎকালীন নদীয়া)। অক্ষয়কুমার শৈশবে শিক্ষা লাভ শুরু করেন পিতৃবন্ধু গ্রামীন সাংবাদিকতার পথিকৃৎ কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের কাছে। তিনিই তার সাহিত্যপথের গুরু। পরে, রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল, কলকাতা প্রেসিডেন্সি ও রাজশাহী কলেজে শিক্ষা লাভ করেন।
পিতা মথুরাথ মৈত্রেয় ১৮৭২ সালে রাজশাহীর আদালতে চাকরি নিয়ে রাজশাহীবাসী হন। সেই থেকে অক্ষয়কুমারও রাজশাহীবাসী। তাদের আদিবংশীয়দের বাস ছিল নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলার গুড়নই গ্রামে।
কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের বাড়িতে বাউলসম্রাট লালন সাঁইয়ের সঙ্গে ১৮৮০ সালে পরিচয় ঘটে অক্ষয়কুমারের এবং সাঁইয়ের পরমসান্নিধ্যে লাভে ধন্য হন। পেশায় উকিল হলেও বাংলার ইতিহাসচর্চা ও রচনাকে তিনি সাধনা হিসেবে গ্রহণ করেন।
অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় উনবিংশ শতাব্দীর শেষ একদশক ও বিংশ শতাব্দীর শেষ তিন দশক বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইতিহাসবিদ ছিলেন। সিরাজদ্দৌলা, গৌড়লেখমালা, গৌড়রাজমালা (সম্পাদনা), সমরসিংহ, সীতারাম রায়, মীরকাসিম, ফিরিঙ্গি বণিক, রাণী ভবানীসহ আরও বহু গ্রন্থ ও অন্তত দুইশতাধিক প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা ও প্রকাশ করে বাংলার ইতিহাস জাগিয়ে তোলতে অনবদ্য ভূমিকা পালন করেন। তার রচনায় বিশেষত 'সিরাজদ্দৌলা' ব্রিটিশ বিরোধী স্বদেশি আন্দোলন উজ্জীবিত করে।
রাজশাহীর বিখ্যাত বরেন্দ্র বিসার্চ মিউজিয়ামের তিনি প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন। খ্যাতিমান লেখক শ্রীভবানীগোবিন্দ চৌধুরী যথার্থই বলেন, 'রাজসাহীতে যাহা কিছু অক্ষয়, তাহাতেই অক্ষয়কুমার ছিলেন।' (ভারতবর্ষ, 'অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়', বৈশাখ, ১৩৩৭, পৃষ্ঠা ৮২৫)
রাজশাহীর যে সকল গৌরবদীপ্ত সন্তান তাদের বহুমুখী কর্মপ্রতিভা ও পাণ্ডিত্য দিয়ে বরেন্দ্রভূমি, সমগ্র বাংলা, ভারতবর্ষ, এমনকি বিশ্বব্যাপি নন্দিত হয়েছেন, তাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইতিহাস-সাধক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়। বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে বাংলার ইতিহাসচর্চার পথিকৃৎ অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ১৯৩০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীতে মৃত্যুবরণ করেন।
লেখক: উপ-রেজিস্ট্রার, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
Comments