ঢাকার প্রথম শহীদ মিনার এবং পিয়ারু সরদার
'অশ্রুমেশা আমাদের সেই প্রথম শহীদ মিনার
যদিও আজ দাঁড়িয়ে নেই আর,
বর্তমানের মিনারেই তো রয়েছে স্মৃতি তার
আর স্মৃতিতে আজও আছেন পিয়ারু সরদার!'
'পিয়ারু সরদার স্মরণে' অমর চরণটি লিখেছিলেন সব্যসাচী সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক। ভাষা আন্দোলন ও ঢাকায় একুশের প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণের পেছনে এক অনন্য কারিগর ছিলেন পুরান ঢাকার প্রভাবশালী সরদার, পিয়ারু সরদার।
২১ ফেব্রুয়ারি মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণে শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা শহীদ মিনার নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তাদের জন্য সেদিন পরিস্থিতি প্রতিকূল। কারফিউ ও সেনাবাহিনীর টহলের মাঝে নির্মাণসামগ্রী জোগাড় করা রীতিমতো অসম্ভব। মেডিকেলের তখন সম্প্রসারণের কাজ চলছিল। নির্মাণ সামগ্রী সব আছে। কিন্তু সিমেন্ট ছিল পাশেই তালাবদ্ধ গুদামে। 'তালার চাবি নিশ্চয়ই ঠিকাদারের কাছেই পাওয়া যাবে' বললেন ছাত্রদের কেউ কেউ। কিন্তু ঠিকাদারকে পাওয়া যাবে কোথায়!
মেডিকেল ছাত্র আলী আসগর বললেন, তিনি চেনেন ঠিকাদারকে। ঠিকাদার এই মহল্লারও সরদার। চারদিকে আঁধার ঘনিয়ে এসেছে তখন, অন্যদিকে কারফিউ। সেই কারফিউর মধ্যেই কয়েকজন গেলেন সরদারের বাড়ি।
ঠিকাদারের কাছে গিয়ে নিজেদের ইচ্ছা জানালেন তারা। সেই ঠিকাদারই ছিলেন পিয়ারু সরদার।
সবকিছু জেনে তিনি ছাত্রদের বললেন ,'লিয়া যাও চাবি, যেমনে যা লাগে যা মুঞ্চায় মাল ছামান নিয়া কামে নাইমমা পড়। খালি হক্কালে মঙে কইরা চাবিখান দিয়া গেলেই অইবো।' তখনও কিন্তু ছাত্ররা জানেন না, ২১ তারিখে টিয়ার গ্যাস থেকে বাঁচতে তারা যে ড্রামগুলোর পানি চোখেমুখে দিয়েছিলেন, সেই ড্রামগুলো রাখা হয়েছিল পিয়ারু সরদারের নির্দেশেই।
পিয়ারু সরদার চাবি বের করে তুলে দিলেন মেডিকেলের ছাত্র আসগরের হাতে। বললেন, 'শুধু মাল দিয়ে ক্যামতে কী? মিস্ত্রিও ভি লাগব।' ২ জন মিস্ত্রিকে ডেকে নিজেই বললেন, তারা যেন ছাত্রদের কাজে সহযোগিতা করে।
২৩ ফেব্রুয়ারি এক রাতের মধ্যেই গড়া হয় ঢাকায় একুশের প্রথম শহীদ মিনার। শহীদ মিনারের কাজ শেষ হয় ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোরে। সকালে শহীদ মিনারের অনানুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন শহীদ শফিউরের বাবা, আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় ২৬ ফেব্রুয়ারি আজাদের সম্পাদক আবুল কালার শামসুদ্দিনের হাতে।
শহীদ মিনার নির্মাণে এত সহযোগিতা করে পিয়ারু সর্দার কতটা সাহসিকতা দেখালেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনি তখন প্রাদেশিক সরকারের তালিকাভুক্ত ঠিকাদার। সহযোগিতার বিষয়টি জানাজানি হলে তার পাওনা বিল আটকে যেত, বাতিল হতে পারত ঠিকাদারির লাইসেন্সও। সঙ্গে জুটত ঠিকাদার হিসেবে কালো তালিকাভুক্ত হওয়া। এত ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও তিনি ছাত্র আন্দোলন এবং ভাষা আন্দোলনে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
২৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সেনাবাহিনী শহীদ মিনার ভেঙে ফেলে। পিয়ারু সরদার ও তার নির্মাণ প্রতিষ্ঠান পরে যুক্তফ্রন্ট সরকারের সময় প্রাদেশিক সরকারের অর্থায়নে নির্মিত প্রথম আনুষ্ঠানিক শহীদ মিনার নির্মাণের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। কিন্তু পরে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে কামানের গোলার আঘাতে সেই শহীদ মিনারও ভেঙে ফেলে পাকিস্তানি হানাদাররা।
কেবল ঢাকায় একুশের প্রথম শহীদ মিনারের সঙ্গেই যে পিয়ারু সরদারের সংশ্লিষ্টতা ছিল, তা কিন্তু না। ভাষা আন্দোলনের পরও মিছিল চলাকালীন ছাত্ররা পুলিশের সঙ্গে প্রায়ই সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তেন। পুলিশের তাড়া খেয়ে তখন ছাত্ররা পিয়ারু সরদারের মহল্লায় এসে আশ্রয় নিতেন। পিয়ারু সরদার তার মহল্লায় তল্লাশি থেকে পুলিশকে সরিয়ে রাখতেন, নিজেই সাহসিকতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতেন। পূর্ব পাকিস্তানে কমিউনিস্ট পার্টির জন্যও পিয়ারু সরদার ছিলেন এক অনন্য আশ্রয়। রণেশ দাশগুপ্ত, কমরেড ফরহাদ, মণি সিংহরা তার অবদানের কথা নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন। আইয়ুব খান, মোনায়েম খানের আমলে এনএসএফের কর্মীরাও তার এলাকায় ঢুকে কিছু করার সাহস পেত না।
পিয়ারু সরদার ছিলেন ঢাকার বেশ কয়েকটি এলাকার সরদার। পুরান ঢাকার হোসেনি দালান, উর্দু রোড থেকে নূরকাতা লেন হয়ে নাজিমউদ্দিন রোড, বকশিবাজার, আজিমপুর, পলাশী মহল্লার সরদার ছিলেন তিনি। তার তত্ত্বাবধানে ও দানে গড়ে উঠেছিল পুরান ঢাকার বেশ কয়েকটি এতিমখানা, মসজিদ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ছাত্র সংগঠন ছাত্র ফেডারেশনের অফিসও ছিল তার মহল্লায়।
ব্রিটিশ আমলে ঠিকাদারি শুরু করলেও পিয়ারু সরদারের ঠিকাদারিতে নাম ছড়িয়েছিল পাকিস্তান আমলে। ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশন থেকে রমনা পার্ক, রানি এলিজাবেথের মঞ্চ তৈরি, ভিক্টোরিয়া পার্কের নানা কাজ, আদমজী জুটমিল, আসাদ গেট, ঢাকা মেডিকেলের নার্সিং হোস্টেল নির্মাণ পিয়ারু সরদারের ঠিকাদারিতেই হয়েছিল। রানি এলিজাবেথের আগমন উপলক্ষে ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে তৎকালীন লাট ভবন (বর্তমানের বঙ্গভবন) পর্যন্ত দ্রুততম সময়ে নতুন রাস্তা নির্মাণেও পিয়ারু সরদারের ছিল অনন্য ভূমিকা।
পিয়ারু সরদারের জন্ম ১৮৯৩ সালে। তার বাবা মুন্নু সরদারও ছিলেন ঢাকার নামকরা সরদার। পিয়ারু সরদারের দায়িত্ব পেয়েছিলেন ১৯৪৪ সালে, ৫১ বছর বয়সে। এরপর টানা ১৭ বছর তিনি সরদার ছিলেন, ষাটের দশকে হয়েছিলেন কমিশনারও। পিয়ারু সরদার মারা যান ১৯৬১ সালের ৫ অক্টোবর। তার বংশধরদের মালিকানাধীন পিয়ারু সরদার অ্যান্ড সন্স ডেকোরেটর আজও জাতীয় ঈদগাহে নামাজের ব্যবস্থাপনা ও প্যান্ডেল নির্মাণের দায়িত্ব পেয়ে থাকে।
ওই সময় ঢাকার সরদারদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিলেন জুম্মন সরদার, মাজেদ সরদার, মওলা বক্স সরদার, মোতি সরদার, মির্জা কাদের সরদার আর পিয়ারু সরদার। কিন্তু ভাষা আন্দোলন আর ঢাকায় প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণে অসামান্য ভূমিকা পিয়ারু সরদারকে রাখবে এক অনন্য উচ্চতায়।
তথ্যসূত্র:
প্রথম শহিদ মিনার ও পিয়ারু সরদার/ সম্পাদক ড. আনিসুজ্জামান
Comments