বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সূচনা ২৫ মার্চ রাতেই

২৫ মার্চ কালরাতে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের প্রথম শিকার ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. ফজলুর রহমান খান।
জগন্নাথ হল গণহত্যায় শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ। ছবি: স্টার

'মিলিটারি যখন জগন্নাথ হলে গণহত্যা শুরু করল তখন আমরা হলের অ্যাসেম্বলির পেছনের জায়গায় গিয়া লুকাইলাম। কারণ ওইদিকটা আন্ধার ছিল। আমার স্বামীর কোলে আমার মেয়েটা ছিল। হঠাৎ একটা বাচ্চা কাঁইদা উঠল। তখন মিলিটারি টর্চ জ্বালাইয়া আমার স্বামীরে খুঁইজা পাইল। তারে টানটানি কইরা নিয়া যাওয়ার সময় আমি বললাম, তারে কই নিয়া যান? ওরা আমারে লাথি মেরে আমার মেয়েটারে ধাক্কা দিয়ে ফেলে আমার স্বামীকে নিয়ে গেল।

আমি তখন ওদের জিজ্ঞেস করলাম, উনাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? ওরা আমাকে লাথি মেরে সরিয়ে দিল। আমি তখন বেহুঁশ হয়ে গেলাম। আমার সঙ্গে থাকা বাকিরা আমার চোখে জল ছিটালে কিছুক্ষণ পর আমার হুঁশ ফিরে আসল। সঙ্গে থাকা বাকিরা কইল, লও আমরা গেইটের দিকে যাই। এরপর আমরা যহন গেটের দিকে গেলাম, দেখলাম হাউস টিউটর অনুদ্বৈপায়ন বাবুরে রাইফেলের বাঁট দিয়া মারতে মারতে নিয়া আসছে ওরা।

তার দুহাত পিছনের দিকে ধুতি দিয়া বান্ধা, পরনে আন্ডারওয়্যার। এরপর বাকিদের মতো তারেও মাঠের একপাশে দাঁড় করাল। উর্দুতে কী যেন জিজ্ঞেস করল। তিনিও উর্দুতে জবাব দিলেন। এর একটু পরেই আমি গুলির শব্দ শুনলাম।'

২৫ মার্চ কালরাতে অণুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যের শহীদ হওয়ার বর্ণনা দিতে গিয়ে দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিবেদককে এমনটাই বলেছিলেন জগন্নাথ হল গণহত্যার অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী বকুল রাণী দাস। অণুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক এবং জগন্নাথ হলের হাউস টিউটর।

২৫ মার্চ কালরাতে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের প্রথম শিকার ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. ফজলুর রহমান খান। ফজলুর রহমান খান থাকতেন নীলক্ষেতে বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায় শিক্ষকদের আবাসনে। তার স্ত্রী ফরিদা খানম ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক। তখন তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করছিলেন। দেশের বাইরে অবস্থান করায় প্রাণে বেঁচে যান তিনি।

রশীদ হায়দার সম্পাদিত 'স্মৃতিঃ ১৯৭১' এর প্রথম খণ্ডে ড. ফজলুর রহমান খানের চাচাতো ভাই আবদুল হান্নান ঠাকুর লিখেছেন, `তখন রাত বারোটা বিশ মিনিট। ভাইয়ের দরজায় বন্দুকের আঘাত। ভেঙে ফেলার উপক্রম। উর্দুতে গালাগালি, দরোজা খোলার হুঙ্কার। ভেতরে ভাই, কাঞ্চন, জবান। দরোজায় আঘাতের পর আঘাতে থাকতে না পেরে কাঞ্চন বলেছিল, ''মামা আমার ইউওটিসির ট্রেনিং আছে। সারেন্ডারের ভঙ্গিতে গিয়ে দরোজা খুলে দি, ওরা কিছু করবে না।''  ভাই তাকে ফেরাতে ব্যর্থ হলেন শেষবারের মতো। দরোজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে হায়েনারা রাইফেলের গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিল কাঞ্চনের বুক। সহ্য করতে না পেরে ভাই রেগে উচ্চকণ্ঠে বকতে শুরু করলেন। সঙ্গে সঙ্গে আবারো গর্জে উঠল হায়েনার বন্দুক। মুহূর্তে ঝাঁঝরা হয়ে গেল ভাইয়ের বুক। এতেও হায়েনারা তৃপ্ত না হয়ে বেয়োনেটে X চিহ্ন কেটে দিল ফজলু ভাইয়ের বুকে। ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে গেল দুটি তাজা প্রাণ। মৃত্যুর এই ভয়াবহ দৃশ্যটি প্রত্যক্ষ করেছিল জবান। পাশের বাথরুমের ভেতর থেকে।'

মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সূচনা হয়েছিল ২৫ মার্চ কালরাতেই। ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাজের নেতৃত্বে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সদস্যরা খুঁজে খুঁজে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল। ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধান লক্ষ্য ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া। কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই ছিল সব আন্দোলনের সূতিকাগার ও কেন্দ্রবিন্দু। ২৫ মার্চ কালরাত ও ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ৮ জন শিক্ষককে হত্যা করে। এ সময় আহত অবস্থায় কয়েকজন শিক্ষক প্রাণে বেঁচে যান।

২৫ মার্চ রাত ২টার দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এক ট্রুপস সেনা শহীদ মিনার এলাকায় অবস্থিত শিক্ষকদের আবাসিক কোয়ার্টারের ৩৪ নম্বর ভবনের এসে পৌঁছায়। এ সময় তারা লাথি মেরে ভবনের মূল গেট ভেঙে ফেলে। একজন পাকিস্তানি অফিসার হ্যান্ডমাইকে ৩ জন অধ্যাপকের নাম ঘোষণা করে তাদের বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসতে বলেন। এই ৩ জন হলেন পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক এ. এন. এম মুনীরউজ্জামান, দর্শন বিভাগের অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র দেব (জি সি দেব) এবং ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা।

অধ্যাপক জি সি দেব তখন এই ভবনে থাকতেন না। ভবনটির নিচতলায় থাকতেন অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা এবং ৩ তলায় থাকতেন অধ্যাপক এ. এন. এম মুনীরউজ্জামান। হ্যান্ডমাইকে ঘোষণার পরও তাদের কেউ না আসায় একজন পাকিস্তানি অফিসার নিচতলার রান্নাঘরের দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ে।

এ সময় শোবার ঘরে ঢুকে জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে দেখতে পেয়ে পাকিস্তানি অফিসার তাকে জিজ্ঞেস করে, 'আপ প্রফেসর সাহাব হ্যায়?' জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, 'ইয়েস'। অফিসার বলে, 'আপকো লে যায়েগা।' জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা জিজ্ঞেস করলেন, 'হোয়াই?' উত্তর দিল না সেই অফিসার। তাকে টেনে বাইরে নিয়ে যাওয়া হল।

এরইমধ্যে পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল সিঁড়ি দিয়ে ৩ তলায় উঠে এসে অধ্যাপক মুনীরুজ্জামানের ফ্ল্যাটে প্রবেশ করে। তখন নামাজ আদায় করে দোয়া পাঠ করছিলেন অধ্যাপক মুনীরুজ্জামান । হানাদার সেনারা ঘরে প্রবেশ করেই তার কাছে পরিচয় জানতে চায়। পরিচয় নিশ্চিত হওয়ায় পরে পাকিস্তানি সেনারা তাকে ও তার পরিবারের ৩ সদস্যকে নিচে নামিয়ে আনে।

নিচে নামিয়ে আনার পর পাকিস্তানি সেনারা মোট ৮টি গুলি করে। এরপর সেনারা কারফিউ জারির কথা ঘোষণা করে দ্রুত ট্রাক নিয়ে চলে যায়। তখন অধ্যাপক মুনীরউজ্জামানের স্ত্রী সৈয়দা মাহমুদা জামান ৩ তলা থেকে পানি নিয়ে এসে গুলিবিদ্ধ ৪ জনকে পান করান। তিনি দৌড়ে গিয়ে জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার স্ত্রী বাসন্তী গুহঠাকুরতাকে বললেন, 'আপনার স্বামী গুলিবিদ্ধ হয়ে বাইরে পড়ে আছেন, আমার সঙ্গে কথা বলেছেন, তিনি বাঁচবেন না।' তখন ২ জনই ছুটে এসে দেখেন, ততক্ষণে অধ্যাপক মুনীরউজ্জামান ও বাকিরা মারা গেলেও জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা জীবিত আছেন।

কিন্তু কারফিউর কারণে গুরুতর আহত জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে হাসপাতালে ভর্তি করা সম্ভব হয়নি। পরে ২৭ মার্চ সকালে তাকে মেডিকেলে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে কোনো চিকিৎসক ও লোকজন না থাকায় দায়িত্বরত নার্সরাই প্রাণপণ সেবা করে তার। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৩০ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা।

২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢাকা হলে (বর্তমানে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ হল) কামানের গোলাবর্ষণ শুরু করে। শহীদ হন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক আতাউর রহমান খান খাদিম। ওই সময় বেঁচে যান ঢাকা হলের সহকারী আবাসিক শিক্ষক গণিত বিভাগের প্রভাষক শরাফত আলী।

কামানের গোলার আঘাতে ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয় ঢাকা হল। শরাফত আলীদের আবাসে আগুন ধরে যায়। ভোরের দিকে শরাফত আলী চুপিসারে আগুন নেভাতে যান। এ সময় পাকিস্তানি সেনারা তাকে দেখতে পায় এবং বেয়নেট চার্জ করে ও গুলি করে হত্যা করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২ নম্বর ফুলার রোডের শিক্ষকদের একটি ভবনের নিচ তলায় থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল মুকতাদির। ভবনটির ৩ তলায় থাকতেন সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সায়েদ আলী নকী। ২৫ মার্চ রাতে গোলাগুলি শুরু হলে আবদুল মুকতাদির তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে অধ্যাপক নকীর বাসায় আশ্রয় নেন। ভোর ৬টার দিকে ১০-১৫ জন হানাদার সেনা বাড়ির সামনে এসে বাসিন্দাদের নিচে নেমে আসতে বলে।

অধ্যাপক নকী নিচে নেমে আসেন। হঠাৎ ৪-৫ জন সেনা অধ্যাপক নকীর সঙ্গে ৩ তলায় উঠে আসেন। একজন সেনা এ সময় আবদুল মুকতাদিরকে লক্ষ্য করে 'তুম জয় বাংলা বলতা, পাকিস্তান নেহি চাহতা' বলে চিৎকার করে তার বুকে ও পেটে গুলি করে। এ সময় তার স্ত্রী প্রাণভিক্ষা চাইলে তাকে ধাক্কা মেরে ওই বাড়ির আরও একজনকে গুলি করে হত্যা করে হানাদার সেনারা। এমন সময় অধ্যাপক সায়েদ আলী নকীর মেয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলে হানাদার সেনারা তাকে হত্যা না করেই চলে যায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের সামনে একতলা একটি কোয়ার্টারে থাকতেন দর্শন বিভাগের প্রখ্যাত অধ্যাপক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব (জি সি দেব)। গোবিন্দ চন্দ্র দেবের সঙ্গে আরও থাকতেন তার পালিত মেয়ে রোকেয়া সুলতানা এবং রোকেয়ার স্বামী। ২৫ মার্চ রাতে তুমুল গুলিবর্ষণে ঝাঁঝরা হয়ে যায় তাদের বাড়িটি। উত্তেজনায় সেই রাতে বেশ কয়েকবার মূর্ছা যান গোবিন্দ দেব। শেষরাতের দিকে গুলিবর্ষণের এক পর্যায়ে হ্যান্ডমাইকে হানাদার সেনারা আত্মসমর্পণ করতে বলতে থাকে।

ভোরের দিকে গুলির আওয়াজ কমে আসে। সারারাত জেগে থাকার কারণে ক্লান্তিতে নুয়ে পড়েছিলেন গোবিন্দ দেব। তিনি মেয়েকে বলেন, 'উপাসনার সময় হয়েছে, একটু স্থান করে দে, মা'। রোকেয়া সুলতানা উপাসনার জায়গা করে দিলেন, চা বানিয়ে দিলেন। হঠাৎ দরজায় আঘাত পড়ল। হানাদার সেনারা বলল, 'মালাউন কা বাচ্চা দরওয়াজা খোল দো'।

উঠে দাঁড়ালেন গোবিন্দ দেব। এ সময় তাকে বসিয়ে দিলেন রোকেয়া। দরজায় তখনো লাথির পর লাথি পড়ছে। রোকেয়ার স্বামী উঠে গিয়ে দরজা খুলতে যেতেই লাথির আঘাতে দরজা ভেঙে পড়ল। হানাদারদের গুলিতে শহীদ হলেন রোকেয়ার স্বামী মোহাম্মদ আলী। এমন সময় শান্তভাবে অধ্যাপক জি সি দেব বললেন, 'বাবারা, কী চাও এখানে?' হানাদার সেনারা ব্রাশফায়ার শুরু করে। জি সি দেবের মাথায় ২টি গুলি বিদ্ধ হয়। গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় তার বুক।

২৫ মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ৮ জন শিক্ষককে পৈশাচিকভাবে হত্যার মধ্য দিয়েই মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সূচনা করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।

 তথ্যসূত্র:

স্মৃতিঃ ১৯৭১ প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড/ রশীদ হায়দার

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণহত্যা: ১৯৭১ জগন্নাথ হল/ সম্পাদনা- রতনলাল চক্রবর্তী

Comments

The Daily Star  | English

Chattogram city condemned to waterlogging

It is often said that if we hurt Mother Nature, we end up hurting ourselves. This saying could not be truer than in the case of Chattogram, the commercial capital of Bangladesh, during monsoons, when it goes under water for the most part.

5h ago
X