অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়: বাংলার ইতিহাসচর্চার পথিকৃৎ
অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় মাতৃভূমির ইতিহাস সাধনায় সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে বাংলার ইতিহাসচর্চার তিনিই পথিকৃৎ। ১৯ শতকের শেষ দশক এবং ২০ শতকের প্রথম তিন-দশক অক্ষয়কুমার ছিলেন বৃহৎ বাংলার প্রধান ইতিহাসবিদ। তিনি দীর্ঘ ৬১ বছর রাজশাহীতে বসবাস করে বাংলার ইতিহাস লেখাসহ বহুমাত্রিক সমাজদরদী কাজ করেছেন।
তিনি যেমন ছিলেন রাজশাহীর প্রাণ, তেমনি রাজশাহীও ছিল তার প্রাণের চেয়েও বেশি কিছু। লেখক শ্রীভবানীগোবিন্দ চৌধুরী যথার্থই বলেছেন, 'রাজশাহীতে যাহা কিছু অক্ষয়, তাহাতেই অক্ষয়কুমার ছিলেন' (ভারতবর্ষ, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, বৈশাখ, ১৩৩৭,পৃষ্ঠা- ৮২৫)।
১৯৩০ সালে ১০ ফেব্রুয়ারি অক্ষয়কুমার রাজশাহী শহরে মৃত্যুবরণ করেন। আজ তার ৯৪তম মৃত্যুবার্ষিকী।
অক্ষয়কুমার ১৮৬১ সালের ১ মার্চ কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে মামা ভগবানচন্দ্র মজুমদারের বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। অক্ষয়কুমারের বাবা ইংরেজির শিক্ষক মথুরানাথ মৈত্রেয় ছিলেন সাহিত্যসেবক গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ 'গ্রামবার্তা প্রকাশিকা' পত্রিকার সম্পাদক কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। হরিনাথই অক্ষয়কুমারের নামকরণ করেন এবং তিনিই তার সাহিত্য পথের গুরু। কুমারখালিতে হরিনাথের বঙ্গবিদ্যালয়ে অক্ষয়কুমারের বাল্যশিক্ষার সূচনা হয়। অক্ষয়কুমারের বাবা সরকারি কর্মসূত্রে ১৮৬২ সালে রাজশাহীর জজকোর্টে চাকরিতে যোগদানের মাধ্যমে স্থায়ীভাবে বসতি গড়েন রাজশাহীর মহানগরীর ঘোড়ামারায়।
অক্ষয়কুমার ১৮৭৮ সালে রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল থেকে প্রবেশিকা, ১৮৮০ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে এফএ পাশ করেন। দুই পরীক্ষাতে রাজশাহী বিভাগের মধ্যে প্রথম হন। এরপর ১৮৮৩ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএ, ১৮৮৫ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে বিএল পাশ করেন এবং ওই বছরই আইনজীবী হিসেবে রাজশাহী কোর্টে যোগদান করেন। ৭০ বছর বয়সে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে অক্ষয়কুমার এই পেশায় জড়িত ছিলেন।
অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তিন-দশক নিবিড়-বন্ধুত্বে একসঙ্গে বহুমাত্রিক বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিভিন্ন লেখায় বন্ধুপ্রতীম ইতিহাসবিদ অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়কে বাংলার শ্রেষ্ঠ ইতিহাসবিদ ও লেখক হিসেবে সগৌরবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। বলেছেন, 'অক্ষয়কুমার আমাদের দেশের একজন প্রধান লেখক' (ভারতী, কলকাতা, শ্রাবণ ১৩০৫); 'তিনি আধুনিক বাঙ্গালী ইতিহাস লেখকগণের শীর্ষ-স্থানীয়' (ভারতী, আষাঢ় ১৩০৫); 'বাঙ্গালা ইতিহাসে তিনি যে স্বাধীনতার যুগ প্রবর্তন করিয়াছেন সেজন্য তিনি বঙ্গসাহিত্যে ধন্য হইয়া থাকিবেন' (ভারতী, শ্রাবণ ১৩০৫)।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়ের ইতিহাস সাধনার এমনই অনুরাগী হয়ে পড়েন যে, শান্তিনিকেতন থেকে ১৬ ভাদ্র ১৩০৯ তারিখে অক্ষয়কুমারকে লেখা চিঠিতে বলেন, 'আপনি ওকালতিটা ছাড়ুন। চুপচাপ বসিয়া পড়ুন। মাঠের কোণে আসিয়া কুটীর বাঁধুন। তারপরে হবিষ্যান্ন খাইয়া খাগড়ার কলম ধরিয়া তালপাতে ভারতবর্ষের ইতিহাসকথা লিপিবদ্ধ করুন, ত্রিশ কোটি নরনারীর আশীর্বাদভাজন হইবেন।'
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহযোগিতা ও পরামর্শে অক্ষয়কুমার ১৮৯৯ সালে ৫ জানুয়ারি রাজশাহী মহানগরীর ঘোড়ামারার নিজ বাসভবন 'অক্ষয় নিকেতন' থেকে প্রকাশ করেন ইতিহাসভিত্তিক ত্রৈমাসিক পত্রিকা 'ঐতিহাসিক চিত্র'। এটিই বাংলার প্রথম ইতিহাসভিত্তিক পত্রিকা।
অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় প্রায় ৩০০ প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও বহু গ্রন্থ রচনা করে বাংলার ইতিহাসচর্চা ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেন। ব্রিটিশবিরোধী 'স্বদেশী আন্দোলন'কে জাগিয়ে তোলেন। তার লেখা প্রকাশ হতো সাহিত্য, ভারতী, বঙ্গদর্শন, সাধনা, প্রবাসী, রঙ্গপুর-সাহিত্য-পত্রিকা, মানসী, ঢাকা রিভিউ, মানসী ও মর্মবাণী, প্রাচী, বঙ্গবাণী, ভারতবর্ষ, দ্য মডার্ন রিভিউ, দ্য জার্নাল অব দ্য এশিয়াটিক সোসাইটি, দ্য রূপম, দ্য বেঙ্গল পাস্ট অ্যান্ড প্রেজেন্ট ইত্যাদি পত্রিকায়।
অক্ষয়কুমারের প্রকাশিত বইগুলো হচ্ছে- বঙ্গবিজয়, সমরসিংহ, সীতারাম রায়, সিরাজদ্দৌলা, Gauda, under the Hindus, মীর কাসিম, ময়না (নাটক), গৌড়লেখমালা, রমাপ্রসাদ চন্দ প্রণীত গৌড়রাজমালা (সম্পাদনা), ফিরিঙ্গি বণিক, অজ্ঞেয়-বাদ, A short history of Natore Raj। অক্ষয়কুমারের মৃত্যুর পর প্রকাশিত বইগুলো হচ্ছে- রাণী ভবানী, গৌড়ের কথা, সাগরিকা, ভারতশিল্পের কথা, উত্তরবঙ্গের পুরাতত্ত্ব সংগ্রহ, Ancient Monuments of VarendraÕ, ÔThe Fall of Pala Empire, আবাহন (নাটক)। অক্ষয়কুমারের শ্রেষ্ঠ বই 'সিরাজদ্দৌলা'। এই বই লিখে তিনি সত্যনির্ভর ইতিহাসের পথ-নির্মাণের পথিকৃৎ হয়েছেন, বাঙালি জাতিকে দায়মুক্তি দিয়েছেন। অক্ষয়কুমার সম্পাদিত রমাপ্রসাদ চন্দ প্রণীত 'গৌড়রাজমালা' আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত প্রণালীতে লিখিত বাংলার প্রথম ইতিহাস হিসেবে ইতিহাসবিদ স্বীকৃত। কবিগুরুও এই বই পড়ে অভিভূত হন।
অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়ের ইতিহাস সাধনা ও তার সমাজহিতৈষী মনোভাবে মুগ্ধ হয়েছেন দেশ-বিদেশের বহু পণ্ডিত ও প্রতিষ্ঠান। অক্ষয়কুমারের গুণমুগ্ধ ছিলেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, নেতাজি সুভাসচন্দ্র বসু, কংগ্রেস সভাপতি সরোজিনী নাইডু, মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, বিশ্বখ্যাত ইতিহাসবিদ ভি ভি স্মিথ, কাঙাল হরিনাথ মজুমদার, স্যার জন মার্শাল, স্যার আশুতোশ মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহারানি হেমন্তকুমারী, নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ, নাটোর দিঘাপতিয়ার রাজা প্রমদানাথ রায়, কবি রজনীকান্ত সেন, কবি নজরুল ইসলাম, ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদার ও নলিনীকান্ত ভট্টশালীসহ বহু বিখ্যাত মানুষ।
মরমি সাধক মহাত্মা ফকির লালন সাঁইয়ের পরমপ্রীতি লাভে ধন্য হয়েছেন অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়। কুমারখালীর কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের কুণ্ডুপাড়ার বাড়িতে লালন সাঁইয়ের সঙ্গে অক্ষয়কুমারের পরিচয় ঘটে ১৮৮০ সালে, গ্রীষ্মের এক সকালে। অক্ষয়কুমারের বয়স তখন ১৯। হরিনাথের বাড়িতে অক্ষয়কুমারের সামনেই লালন সাঁই গান গেয়েছেন। লালন সাঁইয়ের গানের প্রভাবে তৎক্ষণাৎ অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়ের চিন্তায় আসে একটি বাউল দল গঠনের কথা। অক্ষয়কুমারের প্রস্তাবে ওই সময়েই কাঙাল হরিনাথ মজুমদার গঠন করেন 'ফিকিরচাঁদ ফকিরের দল' বা 'ফিকিরচাঁদ বাউল দল' নামে এক বাউল দল। বাংলায় এই দলের বিপুল খ্যাতি হয়।
অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়ের অক্ষয়কীর্তি রাজশাহীর 'বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম'। ১৯১০ সালে ২৭ সেপ্টেম্বর নাটোর দিঘাপতিয়ার রাজপুত্র কুমার শরৎকুমার রায় গঠন করেন বরেন্দ্র-অনুসন্ধান-সমিতি এবং এই সমিতিই পরে প্রতিষ্ঠা করে বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম। সমিতির মাধ্যমে অক্ষয়কুমারের পরিচালনায় বেসরকারি উদ্যোগে বাংলার প্রথম প্রত্নস্থল খনন হয় রাজশাহীর গোদাগাড়ীর দেওপাড়া ইউনিয়নে ধ্বংসপ্রাপ্ত 'পদুম-সহর মন্দির' অঙ্গনে, ১৯১১ সালের শীতের মৌসুমে। তিনি নওগাঁর মাহিসন্তোষ, পাহাড়পুর মহাবিহারসহ বরেন্দ্রের বহু প্রত্নস্থল খননের স্থপতি। কুমার শরৎকুমার রায়ের অর্থায়নে অক্ষয়কুমারের পরিচালনায় পাঁচ বছর মেয়াদী পাহাড়পুর মহাবিহার খনন কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় ১৯২৩ সালের ১ মার্চ। অক্ষয়কুমার দুই-দশক বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়ামের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অমূল্য প্রত্নসম্পদ সংগ্রহ ও সঞ্চয় করে গেছেন।
লেখক: উপ-রেজিস্ট্রার, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
Comments