সাধারণ মানুষের প্রতি শেখ রাসেলের ছিল প্রগাঢ় ভালোবাসা

শেখ রাসেল। ছবি: সংগৃহীত

বয়সে অনেক ছোট হলেও শেখ রাসেলের হৃদয়টা ছিল অনেক বড় ও উদার। বিশেষ করে সাধারণ মানুষের প্রতি ছিল তার প্রগাঢ় ভালোবাসা। শিশু বয়সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর মানসিকতা ছিল তার মধ্যে।

তার শিশু সুলভ সমস্ত আচরণ বা কর্মকাণ্ডের মধ্যে কেবলই সরলতা নয়, আদর্শিক ও দার্শনিক একটা ভাবও ছিল। এমনকি কোনো বিষয়ে কঠিন অবস্থানে থাকলেও, যুক্তি দিয়ে তাকে বশ করানো যেত।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ সন্তান শেখ রাসেলকে নিয়ে এই মন্তব্য করেছেন, তার (রাসেল) গৃহশিক্ষক গীতালি চক্রবর্ত্তী (দাসগুপ্তা)। ১৯৭২ সালের আগস্ট থেকে ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট পর্যন্ত রাসেলের গৃহশিক্ষক ছিলেন তিনি।

গীতালি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর দ্বিতীয় বর্ষের বাঙলা বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। বর্তমানে তিনি পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে বসবাস করছেন। এর আগে বাংলাদেশের বিভিন্ন কলেজে অধ্যাপনা করে ২০০৫ সালে অবসরে যান গীতালি।

শেখ রাসেলকে নিয়ে দীর্ঘদিনের জমে থাকা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তিনি টেলিফোনে কথা বলেছেন বাসসের সঙ্গে। তবে, গীতালি আগেই জানিয়ে দেন, শেখ রাসেল ও তার সম্পর্কটা ছিল এক বিচিত্র সুরে বাঁধা। সেখানে প্রচলিত সুর-তাল-লয় বা ছন্দের বালাই ছিল না। ছিল নিত্য নব আনন্দের ও গভীর ভালোবাসার অনুরণিত অনুরাগ। 'ওর সম্পর্কে আমার মুখে বলা যত সহজ, লেখা তত সহজ নয়। অনুভব গভীর হলে, ভাষা সেখানে অসহায়', বলেন শেখ রাসেলের এই শিক্ষক।

সাধারণ মানুষের প্রতি রাসেলের কেমন ভালোবাসা ও দায়িত্ব বোধ ছিল তার একটি ঘটনা সবিস্তারে তুলে ধরেছেন গীতালী।

তিনি বলেন, 'তখন শীতের দিন। ৩২ নম্বরের পাশের বাড়িতে রাসেল নামে আরেকটি শিশু ছিল। রাসেল প্রায় সময় তার সঙ্গে খেলতো। একদিন এক বুড়ি (প্রবীণ নারী) পাশের বাড়িতে ভিক্ষা করতে আসেন। এ সময় বাড়ি থেকে বলা হয়, ভিক্ষা নয়, বাড়ির কি একটা কাজ করে দিলে ১ টাকা দেওয়া হবে। বুড়িটি রাজি হন। কিন্তু কাজ শেষ হওয়ার পর বুড়িকে মাত্র ২৫ পয়সা প্রদান করা হয়। এতে তিনি কান্নাকাটি করতে করতে ওই বাড়ি থেকে বের হয়ে আসেন। এ ঘটনা কিশোর রাসেলের মনে সাংঘাতিক দাগ কাটে এবং কষ্ট দেয়। রাসেল সেই বুড়িমাকে পরম যত্নে তুলে এনে গেটের সামনে বসিয়ে রাখেন। বলেন, আব্বা (বঙ্গবন্ধু) আসলে কথা বলিয়ে দিবেন। বিচার চাইতে হবে। তিনি বিচার করে দেবেন। দুপুরে তাকে খাবারও দেওয়া হয়। এ দিকে শীতে বুড়িমার জবুথুবু অবস্থা। কখন কি হয়, বলা যায় না। কিন্তু রাসেলের এক কথা, আব্বা আসলে বিচার হবে। তারপর বুড়িমা যাবেন। পরে রাসেলকে প্রস্তাব দেওয়া হয়, বুড়িকে যদি রাতের খাবার এবং আরও বেশি টাকা দেওয়া হয়, তাহলে ছেড়ে দেওয়া যাবে কি না। সম্ভবত বেশি টাকা দেওয়া হবে, এই প্রস্তাবে শেখ রাসেল রাজি হয় তাকে ছেড়ে দিতে। তবে, আব্বা আসলে বুড়ির পক্ষ থেকে এ অনিয়মের প্রতিকার চেয়ে বিচার চাওয়া হবে বলে জানান দিয়ে রাখে সে।'

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট কালরাতে বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে ঘাতকের নির্মম বুলেট মাত্র ১১ বছরেই কেড়ে নিয়েছিল ইতিহাসের মহাশিশু শেখ রাসেলের প্রাণ। মৃত্যুর আগে আল্লাহর দোহাই দিয়ে না মারার জন্য খুনিদের কাছে আর্তি জানিয়েছিলেন শেখ রাসেল। সেদিন রাসেলের এই আর্তচিৎকারে স্রষ্টার আরশ কেঁপে উঠলেও, টলাতে পারেনি খুনি পাষাণদের মন।

গীতালি রাসেলকে আদর করে ডাকতেন বুঁচু। রাসেল তার শিক্ষককে সম্বোধন করতেন আপা, আপু এবং শেষ দিকে আপুমনি বলে। তিনি বলেন, ১৯৭২ জুলাই বা আগস্ট মাস থেকে ছোট্ট রাসেলকে ৩২ নম্বর ধানমন্ডিতেই পড়াতে  যেতেন। অবশ্য অল্প কিছুদিন গণভবনেও পড়িয়েছেন। সবশেষ পঁচাত্তরের ১৪ আগস্ট পড়িয়েছেন। এ দিনেই ছিল রাসেলকে পড়ানোর শেষ দিন। এ দিন রাত ১১টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত তিনি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনে ছিলেন। পরের দিন আর সুযোগ হয়নি পড়ানোর। কারণ, সেদিন কাল রাতে বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যের মতো এই নিষ্পাপ শিশুকেও ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা হয়।

এ দিন সন্ধ্যার আগে গীতালি যখন বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে পড়াতে যান, তখন রাসেল বাড়িতে ছিলেন না। মায়ের সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিলেন। গীতালি একা একা অপেক্ষা করছিলেন। একটা সময় চলে যাওয়ার কথাও ভাবেন। এমন সময় বঙ্গবন্ধু ওপরে এসে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলে উঠেন, 'মাস্টার তুই একা কেন। ছাত্র কোথায়?' বঙ্গবন্ধু গীতালিকে মাস্টার বলে ডাকতেন। রাসেল বাড়িতে নেই শুনে তিনি গীতালিকে নিচে বঙ্গবন্ধুর গাড়ি আছে, তাতে করে চলে যাওয়ার কথা বলেন। তখন রমা বলেন, রাসেল আপুকে থাকতে বলেছেন। এসে পড়বে। বঙ্গবন্ধু তখন ফোন করে জেনে নেন এবং গীতালিকে আবার উচ্চস্বরে বলেন, 'মাস্টার তোমার ছুটি নাই। তোমার ছাত্র আসতেছে।'

গীতালি সাধারণত বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠা কন্যা শেখ রেহানার ঘরেই রাসেলকে পড়াতেন। সবসময় তালা দেওয়া থাকে এমন একটি কক্ষেও রাসেলকে পড়িয়েছিলেন তিনি। তবে, শেষ পড়ানোটা হয়েছিল সম্ভবত শেখ রেহানার কক্ষে। পড়তে এসেই রাসেল আপুকে জানায়, 'ওদিনতো কোক খাইতে দেন নাই। আইজ কোকটা আনি। জামাল ভাই খাইতে পারে নাই।' কোল্ড ড্রিংকস বিশেষ করে কোকের প্রতি রাসেলের ছিল সাংঘাতিক দুর্বলতা। প্রতিদিন একটি করে কোক তার জন্য বরাদ্দ থাকতো। তবে, প্রতিদিন যাতে রাসেল কোক না খায় সে ব্যাপারে চেষ্টা করতেন গীতালি। বুঝাতেন, কোকে দাঁত নষ্ট হয়ে যায়। আরও অনেক ক্ষতি হয়। পরে সিদ্ধান্ত হলো, প্রতিদিন খাওয়া হবে না। যেদিন খাবেন অর্ধেক। পরের দিকে দেখা যেতো, ফ্রিজে কোক থাকতো না। শেখ জামাল ফ্রিজে রাখা রাসেলের জন্য বরাদ্দকৃত কোক কখনো কখনো খেয়ে ফেলতেন। এ নিয়ে রাসেল 'জামাল ভাইয়া তার কোক খেয়ে ফেলেন', এমন অনুযোগ করতেন আপুর (গীতালি) কাছে। একসময় জামাল ভাইয়ের কোক খাওয়া বন্ধের জন্য অভিনব এক পন্থা আবিষ্কার করে রাসেল। নিচে নেমে লাউ গাছের বড় পাতা এনে, তা দিয়ে ঢেকে রাখতেন কোকের বোতল। যাতে শেখ জামাল তা দেখতে না পান।

না, সেদিন রাসেলকে কোকটা খেতে দেওয়া হয়নি। পরের দিন খাওয়ার কথা বলা হয়। পড়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরেন তারা। তবে, কোক খাওয়া না হলেও  শাস্তি হিসেবে দুটো কানমলা খেতে হয়েছিল রাসেলকে। কানমলা ও কানধরে উঠবস করার শাস্তিটাও কিন্তু রাসেল নিজেই নির্ধারণ করেছিলেন। তবে, কথা ছিল শাস্তির সময় দরজা বন্ধ থাকবে, বড়রা যাতে কেউ না দেখে।

গীতালি বলেন, রাসেল যখন নিজেই নিজেকে কানমলা দিত, তখন কান লাল হয়ে যেতো। কখনো ফাঁকি দিতে চাইতো না। এ জন্য গীতালিই বেশির ভাগ কান মলে দিতেন। পচাঁত্তরের ১৪ আগস্টের এ রাতেও অংক ভুল করে রাসেল। এ জন্য কানমলা না কানধরে উঠবস করতে হবে, জানতে চায় রাসেল। গীতালি বলেন, তিনি নিজেই কানমলা দেবেন। রাসেল তখন হাসতে হাসতে বলে, 'আপনার কান মলাতো পিপড়ার কামড়ের মতো। কোনো ব্যাথাই পাওয়া যায় না।'

গীতালি জানান, এ দিন তিনি মোট দুটো কানমলা দিয়েছিলেন রাসেলকে। রাত সাড়ে ১১টায় তিনি বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে রওনা দেন। সে রাতে তিনি ৭ নম্বর মিন্টুরোডে তার জ্যাঠা, তখনকার খাদ্যমন্ত্রী ফণিভূষণ মজুমদারের বাসায় অবস্থান করেন। ৩২ নম্বর ছাড়ার আগে কোনোভাবেই বুঝতে পারেননি, এ বাড়িতে তার পদচিহ্ন আর পরবে না। রাসেলেরও আর জীবনে কোক খাওয়া হবে না। রাসেলকে কোক খেতে না দেওয়ার এই মর্মবেদনা সারা জীবন বয়ে যেতে হবে।

গীতালি বলেন, 'একদিন, বুঁচুকে ৫টি অংক দেওয়া হয় করার জন্য। অংকে ছিল ওর ভীষণ অনীহা। ৫টা অংক দেওয়ার পর সে যখন করেছিল, তখন একটা অংক সাহায্য নিয়ে করা হয়েছিল বলে তিনি রাসেলকে আরও একটা অংক দেন। এতে বুঁচু ক্ষেপে গিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। একটু পরে সে মাকে সঙ্গে করে পড়ার ঘরে এলো। ঘরে ঢুকেই কাকীমা (বঙ্গমাতা) খুব রাগের সুরে গীতালিকে বললেন, "কি রে তুই না কি রাসেলকে ৫টা অংক করার কথা বলে ৬টা অংক দিছিস?" বলেই, একটা চোখ টিপ দিলেন। এরপর বললেন, "এ রকম আর করবি না কখনও।" আমিও মুখ ভার করে মন খারাপ করে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম। রাসেলের যখন পড়তে ইচ্ছে করত না, তখন পড়ার জন্য জোর করলেই বলত, "কাল থিকা আপনি আর আসবেন না, আমি আপনার কাছে আর পড়ব না। আমিও ওর মতো মুখের ভাব করে বলতাম, আচ্ছা আর আসব না। তবে, আজ যখন আসছি তখন কষ্ট করে একটু পড়। কাল থেকে আর আসব না। সেও বলত, "আসবেন না।"'

তিনি বলেন, 'এরপরের ঘটনা আরও মজার ছিল। আসার সময় আমি সেই সিরিয়াস মুখ করে কাকীমাকে গিয়ে বলতাম, কাকীমা কাল থেকে আর পড়াতে আসছি না, আজই শেষ। বলেই কাকীমাকে প্রণাম করে ফেলতাম। রাসেল এ সময় কাকীমার শাড়ির ভেতরে লেপটে থাকত। ব্যাস, শাড়ির ভেতর থেকে রাসেল কাকীকে ঠেলত আর বলত, "মা আসতে বল কালকে, আসতে বল।"'

একদিন শেখ রেহানার ঘরে রাসেলকে পড়াচ্ছিলেন গীতালি। পড়ার মাঝখানে চা-জলখাবার দিতেন রমা বা ফরিদ। তারা ২ জনই বেশিরভাগ সময় চা-খাবারটা দিতেন। চায়ের সঙ্গে যে দিন মিষ্টি থাকতো, সেদিন শুধু চাই খেতেন গীতালি। মাঝে মাঝে মিষ্টি খেয়ে নিতেন। হঠাৎ পড়তে পড়তে রাসেল জিজ্ঞেস করলো, 'আপা, আপনি একদিনও মিষ্টি খান না কেন?' গীতালি বলেন, 'কেন, খাইতো।' জবাবে রাসেল বলে, 'মাঝে মাঝে খান। রোজ মিষ্টি খান না কেন?'  গীতালি বলেন, 'আমি মিষ্টি পছন্দ করি না যে, তাই খাই না।' রাসেলেরও তাৎক্ষণিক জবাব, 'আমিও তো পড়তে পছন্দ করি না, তবে আমারে রোজ রোজ পড়ান ক্যান?'

পড়ার সঙ্গে মিষ্টি খাওয়ার সম্পর্ক জানতে চাইলে দুঠোঁটে দুষ্টুমির মিষ্টি হাসি দিয়ে হাতের কাঠ পেন্সিলটা দুআঙুলের ফাঁকে, সেটা ডানে-বামে দুলিয়ে দুলিয়ে সম্পর্ক আছে বলে জানায় রাসেল। এ সময় রাসেল রমাকে মিষ্টির প্লেটটা নিতে মানা করে বলে, 'আপা মিষ্টি খাবে, তুই মিষ্টি নিবি না।' মিষ্টিটা নিয়ে যাওয়ার কথা বলতেই বলে, 'আপনি মিষ্টি পছন্দ করেন না বলে মিষ্টি খান না, আমিও তো পড়তে পছন্দ করি না। তবে আমিও পড়বো না।' এ কথা বলেই, হাতের কাঠ পেন্সিলটা টেবিলের ওপর রেখে বই বন্ধ করে দেয় রাসেল। এর আগে পড়ালেখা কে আবিষ্কার করেছে, তা নিয়ে ছিল তার রীতিমত গবেষণা। তাকে পাওয়া গেলে রীতিমত মারার হুমকিও দিতেন রাসেল।
 

Comments

The Daily Star  | English

Rampal fouling 2 Sundarbans rivers

The Rampal power plant began operation in late 2022 without an effluent treatment plant and has since been discharging untreated waste into the Pasur and Maidara rivers next to the Sundarbans.

4h ago