বাংলা চলচ্চিত্রের মুকুটহীন নবাব আনোয়ার হোসেন
নিজের অভিনয় জীবন নিয়ে স্মৃতিচারণায় বলেছিলেন, বালকবেলায় স্কুলের নাটকে অভিনয় করতে গিয়েই অভিনয়ের প্রতি আমার আসক্তি। এরপর তখনকার রূপালী জগতের তারকা ছবি বিশ্বাস, কানন দেবী- এদের বিভিন্ন ছবি দেখতে দেখতেই রূপালী জগতে আসার ইচ্ছাটি প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে ওঠে। ৫০ দশকের শেষের দিকে সিদ্ধান্ত নিলাম অভিনয় করব সারাজীবন। সুতরাং অন্য কোনো জীবিকার সন্ধান না করে সরাসরি চলে গেলাম পরিচালক মহিউদ্দিন সাহেবের কাছে। তিনি তখন 'মাটির পাহাড়' নামে একটি সিনেমার কাজ করছিলেন। তাকে ধরলাম আমাকে নেওয়ার জন্য। তিনি জানালেন, ছবিতে অভিনয়শিল্পী নির্বাচনের কাজ শেষ। ফলে আমাকে নেওয়া যাচ্ছে না আপাতত। ৫৮ সালে শুরু করলেন 'তোমার আমার' সিনেমার কাজ। এখানে আমাকে নির্বাচন করা হলো খলনায়ক চরিত্রে। আমার রুপালি পর্দায় অভিষেক হলো ভিলেন হিসেবে।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে শক্তিমান অভিনয়শিল্পীর তালিকায় তিনি থাকবেন সর্বাগ্রে। ঢাকাই চলচ্চিত্রে যিনি হয়ে উঠেছিলেন 'মুকুটহীন নবাব'।
কোন ধাঁচের চলচ্চিত্রে নেই আনোয়ার হোসেন? ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, নাট্যধর্মী, লোককাহিনীভিত্তিক, পোশাকি ফ্যান্টাসি, সাহিত্যনির্ভর, শিশুতোষ, পারিবারিক মেলোড্রামা ও বক্তব্যধর্মী- সব চলচ্চিত্রেই ছিল তার শীর্ষস্থান।
আনোয়ার হোসেনের অভিনয়ে হাতেখড়ি হয়েছিল স্কুলজীবনেই। স্কুলে থাকতে প্রথম অভিনয় করেছিলেন আসকার ইবনে সাইকের 'পদক্ষেপ' নাটকে। সেসময়েই একে একে অভিনয় করেছিলেন বেশ কয়েকটি মঞ্চনাটকে। ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে পড়ার সময়েও বাদ যায়নি তার অভিনয় প্রতিভা। তার অভিনয়সত্ত্বায় মুগ্ধ হয়েছিলেন সহপাঠী এবং শিক্ষকরাও।
১৯৫৭ সাল। জামালপুর ও ময়মনসিংহ ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন তরুণ আনোয়ার হোসেন। ঢাকা বেতারের 'নওফেল হাতেম' নাটকে মিলেছিল তার প্রথম অভিনয়ের সুযোগ। যে বছর ঢাকায় এলেন, সে বছরই বিয়ে করেছিলেন তিনি। একই বছর চলচ্চিত্রকার মহিউদ্দিনের সঙ্গে আনোয়ার হোসেনকে পরিচয় করিয়ে দেন মহিউদ্দিনের সহকারী মোহাম্মদ আনিস। কথার এক ফাঁকে আনোয়ার হোসেনকে একপ্রকার যাচাই করে নেন মহিউদ্দিন। 'তোমার আমার' চলচ্চিত্রে অভিনয়ের বিপরীতে আনোয়ার হোসেন পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন ৩০০ টাকা।
এর মধ্যদিয়ে চলচ্চিত্রে অভিষেক হয়েছিল আনোয়ার হোসেনের। সালাউদ্দীনের 'সূর্যস্নান' চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি এলেন লাইমলাইটে। কিন্তু তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল জহির রায়হানের বিখ্যাত 'কাচের দেয়াল' চলচ্চিত্রে দুর্ধর্ষ অভিনয়। যে চলচ্চিত্রে অনন্য শক্তিমান অভিনয় জানান দিলো বাংলা চলচ্চিত্রে নতুন নবাবের আগমন ঘটেছে।
১৯৬৭ সাল। বিক্ষুব্ধ এক সময়ে মুক্তি পেল খান আতাউর রহমান পরিচালিত চলচ্চিত্র 'নবাব সিরাজউদ্দৌলা'। যে চলচ্চিত্রে নবাব সিরাজউদ্দৌলা চরিত্রে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন আনোয়ার হোসেন। প্রতিকূলতার সাক্ষী সে সময়ে আনোয়ার হোসেন যেন হাজির হলেন স্বাধীনতার অবতার হয়ে। পুনর্জন্ম হলো যেন বাংলার সর্বশেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার।
মানুষের আবেগ উথলে উঠলো। যে চলচ্চিত্রে আমরা পর্দার নবাব সিরাজউদ্দৌলার, তথা আনোয়ার হোসেনের গলায় পরাজয়ের মুখে শুনতে পাই 'গোলাম হোসেন, আমি আবার সৈন্য সংগ্রহ করব, আবার যুদ্ধ করব, এই জন্মে না পারি, জন্ম-জন্মান্তরে এই কলঙ্ক আমরা দূর করব'। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ বাংলার স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা যেন আবির্ভূত হন নতুনরূপে।
নবাব সিরাজউদ্দৌলা চলচ্চিত্রে আনোয়ার হোসেনের অভিনয় যিনি একবার দেখেছেন, তিনিই স্বীকার করতে বাধ্য বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে মুকুটহীন সম্রাট একজনই। এই চলচ্চিত্রের জন্য আনোয়ার হোসেন পেয়েছিলেন পাকিস্তানের চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বিখ্যাত নিগার পুরস্কার।
পরের বছরই মুক্তি পেয়েছিল 'সাত ভাই চম্পা' চলচ্চিত্র। 'সুলেমানপুরের বাদশাহ' চরিত্রে আনোয়ার হোসেনের অভিনয় ছিল চিরন্তন মুগ্ধতার।
১৯৭০ সালে মুক্তি পাওয়া 'জীবন থেকে নেয়া'-কে বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র বলা হয়। যে চলচ্চিত্রে আনোয়ার হোসেন অভিনয় করেছিলেন সচেতন জনপ্রিয় এক রাজনৈতিক নেতার চরিত্রে।
মুক্তিযুদ্ধের পরের বছর মুক্তি পায় সুভাষ দত্তের বিখ্যাত চলচ্চিত্র 'অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী'। সেই চলচ্চিত্রের দৃশ্যে আমরা দেখি- প্রত্যন্ত এক গ্রামে এসেছে চলচ্চিত্র শুটিংয়ের দল। চলচ্চিত্রের নায়ক আনোয়ার হোসেন। চলচ্চিত্রের শুটিং দেখতে ভিড় করে রোমেনা, আসাদ ও গ্রামের অনেকেই। সেখানে অভিনেতা আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে আলাপ হয় রোমেনা ও আসাদের।
মুক্তিযুদ্ধের দৃশ্যপট ভেসে উঠে আমাদের সামনে। রোমেনাকে পাকিস্তানি হানাদাররা ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সঙ্গে হত্যা করে তার বাবা-মাকে। একসময় বন্দিশিবির থেকে পালিয়ে এসে আত্মহত্যা করতে চায় রোমেনা।
বন্দি আনোয়ার হোসেন দেখেন নির্যাতন আর বিভীষিকার দৃশ্য। একসময় তাকে নিরীহ মানুষ মনে করে ছেড়ে দেয় হানাদাররা। ক্লান্ত-বিধ্বস্ত অভিনেতা আনোয়ার হোসেন সিদ্ধান্ত নেন যুদ্ধ করবেন। কিন্তু তাও সম্ভব হয় না। অভিনেতা আনোয়ার হোসেন উপলব্ধি করেন চলচ্চিত্রে বীরত্বের অভিনয় করা হয়তো সহজ। কিন্তু বাস্তব জীবনে বীর হওয়া প্রচণ্ড কঠিন। 'অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী' চলচ্চিত্রে আনোয়ার হোসেনের অভিনয় দাগ কেটে গেছে কোটি মানুষের মনে।
আনোয়ার হোসেন অভিনয় করেছেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসের বিখ্যাত সব চলচ্চিত্রে। আলমগীর কবিরের 'ধীরে বহে মেঘনা', 'রুপালী সৈকতে', নারায়ণ ঘোষ মিতার 'লাঠিয়াল', আমজাদ হোসেনের 'নয়নমণি', 'গোলাপী এখন ট্রেনে' এবং 'ভাত দে'। 'ভাত দে' চলচ্চিত্র ছিল বিশ্বখ্যাত কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রথম প্রদর্শিত কোনো বাংলাদেশি চলচ্চিত্র। যে চলচ্চিত্রে আনোয়ার হোসেন অভিনয় করেছিলেন 'সাইজুদ্দিন বয়াতি' চরিত্রে। আমজাদ হোসেনের শ্রেষ্ঠ ৩ চলচ্চিত্রের প্রতিটিতেই অভিনয় করেছিলেন আনোয়ার হোসেন।
বাংলাদেশে অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে আনোয়ার হোসেনই সর্বপ্রথম একুশে পদক পেয়েছিলেন। সালটা ছিল ১৯৮৮। আবার আনোয়ার হোসেনই সর্বপ্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারজয়ী অভিনেতা।
চলচ্চিত্রে চরিত্রের প্রয়োজনে আনোয়ার হোসেন কখনও ভেঙেছেন, কখনও গড়েছেন। চলচ্চিত্রে নায়কের চরিত্রে তিনি যেমন ছিলেন দুর্ধর্ষ, ঠিক তেমনই ভিন্ন চরিত্রের অভিনয়েও দেখিয়েছেন মুন্সিয়ানা। আনোয়ার হোসেন যেন অষ্টধাতুতে গড়া এক প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা। যিনি অভিনয়কেই মিলিয়ে নিয়েছেন জীবনের সঙ্গে।
বেঁচে থাকলে আজ ৯২ বছরে পা দিতেন আনোয়ার হোসেন। আনোয়ার হোসেন হয়তো চলে গেছেন শারীরিকভাবে, কিন্তু রেখে গেছেন তার অভিনয়ের এক স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায়। যা তাকে স্মরণ করিয়ে দেবে যুগের পর যুগ ধরে। বাংলা চলচ্চিত্রের 'মুকুটহীন নবাব' অভিনয়ের মধ্যদিয়েই বেঁচে থাকবেন বাংলার মানুষের মনে।
সূত্র:
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র চলচ্চিত্রে বাংলাদেশ/আহমেদ আমিনুল ইসলাম
Comments