সাধারণের মানসপটে যেভাবে মূর্ত হলেন জাতির বীরশ্রেষ্ঠরা

একটি সাধারণ ক্যানভাস পেপারের ওপর আঁকা জাতির চিরকালের নায়কদের প্রথম পোর্ট্রেট। শিল্পী: শেখ আফজাল

১৯৮০ সালের শুরুর দিকের কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শাহনেওয়াজ ছাত্রাবাসের ১৬ নম্বর কক্ষে নিবিষ্ট মনে কয়েকজন অদেখা শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পোর্ট্রেট আঁকার কাজ করছেন ঢাকা আর্ট কলেজের চূড়ান্ত বর্ষের শিক্ষার্থী শেখ আফজাল।

সেদিন যাদের পোর্ট্রেট আফজাল আঁকছিলেন তারা কেমন দেখতে ছিলেন, কেমন ছিল তাদের অবয়ব—সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না ২১/২২ বছরের ওই তরুণের।

এক্ষেত্রে ওই তরুণ শিল্পীর একমাত্র সহায় ছিল শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের জীর্ণ-মলিন কিছু ফটোগ্রাফ। সেসব আবছা ফটোগ্রাফ থেকে ধারণা নিয়ে খুব সাবধানে, পরম মমতায় একটি সাধারণ ক্যানভাস পেপারে একে একে সবার চেহারা ফুটিয়ে তুললেন তিনি।

কাজটি সহজ ছিল না মোটেও। রঙ-তুলিতে সেদিন যাদের অবয়ব দিয়েছিলেন আফজাল, তারাও সাধারণ কেউ ছিলেন না।

যুদ্ধক্ষেত্রে অসামান্য শৌর্য আর বীরত্বের নিদর্শন রেখে নিশ্চিত জেনেও স্থির প্রত্যয়ে মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছিলেন আফজালের ছবির ওই চরিত্ররা। তারা ছিলেন একাত্তরের জনযুদ্ধে আত্মত্যাগের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি হিসেবে মরণোত্তর বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত সাত জন।

১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা গেজেট আকারে প্রকাশ করে সরকার। এরপর থেকে দীর্ঘদিন পর্যন্ত সাত বীরশ্রেষ্ঠ'র মুখচ্ছবি সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত ছিল না।

চিত্রশিল্পী শেখ আফজাল। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে। ছবি: মামুনুর রশীদ/স্টার

যুদ্ধ শেষ হওয়ার ৯ বছর পর ১৯৮০ সালের ১৬ ডিসেম্বর সাপ্তাহিক বিচিত্রা প্রথমবারের মতো প্রকাশ করে বীরশ্রেষ্ঠদের মুখচ্ছবি। কোলাজ আকারে তেলরঙে আঁকা শেখ আফজালের কালজয়ী ওই পোস্টারটিই পরবর্তীতে হয়ে ওঠে বাঙালির চিরকালের এই নায়কদের চিনে নেওয়ার একমাত্র মাধ্যম।

এরপর দেশ ও দেশের বাইরে জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের যত প্রতিকৃতি আঁকা হয়েছে, ম্যুরাল কিংবা ভাস্কর্য তৈরি হয়েছে, তার সবগুলোতেই পাওয়া যায় শেখ আফজালের আঁকা সেসব মুখচ্ছবিরই ছাপ।

এই সাত বীরশ্রেষ্ঠ'র মধ্যে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর, সিপাহি হামিদুর রহমান, সিপাহি মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল, ল্যান্সনায়েক মুন্সি আব্দুর রউফ, মোহাম্মদ রুহুল আমিন ও ল্যান্সনায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ বাংলাদেশের মাটিতে হানাদারদের বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে প্রাণ দেন। আর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণে শহীদ হন পশ্চিম রণাঙ্গনে।

যুদ্ধ শেষ হওয়ার প্রায় এক দশক পর নানা উপায়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে জোগাড় করা জীর্ণ-মলিন ফটোগ্রাফ থেকে এই বীরদের প্রকৃত চেহারা উদ্ধারের কাজটি ছিল দুরূহ। তখন এ সংক্রান্ত প্রযুক্তিও সহজলভ্য ছিল না। এক্ষেত্রে ওইসব ছেঁড়া-ফাটা ফটোগ্রাফ থেকে প্রতিকৃতি অর্থাৎ পোর্ট্রেট আঁকার কাজটি শেখ আফজাল দারুণভাবেই করেছিলেন।

ঠিক কোন পরিপ্রেক্ষিতে ও কী প্রক্রিয়ায় বীরশ্রেষ্ঠদের ছবি সংগ্রহ এবং তাদের পোর্ট্রেট আঁকা ও পরিচিতি তৈরির কাজটি করা হয়েছিল, তার সুলুক সন্ধানে নেমেছিল দ্য ডেইলি স্টার। এর অংশ হিসেবে ডেইলি স্টার কথা বলেছে শিল্পী রকিফুন নবী ও শেখ আফজাল এবং সাপ্তাহিক বিচিত্রার তখনকার নির্বাহী সম্পাদক ও লেখক শাহরিয়ার কবিরের সঙ্গে; সাহায্য নিয়েছে এ সংক্রান্ত বিভিন্ন বইপত্র ও নথির। এতে সবমিলিয়ে যে গল্পটি তৈরি হয়েছে তা এরকম—

তখন সাপ্তাহিক বিচিত্রায় কার্টুনিস্ট হিসেবে কাজ করতেন তখনকার ঢাকা আর্ট কলেজের শিক্ষক ও শিল্পী রফিকুন নবী, যিনি রনবী নামেই সর্বজন সমাদৃত। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক নিযুক্ত হওয়া নন্দিত এ শিল্পী জানান, বিচিত্রার সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী ছিলেন তার বন্ধু। ক্যালেন্ডার কিংবা অন্য কোনো প্রকাশনায় ব্যবহারের জন্য ১৯৮০ সালের শুরুর দিকে সাত বীরশ্রেষ্ঠর পোর্ট্রেটের খোঁজে শাহাদত চৌধুরীর কাছে এসেছিলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।

কালজয়ী ‘টোকাই’ চরিত্রের স্রষ্টা চিত্রশিল্পী রফিকুন নবী। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের পোর্ট্রেট আঁকার জন্য শেখ আফজালকে বেছে নিয়েছিলেন তিনিই। ছবি: মামুনুর রশীদ/স্টার

দ্য ডেইলি স্টারকে রনবী বলেন, 'গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের জাফরুল্লাহ চৌধুরী এটা চেয়েছিলেন। তিনি এসেছিলেন শাহাদত চৌধুরীকে ধরে। আমি বললাম, "আমি তো পোর্ট্রেট ওভাবে করি না। আমার ছাত্র আছে শেখ আফজাল। ও পোর্ট্রেট ভালো করতে পারে। যেহেতু তোমাদের অত পয়সাকড়ি নাই। তাই বড় আর্টিস্টদের কাছে আমি তোমাদের রেফার করতে পারব না"।'

এ অবস্থায় বীরশ্রেষ্ঠদের পোর্ট্রেট আঁকার দায়িত্ব শেখ আফজালকেই দেওয়া হয় জানিয়ে রফিকুন নবী বলেন, 'যে ছবিগুলো থেকে পোস্টারটি করা হয়েছিল, সেগুলোর বেশিরভাগের অবস্থা ছিল খুব খারাপ। মুন্সি আবদুর রউফসহ বেশিরভাগের ছবি বোঝা যাচ্ছিল না। আবছা আবছা। সেখান থেকে এগুলো উদ্ধার করেছিল শেখ আফজাল।

'এটা অনেক কঠিন একটা কাজ ছিল। বীরশ্রেষ্ঠদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে যদি আবার খারাপ কিছু হয়, তাহলে সেটা সমালোচিত হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা ছিল। আবার এটাও মনে ছিল—যে পোর্ট্রেটগুলো আঁকা হচ্ছে সেগুলো কারেকশন করে যে চেহারা দাঁড়াবে সেটাই ফাইনাল হয়ে যাবে। পরে সবাই সেটা ব্যবহার করবে।'

শেখ আফজালের মুখে পোর্ট্রেট আঁকার গল্প

আশির দশকের শুরুতে ঢাকা আর্ট কলেজের শিক্ষার্থী শেখ আফজাল এখন নাম বদলে যাওয়া চারুকলা অনুষদের অঙ্কন ও চিত্রায়ন বিভাগের অধ্যাপক।

সেই সময়ের স্মৃতিচারণা করে ডেইলি স্টারকে এই শিল্পী বলেন, 'একদিন হঠাৎ নবী স্যার আমাকে ডেকে বললেন, "শাহাদত একটা কাজ দিয়েছে। বীরশ্রেষ্ঠদের পেইন্টিং দিয়ে একটা পোস্টার বানাও।" এটা বলে আমাকে ছবি (ফটোগ্রাফ) দিলেন সাতটা।'

বিচিত্রা অফিসে শাহাদত চৌধুরীর টেবিলে রাখা সেই পোস্টার। সঙ্গে শাহরিয়ার কবির। ছবি: শাহাদত চৌধুরী স্মারকগ্রন্থ থেকে নেওয়া

খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আঁকার কাজ হয়ে গিয়েছিল জানিয়ে শেখ আফজাল আরও বলেন, 'সম্ভবত গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে ওটা চাওয়া হয়েছিল। একটা ক্যানভাসের ভেতরেই সাতটা পোর্ট্রেট কম্পোজ করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন নবী স্যার। আমি ওভাবেই করেছিলাম। খুব সাবধানে দায়িত্ব নিয়ে কাজটি করতে হয়েছিল। আঁকার কাজ হয়ে গেলে স্যারকে এনে দেখালাম। উনি দেখে বললেন, "চলো তোমাকে বিচিত্রায় নিয়ে যাই।"'

শিল্পী বলতে থাকেন, 'তখন নবী স্যারের লাল রঙের একটা গাড়ি ছিল। মাঝেমধ্যে এদিক-ওদিক গেলে নবী স্যার আমাদের ওই গাড়িতে চড়াতেন। ছবিটা পেছনে রেখে আমি স্যারের সঙ্গে গাড়িতে বসলাম। রঙ তখনো শুকায়নি। ওটা বোধহয় খুব তাড়াতাড়ি দরকার ছিল। পরে শাহাদত ভাই দেখে বললেন, "ঠিক আছে।"'

শেখ আফজাল জানান, তার শিল্পী পরিচয় তৈরিতে বীরশ্রেষ্ঠদের পোর্ট্রেট দিয়ে করা এই পোস্টারটি দারুণ ভূমিকা রেখেছে। সেইসঙ্গে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নিয়ে কাজ করতে পারার একটা ‍তৃপ্তিও কাজ করে তার ভেতর।

তিনি বলেন, 'প্রথমে আমি বুঝতে পারিনি যে এটা এত গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ হয়ে উঠবে। তখন ছাত্র ছিলাম। মাথায় অতকিছু আসেওনি। এটা ছাপা হওয়ার পর দেখা গেল সাংঘাতিক একটা ব্যাপার ঘটে গেছে। সারাদেশের সব প্রতিষ্ঠানে এই পোস্টার ঝুলছে। আর্ট এক্সিবিশনের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গিয়েছি। সেখানেও দেখি ওই পোস্টার। অ্যাম্বাসিগুলোতেও ঝুলছে।'

কাজটি করে কত টাকা পেয়েছিলেন সেটা মনে করতে পারেননি এই শিল্পী। এ বিষয়ে তিনি বলেন, 'এই কাজের জন্য টাকাটা কোনো বিষয়ই ছিল না আমার কাছে। এক্ষেত্রে আবেগ ও মমতাই কাজ করেছে বেশি। মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান ও দেশের একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে বীরশ্রেষ্ঠদের পোর্ট্রেট আঁকার সুযোগ পাওয়াটাই অনেক বড় একটা ব্যাপার ছিল। তার ওপর কাজটি দিয়েছিলেন নবী স্যার। সুতরাং এই কাজে নিজের সর্বোচ্চটা দেওয়ার কোনো বিকল্প ছিল না আমার কাছে।'

শাহাদত চৌধুরীর বয়ানে বীরশ্রেষ্ঠদের ছবি সংগ্রহের ইতিহাস

১৯৮০ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রা তাদের 'স্বরূপ-অন্বেষা' সিরিজে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বীরদের 'গৌরব পুনঃস্থাপন' প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যায় বলেছিল, 'বাংলাদেশ ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ স্মৃতির বিলাপে দাঁড়াবে না—দাঁড়াবে ইতিহাসের শিক্ষায়, ইতিহাসের সিদ্ধান্তে। সেই ইতিহাস থেকেই বুঝে নিতে হবে যে ইতিহাস উদাস বাউল নয়, ইতিহাস কথা বলে। প্রয়োজন নেই শুধু স্মৃতির, প্রয়োজন নেই বীর-বন্দনার। কিন্তু বীর অস্তিত্বের অবস্থান নির্ণয়ের ওপর নির্ভর একটি জাতীর স্বরূপ।'

শেখ আফজালের আঁকা চিত্র অবলম্বনে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ গ্রন্থের প্রচ্ছদ।

পোর্ট্রেট করার জন্য বীরশ্রেষ্ঠদের ছবিগুলো কীভাবে সংগ্রহ করা হলো, তার একটি বর্ণনা পাওয়া যায় শহীদ জননী জাহানারা ইমামের 'বীরশ্রেষ্ঠ' গ্রন্থের ভূমিকার অংশে। এই বইটির প্রচ্ছদ করা হয়েছিল শেখ আফজালের আঁকা বীরশ্রেষ্ঠদের ওই পোস্টারটি দিয়ে।

এর ভূমিকার অংশটি লিখেছিলেন বিচিত্রার সম্পাদক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত শাহাদত চৌধুরী। তিনি সেখানে বলেন, 'শোণিতে নক্ষত্র জ্বেলে যারা আমাদের পথ দেখিয়েছেন—নিজেরা ঘরে ফিরতে পারেননি—সেই অপরাজেয় বীরশ্রেষ্ঠদের লাল ফিতার বন্ধন থেকে মুক্ত করে আলোয় আনার কৃতিত্ব বিচিত্রার। বিচিত্রা এই উদ্যোগ নেয় ১৯৮০ সালের প্রথম থেকে। বিচিত্রার পক্ষে আমি সরকারি দপ্তরে দপ্তরে ঘুরে কাগজপত্র সন্ধান করি। কোথাও কিছু পাওয়া যায়নি। কিন্তু সবচেয়ে বেশি সহায়তা পাই বাংলাদেশ আর্মির কাছ থেকে।

'সেই সময়ে সিলেটের স্কুল অব ইনফ্যান্ট্রি অ্যান্ড ট্যাক্টিকসের কমান্ডান্ট ব্রিগেডিয়ার আমিন আহমদ চৌধুরী উৎসাহ প্রদান করেন। তিনি স্কুলের প্রয়োজনে অন্তত বীরশ্রেষ্ঠদের বীরত্বের কাহিনী উদ্ধার করবেন বলে কথা দেন। সেই সময়কার বাংলাদেশ আর্মির এ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল মঈন হোসেন চৌধুরী দেন বীরশ্রেষ্ঠদের গ্রামের বাড়ি ও জীবিত উত্তরাধিকারীদের ঠিকানা।'

বিচিত্রা সম্পাদক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহাদত চৌধুরী। প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

ভূমিকার এ অংশে শাহাদত চৌধুরী জানান, বীরশ্রেষ্ঠদের কয়েকজনের ছবি সংগ্রহ করে দেন লে. কর্নেল ইমাদুজ্জামান। তিনি সে সময় ছিলেন স্টাফ কলেজের ছাত্র। বিচিত্রা ৮০ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রকাশ করে বীরশ্রেষ্ঠদের পরিচিতি ও ছবি। এর দেড় বছর পর মেজর কামরুল হাসান ভূঞা অসাধ্য সাধন করে সাত জন বীরশ্রেষ্ঠর যুদ্ধ, গৌরব ও আত্মত্যাগের ঘটনা লিপিবদ্ধ করেন। স্পটে গিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রের নকশা তৈরি করেন। এটা বিচিত্রায় ছাপা হয় ১৯৮২ সালের ২৬ মার্চ সংখ্যায়।

সে সময়ের কথা স্মরণ করে বিচিত্রার তখনকার নির্বাহী সম্পাদক, লেখক ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা শাহরিয়ার কবির ডেইলি স্টারকে বলেন, '১৯৭২ সালে একগুচ্ছ তরুণ মুক্তিযোদ্ধা—যারা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে এসেছেন—যারা সাংবাদিক, যাদের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা ছিল তারা এই পত্রিকাটি বের করলেন। শুরু থেকেই বিচিত্রা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটাকে তুলে ধরার একটি বহুমাত্রিক উদ্যোগ নিয়েছিল। এর পাশাপাশি একটা নতুন দেশ গড়ার যে বিষয়গুলো ছিল—অর্থনৈতিক অগ্রগতি, উন্নয়ন ও এর ভিশনগুলো ঠিক কেমন হবে, সেগুলো মানুষের সামনে তুলে ধরাই ছিল আমাদের প্রধান লক্ষ্য, যেটা হয়তো ওই ৯ মাসের যুদ্ধের সময় ব্যাখ্যা করা যায়নি।'

বিচিত্রার সাবেক নির্বাহী সম্পাদক ও লেখক শাহরিয়ার কবির। ছবি: মামুনুর রশীদ/স্টার

শাহরিয়ার কবির বলেন, 'আমরা প্রথম থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে স্বাধীনতা বিরোধীদের প্রকৃত ছবি আমরা কম ছাপব। রিয়েল ছবির বদলে কার্টুন ছাপব এদের। আরেকটা হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের পোর্ট্রেট ছাপব।'

১৯৯৭ সালের ৩১ অক্টোবর শেষ সংখ্যাটি প্রকাশ হওয়ার আগ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রতিকূল সময়েও একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিরুদ্ধাচরণের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ইতিহাস মাঠ পর্যায় থেকে তুলে আনা, সেক্টর কমান্ডারদের টেস্টিমনি (আত্মকথন) প্রকাশ করা এবং যুদ্ধের বিভিন্ন গৌরবগাঁথা ও গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনের গল্প বিচিত্রা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করে এসেছে।

সেসব কথা স্মরণ করে শাহরিয়ার কবির আরও বলেন, 'আমরা মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বের কথাগুলো যেমন প্রকাশ করতে শুরু করলাম, তেমন তুলে ধরলাম নারী নির্যাতন ও গণহত্যার মতো ত্যাগের বিষয়গুলোও। আমরা বলেছি বাঙালির কয়েক হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন হচ্ছে একাত্তর এবং মুক্তিযুদ্ধের বিশাল বিজয়। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা বীরশ্রেষ্ঠদের সম্মানিত করেছি।'

বীরশ্রেষ্ঠদের ছবি সংগ্রহ ও পোর্ট্রেট আঁকার কাজ শুরুর প্রসঙ্গে শাহরিয়ার কবিরের ভাষ্য, 'আশির দশকের শুরুতে (শহীদ জননী) জাহানারা ইমাম যখন বিচিত্রার সঙ্গে যুক্ত হলেন, তখন তাকে আমরা বীরশ্রেষ্ঠদের নিয়ে লেখার জন্য বলেছিলাম। যদিও প্রথম খসড়াটা উনি লিখতে পারেননি। তখন আমরা বীরশ্রেষ্ঠদের কোনো ফটোগ্রাফ পাচ্ছিলাম না। যেগুলো ছিল সেগুলো ঠিক প্রেজেন্টেবল ছিল না। তাই তাদের ছবি সংগ্রহ করে পোর্ট্রেট আঁকার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।'

Comments

The Daily Star  | English

Rampal fouling 2 Sundarbans rivers

The Rampal power plant began operation in late 2022 without an effluent treatment plant and has since been discharging untreated waste into the Pasur and Maidara rivers next to the Sundarbans.

4h ago