বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে ঈদের ভূমিকা
![](https://tds-images-bn.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/images/2024/06/16/emran_bhai_bangla_web.jpg?itok=Uxjaymk5×tamp=1718522418)
অর্থনৈতিক, সামাজিক প্রেক্ষাপটে ঈদুল আজহার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এর মাধ্যমে সামাজিক-সাংস্কৃতিক উপাদানের বিস্তারণ ঘটে। সবার প্রতি সমান অধিকারের বিধান ইসলাম ধর্মে আছে। ধর্মীয় মূল্যবোধ ও আদর্শ চর্চার পথ সুগম করার উপায় এটি। সমাজে স্থিতিশীলতা ও বৈষম্য দূর করার পন্থা। কিন্তু বর্তমানে একটি সুষম সমাজ বিনির্মাণে ঈদুল আজহা কতটা অবদান রাখছে—সে বিষয়টি প্রশ্নসাপেক্ষ।
ঈদ মানেই আনন্দ। মুসলমানগণ আত্মশুদ্ধির প্রক্রিয়া হিসেবে বিভিন্ন রীতি অনুশীলন করে থাকেন। ঈদ তার মধ্যে অন্যতম। এ আনন্দ ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয় বরং সামাজিক। আর ঈদের উৎসবও সার্বজনীন। তাই ঈদের আনন্দ-উৎসবে সব মুসলিমের অধিকার আছে। ঈদ ও আজহা দুটিই আরবি শব্দ। ঈদ এর অর্থ উৎসব বা আনন্দ। আজহার অর্থ ত্যাগ বা উৎসর্গ করা। আর এজন্যই কোরবানির ঈদকে 'ঈদুল আজহা'বলা হয়। অন্যদিকে 'কোরবানি' শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো নৈকট্য অর্জন করা, কারও কাছাকাছি যাওয়া।
মুসলমানদের আদি পিতা হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু হয়ে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। মহান আল্লাহ এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলেন, 'আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানির বিধান নির্ধারণ করে দিয়েছি, যাতে তারা ওই পশুদের জবাই করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। আর তোমাদের প্রতিপালক তো এক আল্লাহই, তোমরা তারই অনুগত হও।' (সুরা হজ : ৩৪)। মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.) ও তার পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.) এর ঐতিহাসিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কোরবানি ইবাদতের মর্যাদা লাভ করেছে। আল্লাহ ইবরাহিম (আ.)-কে পরীক্ষা করার জন্য স্বীয় পুত্রকে কোরবানি করতে বললেন, তখন কোনো সংশয় তথা বিনা প্রশ্নে নিজ স্নেহাস্পদ সন্তানকে কোরবানি করার জন্য প্রস্তুত হন। কিন্তু আল্লাহর আদেশে দুম্বা কোরবানি হয়ে যায়। তারপর থেকে পশু কোরবানির রেওয়াজ চালু হয়। মানবজাতিকে একনিষ্ঠ শিক্ষা দেয়াই হলো এর মর্মার্থ।
'ভোগে নয়, ত্যাগেই সুখ'—এই নীতি কোরবানির মাধ্যমে পরিস্ফুট হয়। বৃহত্তর জনকল্যাণে ব্যক্তিস্বার্থ বিলিয়ে দেয়ার শিক্ষা দেয় এই কোরবানি। ত্যাগ ও ব্যক্তিস্বার্থ বিসর্জন দেয়া ব্যতীত সমাজ ও সভ্যতা বিনির্মাণ সম্ভব হয়নি কোনোকালে। প্রতীকী কোরবানি হিংসা-বিদ্বেষ ও ভেদাভেদের দেয়ালের কালো পাথর চূর্ণ করতে সম্প্রীতি ও সহনশীল শিক্ষা দেয়—শোষণমুক্ত সমাজ গঠনে তা কার্যকর ভূমিকা রাখে। ত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত প্রতিবছর ঈদুল আজহা আমাদের মাঝে ফিরে আসে। স্বার্থপরতা পরিহার করে মানবতার কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করা কোরবানির মহান শিক্ষা। মানবিক মূল্যবোধে উদ্ভাসিত ঈদুল আজহা হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-ক্রোধকে পরিহার করে সমাজে শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় আত্মনিবেদিত হতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করে।
ঈদুল আজহা সমাজের মানুষের হৃদয়ে আত্মত্যাগের শিক্ষাকে প্রোথিত করে মানবিক মূল্যবোধ জাগিয়ে বিশেষ অনুপ্রেরণা দিয়ে থাকে। প্রতিবছর ঈদ মুসলমানদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করে পারস্পরিক ভালোবাসা ও সম্প্রতির সংযোগ-মোহনায় দাঁড় করিয়ে সামাজিক মানবতাবোধের শক্তিতে বলীয়ান করে। কোরবানি মুসলমানদের সব কর্মের উদ্দেশ্য ও নিয়ত সম্পর্কে সুস্পষ্টতা দেয়।
ঈদুল আজহার সঙ্গে আর্থসামাজিক উন্নয়নেরও বিশেষ সম্পর্কও পরিলক্ষিত হয়। কোরবানি ঈদকে কেন্দ্র করে দেশের নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ ও খামার ব্যবসায়ীরা বিশেষ পুঁজি বিনিয়োগ করে। শুধু ঈদ পূর্ববর্তী এক সপ্তাহে পশু ও কোরবানির সরঞ্জামাদি ক্রয়-বিক্রয় ও পশু পরিবহন ইত্যাদি খাতে দেশে কয়েক কোটি টাকা লেনদেন হয়। বিত্তবান মুসলমানদের দান-সদকার মাধ্যমে বিশাল অঙ্কের অর্থ নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে হাতবদল হয়। ফলে দেশের অর্থনীতির গতি সঞ্চারিত হয়।
অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের উপাদান হিসেবে ঈদুল আজহার গুরুত্ব রয়েছে। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ঈদের দিন একে অপরের সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেয়। তাদের মধ্যে দৃঢ়-ভ্রাতৃত্বের বন্ধন তৈরি হয়। এই দিনটি তাই ধনী-গরিব সকলে মিলেই পালন করে থাকে। তারা একে অপরকে সালাম প্রদান ও শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। প্রতিবেশীর বাড়িতে যান। তাদের খোঁজ-খবর নেন। তারা তাদের নিকটতম এবং প্রিয়জনদেরও খোঁজ-খবর নেন ।
তারা একে অপরকে ভালো খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করেন। ভাতৃত্ববোধ ও জাতীয় ঐক্য গড়া ঈদের প্রধান শিক্ষা। ঈদুল আজহা আমাদেরকে ত্যাগ ও কুরবানির আদর্শে উজ্জীবিত করার পাশাপাশি অর্থনৈতিক শোষণ ও বৈষম্য দূর করে একটি তাকওয়াভিত্তিক সমাজ গঠনের অনুপ্রেরণা দেয়। আমরা যদি বাস্তব জীবনে ইসলামী আদর্শ অনুসরণ করে সমাজে ন্যায় ও ইনসাফ কায়েম করতে পারি তাহলেই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা সম্ভব হবে।
ঈদুল আজহা অনেক সময় আমাদের মধ্যে লৌকিকতায় রূপ নেয়। সমাজের কিছু মানুষ লোক দেখানোর জন্য কোরবানির নামে বাহাজ করে। কে কত বেশি টাকার কোরবানি দিয়ে নাম কামাই করবে—তা নিয়ে উন্মাত্ততায় লিপ্ত হয়। এতে করে কোরবানির সৌহাদ্যপূর্ণ পরিবেশ বিঘ্নিত হয়। অনেকেই আত্মীয়-স্বজন, গরিব-অসহায়দের কোরবানির মাংস বিলিয়ে না দিয়ে ফ্রিজে সব মাংস ভরে রাখে। তাতে যোজন দূরে থাকে বিত্তহীনদের হক। কোরবানির নামে এমন পরিহাসে বৈষম্যমূলক সমাজের চিত্র ফুটে ওঠে। কতিপয় মানুষ গরিব মানুষের অধিকার আদায় না করে ঈদের আনন্দ করতে দেশ ছেড়ে পাড়ি জমান বিলাসবহুল দেশে।
ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য ঈদ উৎসবের ঐক্য-ভাতৃত্ববোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। ঈদের উৎসব উদযাপনের জন্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা উৎসব ভাতা পেলেও দিনমুজুর, রিকশাচালকসহ নিম্ন আয়ের অনেক মানুষ এসব ভাতা-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। অধিকন্তু অন্যান্য পেশার লোকজন কয়েক দিন ঈদের ছুটি ভোগ করতে পারলেও কৃষক-দিনমুজুরদের কাজ করতে হয় উৎসবের দিনেও। এদিকে ঈদের আগে বেতন-বোনাস না পাওয়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অনেক শ্রমিক-কর্মচারী ও তাদের পরিবারের ঈদ উৎসবকে ম্লান করে। এছাড়া নন-এমপিও শিক্ষক এবং বেকারদের ঈদ উৎসবের আনন্দ উপভোগ অপূর্ণ থাকে। অন্যদিকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার বন্দি এবং নিপীড়িত নেতাকর্মীদের পরিবারের ঈদ কাটে নিরানন্দে।
এছাড়া হত্যা-খুন-গুম হওয়া পরিবারে ঈদ আনন্দের পরিবর্তে বেদনা নিয়ে আসে। প্রিয়জনদের অনুপস্থিতিতে ঈদের আনন্দ-উল্লাসে তাদের কষ্টের মাত্রা আরও বাড়ে। অধিকন্তু ঈদ পূর্বাপর দুর্ঘটনা ও সহিংসতায় নিহত-আহতদের পরিবারে ঈদের আনন্দের পরিবর্তে বিষাদের ছায়া নেমে আসে। আর ঈদকেন্দ্রিক চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই-রাহাজানি, প্রতারণা-জালিয়াতির ভুক্তভোগীদের ঈদ কাটে চরম দুঃখে। প্রতিবছর দেখা যায় ঈদের আগে কল-কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। শ্রমিকেরা বেতন-ভাতার জন্য আন্দোলনে নামে। চরম দারিদ্র্য-ক্লিষ্ট জনগণের জীবনে নেমে আসে বিষাদের ছায়া।
দেশের মানুষের শুভেচ্ছা জানান রাজনৈতিক নেতারা। তারা দেশ ও দশের কল্যাণ কামনায় বার্তা প্রেরণ করেন। কিন্তু এর ভিন্নতা লক্ষ করা যায় আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্য ও আচরণে। সৌহার্দ্যরে এ পবিত্র উৎসবের দিনেও তারা রাজনৈতিক বিদ্বেষমূলক আচরণ করেন। জাতীয় ঐক্যের বদলে তাদের কণ্ঠে অনৈক্যের সুর ধ্বনিত হয়ে থাকে! সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজনৈতিক অস্থিরতা জাতিকে আরও হতাশ করছে। রাজনৈতিক এ দুরবস্থার কারণে পবিত্র ঈদের জাতীয় ঐক্য চরমভাবে ব্যাহত হয়েছে। একদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, সর্বস্তরের দুর্নীতি, রাস্তাঘাটের বেহালদশা, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের কারণে এমনিতেই সাধারণ মানুষের ঈদের আনন্দ সীমিত হয়েছে। অন্যদিকে জাতীয় নেতাদের রাজনৈতিক অনৈক্যের কর্মসূচি ঈদের আনন্দকে আরও ম্লান করে দিয়েছে।
সুষম ও বৈষম্যহীন সমাজগঠনে ঈদুল আজহার বিধান মেনে চলা অত্যাবশ্যক। ব্যক্তিগত জীবন থেকে রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে এ অনুশীলন প্রয়োজন। সমাজে নীতি ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় কোরবানির তাকওয়া অর্জন করতে হবে। মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের মাধ্যমে জীবনকে পরিশুদ্ধ করে মানব কল্যাণে আত্ননিয়োগের বিকল্প নেই। মানুষের মাঝেই স্রষ্টার অস্তিত্ব বিদ্যমান—এ বাণী আত্মস্থ করা প্রতিটি মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান ও নীতির পক্ষে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পারে ধর্মের মূল্যবোধকে জাগ্রত করতে। এ বোধ অসাম্প্রদায়িক ও সহনশীল জাতি গঠনে ভূমিকা পালন করে।
Comments