শ্রদ্ধা

ড্যাডির কালজয়ী আলোকচিত্র

গোলাম কাসেম ড্যাডি যখন ফটোগ্রাফি শুরু করেন তখন ভারতবর্ষে ছবি তোলাটা ধর্মীয় দৃষ্টিতে গর্হিত কাজ হিসেবে বিবেচিত হতো। ওই সময়ে ছবি তোলার কারণে তাকে কতটা নিগৃহের স্বীকার হয়েছে, তা ভাবলে বিস্ময় লাগে। শত বছরের জীবন ছিল তার। এই দীর্ঘ জীবনে তিনি দেখেছেন কত কিছু! ক্যামেরার অন্ধকারে আলো সাজিয়ে বন্দি করেছেন কত মণিমাণিক। ফুল-পাখি, নদী-নৌকা, প্রকৃতি-প্রতিকৃতি, পুরাকীর্তি, বাদ যায় নি কোনো কিছুই। গ্লাস প্লেট [কাঁচের পাত] থেকে সেলুলয়েড; এসব রূপালি রসায়নে কেটেছে তার সারা জীবন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঠিক দুই বছর আগে ফটোগ্রাফিতে অভিষেক তার। এনসাইন বক্স ক্যামেরায় হাতেখড়ি। তার তোলা শিশুদের ছবিগুলোই সবচেয়ে জাদুকরী। গভীর আবেগ ধরা সরল কম্পোজিশনের ছবিতে ভর করে নরম আলোর সুনিপুণ সুষমা। ছবিতে পাওয়া যায় শক্তিশালী গল্পের আবহ। ছবির চরিত্রগুলো দ্যুতিময়, তাদের চাহনি-শরীরী ভাষা অর্থপূর্ণ। এ বিষয়গুলোই সমসাময়িকদের থেকে ড্যাডিকে আলাদা করে দেয়। আন্তর্জাতিক শিল্পবিষয়ক লেখক স্কাই অরুন্ধতী থমাস লিখেছেন, 'ড্যাডির ছবিতে স্পষ্ট অথচ ঘোলাটে বিচিত্র আলোর দেখা মেলে। তার ছবির সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের ফিল্মের খানিক মিল পাওয়া যায়। ভিগনেটিং [ছবির মাঝখানে আলো রেখে চারপাশ থেকে কালো হয়ে আসার শৈলী] এবং ওভার এক্সপোজারের এমন কাব্যিক ব্যবহার দুর্লভ।'
    
শুরুতে গ্লাস প্লেট নেগেটিভেই ছবি তুলতেন ড্যাডি। এই ধারা তিনি অব্যাহত রেখেছিলেন গত শতকের চারের দশক পর্যন্ত। ড্যাডির কাজের ধরণ দেখে বুঝা যায়, তিনি মূলধারার ফটোগ্রাফিচর্চার মধ্যেই নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছিলেন। ড্যাডির টিকে থাকা গ্লাস প্লেটগুলোই এখন আমাদের অমূল্য সম্পদ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে কলকাতা ইউনিভার্সিটির ইনফ্যানট্রি কোরের সদস্য হিসেবে যুদ্ধে যোগ দেন ড্যাডি। তিনি যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণের পাশাপাশি ছবিও তুলেছেন সে বিষয়টিও শতাব্দিকাল ধরে কোনো মহলে আলোচিত হয়নি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তিনি যত ছবি তুলেছেন, ভারতবর্ষের আর কেউ এত ছবি তোলার সুযোগ পেয়েছেন বলে জানা যায়নি। গ্লাস প্লেটে তোলা ছবি দেখে নিশ্চিতভাবে বলা যায় তিনি যুদ্ধের প্রশিক্ষণ ময়দানে ডার্করুম সেটআপও ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রশিক্ষণ (বিহার, ভারত ১৯১৫)। আলোকচিত্র : গোলাম কাসেম ড্যাডি/দৃক

মধুপুরের বিশাল প্রশিক্ষণ ময়দানে ইনফ্যানট্রি কোরের সদস্যরা। নিবিড় গাছগাছালির ছায়ায় বসে রণপ্রশিক্ষণ মহরা দেখছেন উৎসুক মানুষ। প্রখর রোদের কারণে ইউনিফর্ম পরা প্রশিক্ষণার্থীদের দীর্ঘ ছায়া মাটিতে প্রতিফলিত। স্লো সাটারে তোলা বলে সশস্ত্র অভিবাদনের সময় প্রশিক্ষণার্থীদের হাতগুলো সেইক করায় ছবিতে গতিময়তা যোগ হয়েছে। ড্যাডির এই ছবিতে যুদ্ধকালীন ভারতবর্ষের সমাজচিত্রের একটা ধারণা পাওয়া যায়। আরেকটি ছবি আছে- তাঁবুর সামনে দুই ব্যক্তি সাহেবি ভঙ্গি। ছবিটি অনুমতি নিয়ে তোলা, সন্দেহ নেই। তবে একটা ব্যাপার লক্ষণীয় যে, কারো দৃষ্টি ক্যামেরার দিকে নয়। তার মানে এ দৃশ্যটি তুলতে গিয়ে ড্যাডি একটা নির্দিষ্ট মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ছবিটির ব্যাকগ্রাউন্ডের তাঁবুটি হঠাৎ দেখলে পিরামিডের মতো মনে হয়। ছবিতে তাঁবুটি একটা ত্রিমাত্রিক ব্যঞ্জণা তৈরি করেছে। এই ছবি দুটির জন্য ঐতিহাসিকদের কাছে ড্যাডি চিরকাল স্মরণীয় থাকবেন।

নরম আলোয় ঝোপাল বাগানে বেতের চেয়ারে বসা এক রহস্যময় কিশোরী। বসবার ভঙ্গিটা অদ্ভুত। মাথার ওপর উজ্জ্বল আলো। ফ্রেম ভেদ করে বেরিয়ে আসে তার চোখের দৃষ্টি। কালো মণিটা কার সাথে কী যেন বলতে চায়। পাটের মতো চুল, মাঝখানে সিঁথি। ক্যামেরার সামনে যে সহজাত লাজুকতা থাকে, এই মেয়ের চোখে তা অনুপস্থিত। একটা মিস্টি কেনডিড। ছবির মেয়েটি কেন ডিফোকাসড, তাও হয়তো আন্দাজ করা যায় সহজে। কৈশোরে এলসির প্রেমে পড়েছিলেন ড্যাডি। ১৯১৮ সালে হাওড়ায় তোলা ছবিটা এলসির কিনা ভাবা যেতে পারে। 
 
পাশাপাশি দাঁড়ানো দুই বোন- জামাল আরা ও জাহান আরা। একজনের স্নেহের হাত আরেকজনের কাঁধে রাখা। দুজনের গায়ে কালো পাড়ের নরম সাদা শাড়ি। তেলে জবজবে কাজল কালো চুলের মাঝখানে সূক্ষ্ম সিঁথি। চোখে মায়া জড়ানো সারল্য। পেছনে কালো পর্দা। ওপরের দিকে একটু সাদা অংশ বের হয়ে আছে। তাতে একটা কার্ভ লাইন তৈরি হয়েছে। ড্যাডি ইচ্ছে করেই হয়তো ফ্রেম থেকে ওটুকু বাদ দেননি। দুজনের চোখ ঠিক ক্যামেরার দিকে নয়; একটু ওপরে অন্যদিকে তাকানো। একজনের মুখে মৃদু হাসি। আরেকজনের কৌতূহলী দৃষ্টি। মনে হয় ক্যামেরার পেছন থেকে ইশারায় কেউ তাদের কিছু বলার চেষ্টা করছে। ১৯২০ সালে কলকাতার ভবানীপুরের ১৭ নম্বর টার্ফ রোডের বাড়িতে ছবিটি তুলেছিলেন ড্যাডি।

তার প্রথম নাচ (রাজশাহী, বাংলাদেশ, ১৯৪৭)। আলোকচিত্র : গোলাম কাসেম ড্যাডি/দৃক

'তার প্রথম নাচ' শিরোনামের ছবিটি একটা অনবদ্য আলোকচিত্র। দাঙ্গা পরবর্তী সময়ে নাইমা আফছার রুবি নামের এক অপূর্ব কন্যাশিশু সবার সামনে নেচে চলেছে। সবাই চোখে প্রশংসার বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। ওভার এক্সপোজারের কারণে মেয়েটির পেছনে একটা স্বপ্নময় আবহ তৈরি হয়েছে। মাথার ওপর সম্ভাষণ জানাচ্ছে গাছের পাতা। ছবির জমিনময় কালো কালো ছোপ নির্দেশ করে সূর্যের তপ্ত আলো। দাঙা পরবর্তী সময়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক শক্তিশালী প্রতিকীচিত্র আমাদের উপহার দিয়েছেন তিনি। ১৯৪৭ সালে রাজশাহীতে তোলা এই ছবিটি আলোকচিত্রের নন্দনতাত্ত্বিক উৎকর্ষের উদাহরণও। 

এক রুপসীর খোঁপায় গাঁথা স্পাইডার লিলি। দাঁতে কাটছে গমের শিষ। মাথাটা খানিক হেলিয়ে দুষ্টুমিমাখা চোখে, ক্যামেরার দিক থেকে মুখ সরিয়ে তাকিয়ে আছে দূরে কোথাও। কানে দুল, গলায় মুক্তার মালা, নখে নেইলপলিশ, হাতে একগাছি চুড়ি। কালো ব্যাকড্রপের সামনে রূপসী এ তরুণীর পোর্ট্রেটের শিরোনাম ড্যাডি দিয়েছিলেন 'হ্যাপি গার্ল'। ড্যাডির তোলা ছবিতে যে অদ্ভুত প্রেম থাকে, একটা পালকের মতো ভালোবাসা থাকে; তা কোথা থেকে আসে হয়তো আমরা আঁচ করতে পারি।

১৯২৯ সালে বাঁকুড়ার এক সাওতাল গ্রামে অনাবৃষ্টিতে ফলন না হওয়ায় ওই গ্রামের মানুষ খুবই করুণ দিনাতিপাত করছিল। না খেতে খেতে তারা দুর্বল হয়ে পড়ছিল। অতি সাধারণ মানের কোডাকের ফোল্ডিং ক্যামেরায় তিনি অভাবী মানুষ ও ক্ষীণকায় শিশুদের দুর্দশা বন্দি করেছিলেন। শিশুরা ড্যাডিকে ঘিরে জানতে চেয়েছিল, কালো রঙের অদ্ভুত জিনিসটা কীভাবে নিজের পেটের ভেতর তাদের আটকে ফেলে! ড্যাডির তোলা ওই ছবিগুলো মিশনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে যথেষ্ট পরিমান সাহায্য আনতে সহযোগিতা করেছিল। 

ড্যাডি ছবি তুলতেন সাবজেক্টকে বুঝতে না দিয়ে। এতে তার আনন্দ হতো। ড্যাডির পোষ্যকন্যা আনোয়ারা রাজশাহী সরকারি বাসভবনের সামনের পুকুরঘাটে কাপড় ধুচ্ছেন। পরনের সাদা শাড়ির একপাশে, সকালের নরম আলো এসে পড়েছে; ঘাটের সিঁড়িতে আলোছায়ার মায়ারঞ্জন খেলা করছে। ড্যাডি ছবিটা তুলে তিনি তার কন্যাকে তাক লাগিয়ে দেন। দুই মাস পর খবর আসে ছবিটি 'অল পাকিস্তান আগফা ফটো কনটেস্টে প্রথম পুরস্কার জিতেছে। ড্যাডি তো অবাক। পরে জানা গেল, আনোয়ারা কাউকে কিছু না জানিয়ে ছবিটি করাচিতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

গায়েহলুদের সকালে বরপক্ষের পাঠানো বিশাল আকৃতির দুটি রুই মাছ কনে বাড়ির বারান্দার টেবিলে সাজিয়ে রাখা। কাগজে মোড়ানো সেই মাছ ঘিরে পাঁচ শিশুর চোখে রাজ্যের কৌতুহল। একটা উচ্ছ্বাসের আলো সবাইকে ঘিরে আছে। দুটো অচেনা জীবের সঙ্গে তাদের প্রথম পরিচয়! ১৯৬৬ সালে ঢাকার গোপীবাগে তোলা ছবিটার শিরোনাম 'টেম্পটিং ফিশ'। ড্যাডির প্রকৃতিপ্রদত্ত ক্ষমতা ছিল এমন সব মুহূর্তকে ধরার। যে ছবি পলকে হারিয়ে যেত, ড্যাডির ক্যামেরায় তা হৃদ্যতা আর বন্ধনের অমলিন স্মারক হয়ে উঠত।

কোমড়ে বাজু পড়া এক নারী নদীতে মাছ ধরছেন। তার ঊরু পানিতে ডুবে আছে। হাতে ঠেলা জাল। সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে একটি বিশাল মালবাহী নাও। নদীর শেষ পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে দূরের গ্রাম। শ্বাশত বাংলা বলতে যা বোঝায়, ছবিটি ঠিক তাই। কিন্তু ভাঙা কাচের নেগেটিভ থেকে প্রিন্ট করা বলে ছবিতে মাকড়সার জালের মতো আবহ তৈরি করেছে। ছবিটি ধারণা দিচ্ছে একটি শুষ্ক পৃথিবীর অথবা শীতের রুক্ষ ত্বকের, যা ছবির বিষয়ের সঙ্গে বৈপরীত্য প্রকাশ করে। ছবিটি ১৯২২ সালে তোলা বলে উল্লেখ করেছিলেন ড্যাডি।

দারা বিবির মসজিদ (ঢাকা, বাংলাদেশ, ১৯৫৯)। আলোকচিত্র : গোলাম কাসেম ড্যাডি/দৃক

নির্জন পুকুরপাড়ে মলিন চেহারায় দাঁড়িয়ে আছে দারা বিবির মসজিদ। সকালের নরম আলোয় মসজিদটির ছায়া ভাসছে। পাশেই অনাদরে বেড়ে ওঠছে একটি তালগাছের চারা। সামনের দিকে বিরাণ মাঠে নতুন ইট সাজিয়ে রাখা। দেখে মনে হচ্ছে জৌলশ হারানো মসজিদটির সংস্কারের জন্যই ইটগুলো আনা হয়েছে। ১৯৫৯ সালে ঢাকার লালমাটিয়ায় এই ঐতিহাসিক মসজিদটির ছবি তুলেছিলেন ড্যাডি। বর্তমানে সংস্কারের কারণে মসজিদটি চেনা মুশকিল। মাত্র ছয় দশকে একটি জনমানবহীন জায়গা কেমন করে ব্যস্ত লোকালয়ে পরিনত হয়, ড্যাডির এই ছবি যেনো প্রতিনিয়ত সেই বয়ান দেয়। 

বাংলাদেশে আধুনিক আলোকচিত্রকলার পুরোধা গোলাম কাসেম 'ড্যাডি' নামেই বেশি পরিচিত। আলোচিত্রীদের অভিবাবক আর আলোকচিত্রের ব্যাপারে শিক্ষাগত এবং উপলব্ধিগত সামষ্টিক কাজের কারণেই তিনি 'ড্যাডি' খেতাব পেয়েছিলেন। তিনি সারা জীবনে আট থেকে দশ হাজার ছবি তুলেছেন। অন্তিম সময়েও পাঁচ শয়ের মতো নেগেটিভ টিকিয়ে রেখেছিলেন। বর্তমানে দৃক পিকচার লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে ১৬৫টি, ফটোজিয়ামে ১৩৫টি; আর ড্যাডির প্রতিষ্ঠিত ক্যামেরা রিক্রিয়েশন ক্লাব আছে পাঁচটি। ড্যাডির এসব নেগেটিভের মধ্যে লুকিয়ে আছে বাংলার এক অদম্য ভবিষ্যতের গল্প।

Comments

The Daily Star  | English

How Chattogram built its economic legacy

Picture a crowded harbour where the salty seabreeze carries whispers of far-off lands, where merchants of all creed and caste haggle over silks and spices, and where towering ships of all varieties – Chinese junks, Arab dhows, and Portuguese carracks – sway gently in the waters of the Bay of Bengal.

13h ago