টাইটানিকের চেয়েও ভয়াবহ যে দুর্ঘটনা
টাইটানিকের ঘটনা সবাই জানেন, এতে মারা যায় ১৫১৭ জন। কিন্তু আরও একটি শতাব্দীর ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ৪৩৮৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল। বেঁচেছিল মাত্র ২৫ জন। নদীতে ফেরি কিংবা সামুদ্রিক ফেরিতে এর চেয়ে বড় দুর্ঘটনার নজির নেই। টাইটানিকের তুলনায় দোনা পাজ ডিজাস্টার বিষয় কম জানে মানুষ। তবে দুটি ঘটনায় অসংখ্যা পরিবার তাদের একমাত্র উপার্জনকারীকে হারিয়েছিল।
ফিলিপিন্স সময় ভোর সাড়ে ছয়টায় ২০ ডিসেম্বর ১৯৮৭ সালে রেজিস্টার্ড প্যাসেঞ্জার ফেরি এমভি দোনা পাজ ম্যানিলার উদ্দেশে ট্যাকলাবান বন্দর ত্যাগ করে। দুটো বন্দরই একই দেশের, তবে দূরত্ব ৮৫৩ কিলোমিটার। ২১ ডিসেম্বর ভোর ৪টায় ফেরিটির ম্যানিলা পৌঁছার কথা। কিন্তু ২০ ডিসেম্বর রাত ৮টার পর থেকে জাহাজের রেডিও-সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বলে উল্লেখ করা হলেও তদন্তে জানা যায় সমুদ্রগামী এই ফেরিতে রেডিও ছিল না।
ফেরিটি ১৯৬৩ সালে হিরোশিমার একটি ডকে নির্মিত হয়। শুরুতে, এর নাম ছিল হিমেইউরি মারু। সে সময় ফেরির যাত্রী পরিবহনের ক্ষমতা ছিল ৬০৮ জন। ১৯৭৫ সালে একজন ফিলিপিনো এটি কিনে নেন এবং ডন সালপিসিও নাম দিয়ে ম্যানিলা কেবু রুটে চালাতে থাকেন।
১৯৭৯ সালের ৫ জুন এই রুটে ফেরিটিতে আগুন ধরে যায় এবং যাত্রী ও ক্রুসহ ১৯৬৪ জনকে উদ্ধার করা হয়, কোনো মৃত্যু ঘটেনি। ফেরিটিকে অযোগ্য ঘোষণা করে ডকে আনা হয় এবং মালিক এটি পুনর্নির্মাণ করেন। ধারণক্ষমতা বাড়িয়ে ডোনা পাজ নাম দিয়ে ম্যানিলা-ট্যাকলোনান রুটে চালু করা হয়। সপ্তাহে দুবার আসা-যাওয়া করত।
বেঁচে থাকা একজন যাত্রী জানায়, ফেরিটি দুর্ঘটনার দিনরাত সাড়ে ১০টায় ট্যাবলান প্রণালিতে ছিল, এ সময় ভিক্টর নামের একটি তেলের ট্যাংকার ফেরিকে সজোরে ধাক্কা দেয়। তাতে প্রথমে কার্গোতে এবং কার্গো থেকে ফেরিতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। আর একজনের ভাষ্য, এক মিনিটের মধ্যে ফেরির চারদিকে দাউ দাউ আগুন জ্বলতে থাকে। তবে সংঘর্ষের পর মুহূর্তের মধ্যেই ফেরির নিজস্ব আলো নিভে যায়। যে সংযোজন প্রণালিতে ফেরি ও তেলের ট্যাংকার, তা ছিল হাঙ্গরে পরিপূর্ণ একটি ভয়ংকর রুট। আগুন লাগার পর ফেরির ক্রুরা বিক্ষিপ্তভাবে ছুটোছুটি করছিল। কোথাও লাইফ ভেস্ট খুঁজে পাওয়া যায়নি, সর্বনাশ ঘটে যাবার পরে তদন্তের সময় লাইফ ভেস্ট ভর্তি কক্ষটি তালাবন্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়। যাত্রীদের কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি, তাদের কোনোভাবে সংগঠিত করার চেষ্টাও করা হয়নি। আগুনে শরীর পুড়ছে, এ অবস্থায় যাত্রীরা আগুনজ্বলা পানিতে লাফ দিয়েছে। তেলের ট্যাংকারের জ্বালানী জাহাজের ও ট্যাংকারের চারপাশের পানিতে ছড়িয়ে পড়ায় পানিতেও আগুন জ্বলছিল।
এমন একজন জানিয়েছেন, তেলের ট্যাংকার ফেরিকে ধাক্কা দেবার সাথে সাথে প্রচণ্ড শব্দে একটি বিস্ফোরণ ঘটে। সে সময় পাশ দিয়ে যাওয়া এম এস ডন ক্লদিও নামের জাহাজের ক্যাপ্টেন কর্মকর্তা নাবিক ও কিছু সংখ্যক চিকিৎসক সামান্য দূর থেকে এই সাগরে মহাঅগ্নিযজ্ঞ - ইনফার্নোর সাক্ষী হয়ে রইলেন। ক্লদিও জাহাজের কর্মকর্তা জীবিতদের উদ্ধার করতে জাহাজ থেকে জাল নিক্ষেপ করলেন। জাল বেয়ে ২৬ জন মরণাপন্ন মানুষ জাহাজে উঠতে সক্ষম হয়। এদের ২৪ জন এম এম ডোনা পাজ এর যাত্রী এবং দুজন তেলের ট্যাংকার ভিক্টরের খালাসি। ভিক্টরের মোট ক্রু ছিল ১৩ জন। ১১ জন অগ্নিদগ্ধ ও সলিলসমাধিপ্রাপ্ত।
ডোনা পাজ ফেরির বেঁচে থাকা যাত্রীর সংখ্যা ২৪ নির্ধারণ করা হলেও পরে ভ্যালেরিনা ডুমা নামের ১৪ বছর বয়সী এক তরুণীকে শনাক্ত করা হয়। রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ফেরিতে ৩ থেকে ৪ হাজার যাত্রী ছিল। ভিক্টর যখন ধাক্কা দেয়, তারা প্রায় সকলেই ঘুমন্ত অবস্থায় ছিল। ফেরি কর্তৃপক্ষ যাত্রী ও ক্রুর যে মেনিফেস্ট প্রকাশ করে, তাতে ১৪৯৩ জন যাত্রী ও ৫৯ জন ক্রুর উল্লেখ ছিল। কিন্তু ক্রিসমাসের সময় এবং যাত্রীর সংখ্যাধিক্যের কারণে ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি যাত্রী ফেরিতে তোলা হয়।
১৯৮৮ সালের তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, যাত্রীর সংখ্যা ছিল ৩০৯৯ এবং ক্রু ৫৯ জন। আর ফেরিতে নিহতের সংখ্যা ৩১৩৪ জন। এই সংখ্যা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ থাকায় ১৯৯৯ সালের জানুয়ারিতে একটি প্রেসিডেন্সিয়াল ট্যাস্ক ফোর্স বিস্তারিত তদন্ত করে যে প্রতিবেদন দাখিল করে তাতে ভিক্টর ট্যাঙ্কারের ১১ ক্রুসহ মোট নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৩৮৫।
শতাব্দীর ভয়াবহ এই দুর্ঘটনার দায়দায়িত্ব ও ক্ষতিপূরণ নিয়ে দীর্ঘকাল উচ্চ আদালতে মামলা চলে। দুর্ঘটনার রাতে আকাশে চাঁদ ছিল, মেঘ ছিল না, আলো ঝলসে উঠেছে সাগরের ঢেউয়ে, কিন্তু ঢেউগুলো শান্ত ছিল না, ছিল অস্থির।
আফ্রিকার টাইটানিক লে জুলা
২০০২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর সেনেগাল সরকারের রো রো ফেরি ডোনা পাজ ডুবে গেল গাম্বিয়ার উপকূলে। যাত্রী ও ক্রু মিলিয়ে নিহত হলেন ১৮৬৩ জন। প্রাণে বাঁচলেন ৬৪ জন। জার্মানিতে তৈরি অত্যাধুনিক এই রো রো ফেরির যাত্রী ধারণক্ষমতা ছিল মাত্র ৫৮০।
ফেরিতে আসলে কজন যাত্রী ছিলেন, তার হিসাব এখনো অজানা। তবে নিহতের সংখ্যা যে টাইটানিকে নিহত যাত্রী ও ক্রুর চেয়ে বেশি তা তো প্রাপ্ত মৃতদেহের সংখ্যাই বলে দেয়। লে জুলার ডুবে যাওয়া সৃষ্টি করল আফ্রিকার টাইটানিক অধ্যায়।
স্বজনহারা ক্ষুব্ধ মানুষের ক্রোধ সামলে উঠতে সেনেগালের প্রেসিডেন্ট আবদুলায়ে ওয়াদে সেদেশের দু'জন মন্ত্রী ও প্রধানকে বরখাস্ত করলেন, প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধ গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলো। প্রেসিডেন্টকে বলতে হলো এত বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে সরকারের মালিকানাধীন ফেরিতে, সরকার এ দায় এড়াতে পারে না। আফ্রিকার আফসোস দুর্ঘটনার আকার টাইটানিকের চেয়ে বড় হবার পরও লে জুলা কোনো আলোচনায় নেই, এই ফেরি দুর্ঘটনা নিয়ে কোনো শিল্পকর্ম, সাহিত্য, সিনেমা কিছুই নেই; এমনকি দুর্ঘটনার যথাযথ তদন্তও হয়নি। সাড়ে চার শতেরও বেশি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ছুটি শেষে এই ফেরিতেই ফিরছিল দক্ষিণ সেনেগালের জিগুলচর থেকে রাজধানী ডাকার। তাদের কেউই বেঁচে নেই। বেঁচে নেই ৪৫ জন স্কুল শিক্ষার্থী, ৬০০ নারীর মধ্যে বেঁচে ছিলেন কেবল একজন গর্ভবতী জননী।
আটলান্টিক মহাসাগরে পতিত হওয়া গাম্বিয়া নদী সেনেগালকে দুভাগ করে রেখেছে; একদিকে বিস্তৃত গ্রামাঞ্চল, অন্যদিকে রাজধানী ডাকার। প্রায় ৩২০ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীর ৩৫ কিলোমিটার প্রশস্ত। এ প্রান্তে অধিকাংশ জোলা গোত্রভুক্ত। তাদের পারাপারের জন্য একেবারে নতুন ফেরি যখন আনা হলো, তাদের সম্মানেই এর নাম রাখা হলো লে জুলা। জুলা ২০৮৭ মেট্রিক টন রো রো ফেরি। এর দৈর্ঘ্য ৭৯.৫ মিটার, বিম ১২ মিটার এবং ড্রাফট ৩.১ মিটার।
২০০১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে ২০০২ এর ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যান্ত্রিক ত্রুটিও পরিবহনক্ষমতা লোপের কারণে লে জুলাকে বসিয়ে রাখা হয়েছিল। গাম্বিয়ার উপকূলে ডুবে যাবার মাত্র দুই সপ্তাহ আগে মেরামত করে একে আবার অপারেশনে ফিরিয়ে আনা হয়।
২৬ সেপ্টেম্বর ২০০২ দুপুর দেড়টার সময় ফেরি ছাড়ে। রাত ১০টায় ডাকারের মেরিটাইম সিকিউরিটি সেন্টার থেকে জানানো হয় ফেরি থেকে জানানো হয়েছে জাহাজ চলাচলের জন্য সমুদ্রের আবহাওয়া উত্তম। কিন্তু এক ঘণ্টার মধ্যেই একটি শক্তিশালী ঝড় এল, সমুদ্র উত্তাল হয়ে উঠল। দুলতে দুলতে ফেরি তার যাত্রী ও গাড়ি সমুদ্রে নিক্ষেপ করতে শুরু করল। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই জাহাজটিও গাম্বিয়ার উপকূল থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে ডুবে গেল। এই সংবাদ পেতে সেনেগাল সরকারের লাগল ৮ ঘণ্টা আর উদ্ধারকারী জাহাজ উঠাতে আরও আট ঘণ্টা। রাত ২টার দিকে ট্রলারের জেলেরাই উদ্ধার কাজে নেমে গেল। তারা কজনকে জীবিত উদ্ধার করল। একের পর এক লাশ টেনে তুলল আর ১৫ বছর বয়সী একটি বালককে জীবিত উদ্ধার করে, সেই জানায় জাহাজের ভেতর আরও বহুসংখ্যক জীবিত মানুষ রয়েছে। ২৮ সেপ্টেম্বর পরিবেশ আন্দোলনকারী হায়দার আলী একটি ডুবুরি দল নিয়ে মোট ৫৫১টি মৃতদেহ জাহাজের ভেতর থেকে উদ্ধার করে। এদের মধ্যে শনাক্তযোগ্য ৯৩ জনকে আত্মীয়দের হাতে হস্তান্তর করা হয়।
ফেরিডুবিতে নিহতদের মধ্যে সেনেগাল, ক্যামেরুন, গিনি, ঘানা নাইজেরিয়া, ফ্রান্স, স্পেন, নরওয়ে, বেলজিয়াম, লেবানন, সুইজারল্যান্ডসহ ১৫ দেশের যাত্রী ছিল। সেনেগালের প্রেসিডেন্ট যদিও অতিরিক্ত যাত্রী বহনকে দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, নৌবাহিনীর কর্মকর্তারা তা উড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, ঝড়ের কারণেই ফেরি ডুবেছে। একটি তদন্ত কমিটি দোষারোপ করেছে ফেরির প্রয়াত কমান্ডারকে। তার ভুল ফেরিচালনার কারণেই দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে তারা মনে করেন।
টয়া মারু টাইফুন
ফেরি ডুবিয়ে বদলে গেল টাইফুনের নাম। মূল পরিচিতি ছিল টাইফুন নম্বর ১৫ মেরি, ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৫৪ রাত ১১টায় জাপান সাগরে অবস্থান করছিল, জাপানের সবচেয়ে জনবহুল দ্বীপ হনসুর ওপর দিয়ে ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার বেগে উত্তর-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হচ্ছিল। আবহাওয়া বিজ্ঞানীদের হিসাব অনুযায়ী বিকেল ৫টায় হনসু ও হোক্কাইডোর মধ্যবর্তী সুগারু প্রণালিতে টাইফুনটির পৌঁছার কথা।
রেলওয়ে যাত্রী পারাপারের উদ্দেশ্যে ন্যাশনাল রেলওয়ের মিতসুবিসি টয়া মারু নামের ফেরিটি নির্মাণ করে এবং ২১ নভেম্বর ১৯৪৭ কোবেতে ফেরিটির যাত্রা শুরু। ৩৭৩ ফুট লস ও ৫২ ফুট বিমের ফেরিটির ধারণক্ষমতা ১১২৮ জন যাত্রী ও ১২০ জন ক্রু।
টয়া মারু হনসুর অমোরি থেকে দিনের প্রথম যাত্রা শুরু করে বেলা ১১টায় হ্যাকোডাটে বন্দরে পৌঁছে। আবার দুপুর ২টা ৪০ মিনিটে এখান থেকে ছেড়ে টাইফুনের আঘাত লাগার আগেই তার অমোরি পৌঁছে যাবার কথা। ঝড়ের সম্ভাবনা থাকায়, সামুদ্রিক ঝড়ের বিরুদ্ধে কাঠামোগত অপেক্ষাকৃত দুর্বল শিকান মারু নামের একটি ফেরি যাত্রা বাতিল করল এবং টয়া মারুর যাত্রা বিলম্বিত করিয়ে ফেরির সব যাত্রী গাড়ি তাতে উঠিয়ে দিল। এদিকে ঝড়ো আবহাওয়ার কারণে বেলা ৩টা ১০ মিনিটে টয়া মারুর ক্যাপ্টেন ফেরির যাত্রা বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
তারপর প্রচুর বৃষ্টিপাত হলো এবং বিকেল ৫টায় আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেল এবং গন্তব্য যাত্রা করার মতো অনুকূল আবহাওয়া বিরাজ করছে বলে ক্যাপ্টেন মনে করলেন। পূর্বাভাস অনুযায়ী টাইফুন সরে যাবে বিবেচনা করে ক্যাপ্টেন অমোরির দিকে যাত্রা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু আবহাওয়ার পরবর্তী পূর্বাভাসে জানানো হলো টাইফুনের গতি শ্লথ হয়ে গেছে তবে তা পুরো দিনই সুবারু প্রণালিতে অবস্থান করবে।
৬টার দিকে প্রায় ১৩০০ যাত্রী নিয়ে টয়া মারু হ্যাকোডাটে হয়ে অমোরির উদ্দেশে যাত্রা করল। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তীব্র বাতাস বইতে শুরু করল। সন্ধ্যে ৭টায় মিনিটে হ্যাকোডাটে বন্দরের পাশেই টয়া মারু নোঙর ফেলল এবং ক্যাপ্টেন ভাবলেন আবহাওয়া অনুকূল হলে আবার যাত্রা শুরু করবেন। কিন্তু প্রবল বাতাসের কারণে নোঙর ভূপৃষ্ঠে আটকালো না। বাতাসের তোড়ে টয়া মারুর মতো বিশাল জাহাজ সাগরে ভেসে গেল। ইঞ্জিন রুমে পানি ঢুকল, ফলে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেল। টয়া মারু ফেরি দুলতে দুলতে একসময় ক্যাপ্টেনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল। এবার ক্যাপ্টেন ভাবলেন বন্দরের বাইরের দিকে সৈকতে জাহাজটিকে ঠেক দেবার চেষ্টা করবেন।
রাত ১০টায় মিনিটে টয়া মারু থেকে এসওএস বার্তা পাঠানো হলো। ঢেউ এতটাই উত্তাল যে, এত বড় জাহাজও সোজা থাকতে পারল না এবং ১০টা ৪৩ মিনিটে ডুবতে শুরু করল। বন্দর থেকে খানিকটা দূরে উপকূলের বেশ কাছেই কয়েক শ মিটার গভীরে জাহাজটি ডুবে গেল। যাত্রী ও ক্রুসহ ১৩০৯ জনের মধ্যে ১১৫৯ জনের মৃত্যু ঘটল। বেঁচে গেলেন ১৫০ জন।
মৃতদের মধ্যে আমেরিকার ক্যাভালরি ডিভিশনের ৩৫ জন নিহত হলেন, বেঁচে রইলেন তাদের মাত্র একজন। সেই একই দিনে টাইফুন মেরি আরও চারটি জাহাজ ডুবায়। সব মিলিয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৪৩০। ফেরি দুর্ঘটনার পর টাইফুন মেরির নাম বদলে রাখা হয় টয়া মরু টাইফুন।
টাইটানিক ট্র্যাজেডি
টাইটানিকও ফেরি; সাউদাম্পটন থেকে নিউ ইয়র্কে যাত্রী ফেরি করাই এর প্রধান মিশন। ইতিহাসে কোনো জাহাজ এতো আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেনি। ১১০ বছর আগে মহাসমুদ্রের বিস্ময় টাইটানিক উদ্বোধনী যাত্রায় সাউদাম্পটন থেকে নিউ ইয়র্কের পথে চতুর্থ দিন ১৪ এপ্রিল ১৯১২ রাত ১১টা ৪০ মিনিটে আটলান্টিক মহাসাগরের ঘাতক আইসবার্গের সঙ্গে সংঘর্ষে ভীষণ বিপন্ন হয়ে পড়ে।
অবিরাম এসওএস বার্তা যেতে থাকে টাইটানিক থেকে। দুই ঘণ্টা ৪০ মিনিট পর রাত দুইটা ২০ মিনিটে (তখন ১৫ এপ্রিল) প্রযুক্তির উৎকর্ষ এবং অহংকার নিয়ে টাইটানিক আটলান্টিকে তলিয়ে যায়। টাইটানিকের ১৫১৭ জন শীতার্ত যাত্রী ও ক্রু ২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড উষ্ণতার সমুদ্রজলে অসহায় অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
টাইটানিক চলচ্চিত্র কেট উইন্সলেট ও লিওনার্দো দ্য ক্যাপ্রিও
যাত্রাপথে যে আইসবার্গ রয়েছে টাইটানিক এ ধরনের ছয়টি সতর্কবার্তা পায়। কিন্তু বেতার অপারেটর যাত্রীদের ব্যক্তিগত বার্তা পাঠানো নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে সতর্কবার্তা আমলে নেননি। যে আইসবার্গের সঙ্গে টাইটানিকের সংঘর্ষ হয় তা আর সব আইসবার্গের মতো সাদা বর্ণের ছিল না। রাতের আকাশে আইসবার্গের প্রতিবিম্বজনিত কালো ছায়ার কারণে এ ধরনের আইসবার্গকে ব্ল্যাকবার্গ বলা হয় এবং খুব কাছাকাছি স্থান থেকেও দেখা যায় না। টাইটানিকের বেলায় আইসবার্গ দেখা ও সংঘর্ষের মাঝখানে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার মতো সময় ছিল মাত্র ৩৭ সেকেন্ড।
Comments