বই পর্যালোচনা

শাহাদুজ্জামানের গল্প বলার ভঙ্গিমা

বছর চারেক আগে 'হারুনের মঙ্গল হোক' শিরোনামে কথাশিল্পী শাহাদুজ্জামানের প্রথম একটি গল্প পড়ি। জানতে পারি, হারুন নতুন বিয়ে করেছেন এবং হুট করেই এক রাতে নতুন সংকটের মুখোমুখি হয়েছেন। যেখানে পরিবার পরিকল্পনার প্রকল্পে কাজ করা হারুন অনাগত সন্তানের অন্ধকার ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়ে সন্তান গ্রহণ থেকে বিরত থাকে। আবার অন্যদিকে তার খাটের নিচে থাকা জন্ম নিরোধক কনডম সে চাইলে ব্যবহার করতে পারে না, কারণ কর্মী হিসেবে অফিসে প্রতিটি পণ্যের হিসেব দিতে হয়। গল্পের ভাবনাটি ছিলো এমন...

ভাবনাটি আমাকে এতো আন্দোলিত করে যে, খুঁজেছি তিনি আরও কী লিখেছেন। দেখি তিন দশকের অধিক সময় লিখছেন কথাশিল্পী শাহাদুজ্জামান। সঙ্গে এও জানতে পারি যে, প্রখ্যাত কথাশিল্পী আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তরুণ শাহাদুজ্জামান থেকে একটি গল্প চেয়ে প্রকাশ করেছিলেন। যেই গল্পটি ছিলো 'হারুনের মঙ্গল হোক'।

ষাটের দশকের পর থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত কবিতার ভাষা ও অর্থে যতটা না নিরীক্ষা হয়েছে, গল্প বলার ক্ষেত্রে গদ্যে ততটা রূপান্তর হয়নি। আর সেই কারণেই হয়তো হুমায়ূন আহমেদের গল্প বলার ভঙ্গিমা ধার করতে হয়েছে সোমেন চন্দ থেকে কিংবা মার্কেজকে ফিরতে হয়েছে হোমিংয়ের দিকে। কিন্তু গত কয়েক দশকে বাংলা ভাষার গল্পে কাব্যিক গদ্য নির্মাণে শাহাদুজ্জামানের নিরীক্ষাকে সফলই বলা চলে।

কেশের আড়ে পাহাড় বইটির 'তারপর যেতে যেতে' নামক গল্পের কয়েকটা লাইন এরকম- 'আমি "নছিমন" নামক একটা যানবাহনে পাড়ি দিই আরও কিছুটা পথ। শুনতে পাই ধান কাটা ট্রাক্টর গ্রাম্য যুবকের হাত ধরে রূপান্তরিত হয়েছে নছিমনে। যেন বা জাদুকরের হাতের ছোঁয়ায় রুমাল হয়ে গেছে খরগোশ। এবার নৌকা নামের পরিচিত যানবাহনে চড়ি। নৌকার মাঝি গান গায়। হিসাব অনুযায়ী নৌকার মাঝির এখন আর গান গাওয়ার কথা নয়। বিশ্ব পুঁজিবাজারে যে ব্যাপক ধস নেমেছে তাতে মাঝির ঘরে গুটিকয় আলু থাকার কথা। আর শুধু আলু খেয়ে কণ্ঠে গান আনাটা কঠিন। তবু মাঝি গান গায়…'। নির্দ্বিধায় আবৃত্তিযোগ্য কোন কবিতার পঙক্তি বলে চালিয়ে দেয়া যাবে এই লাইনগুলো। শুনেছি গ্রামের একটি স্কুলের সাংস্কৃতিক আয়োজনে কোন একজন কিশোর পাঠক শাহাদুজ্জামানের গল্পকে আবৃত্তি করেছিলো কবিতা হিসেবে। এটা কি গল্পের ভাষার সার্থকতা? নাকি গদ্যের জন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ স্বতন্ত্রতার ঘাটতি, তা ভাববার বিষয়।

 

আরেকটা গল্প বলি। এটা 'কেশের আড়ে পাহাড়' বইয়ের প্রথম গল্প। একজন ছাপোষা ভদ্রলোক যার নাম রেজাউল করিম, তিনি প্রতিদিন অফিসে গিয়ে দুপুর নাগাদ নিজের বাসায় ফোন করেন। কারণ সেসময় তার স্ত্রী চাকরি ক্ষেত্রে থাকে। তার স্কুল পড়ুয়া ছেলের ক্লাস থেকে ফিরে একা থাকতে হয়, মা-বাবা দুজনই তখন নিজেদের অফিসে। ছেলের এইরকম একাকীত্বকে নিদারুণ ভাবে অনুভব করেন ভদ্রলোক, তাই ঘরে ফোন দিয়ে রেজাউল করিম ছেলেকে জিজ্ঞেস করেন, 'রেজাউল করিম সাহেব আছেন?'

তখন ছেলে হাসতে হাসতে বলে, "বাবা তুমি এত দুষ্টুমি করো!" ছেলেকে কিছুক্ষণের জন্য একাকীত্ব ভোলানোর জন্য প্রতিদিন এই কাজ করেন। নিজেই ফোন দিয়ে নিজের সঙ্গে কথা বলতে চান। কিন্তু একদিন ঘটনা পাল্টে যায়। রেজাউল করিম নিজের ছেলেকে ফোন দিয়ে বরাবরের মত বলেন, "রেজাউল করিম আছেন?" ছেলে গম্ভীর মুখে উত্তর দেন, "হ্যাঁ আছে"। রেজাউল করিম সাহেব ফোন নম্বর মেলান, দেখেন সব ঠিকঠাক। কিছুক্ষণ পর সত্যি সত্যি রেজাউল করিমের মত কণ্ঠের একজন ফোনের ওপাশ থেকে কথা বলে ওঠেন। রেজাউল সাহেব নিজের সঙ্গে ফোনে কথা বলার এক অভূতপূর্ব ও আশ্চর্যজনক সময়ে উপনীত হন। এই দৃশ্যের মধ্যে ঢুকলে আপনি কী করতেন?

শাহাদুজ্জামানের লেখায় গল্প ঠিক কীভাবে এগোচ্ছে কিংবা গল্পের ফলাফল কী হবে, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে গল্পের ভাবনা। মানুষ মাত্রই যে নিজের রাজনৈতিক চিন্তা থেকে শুরু করে দার্শনিক ভাবনাগুলো থাকে, সেগুলো প্রকাশ করার মাধ্যম হিসেবে তিনি বেছে নেন গল্পকে। ব্যাপারটাকে তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন গ্রামে মাছ ধরার মত করে। ছোট্ট একটি মুখ দিয়ে মাছ প্রবেশ করে বেশ বড়সড় একটি জালে আটকে যায়। তিনি গল্পের মধ্যে ছোট্ট একটি দরজা দিয়ে বেশ বড়সড় এক ভাবনার জগতে প্রবেশ করেন। একদম শুরুতে উল্লেখ করা গল্প, যেখানে রেজাউল করিম সাহেব একদিন আকস্মিক ভাবে ফোনে নিজের মত আরেকজন রেজাউল করিমকে শুনতে পান, এটি মূলত সেই ছোট আকৃতির দরজা যেখান দিয়ে পাঠক প্রবেশ করবে নতুন এক ভাবনার জগতে। 'মহাশূন্যে সাইকেল' গল্পে ঠিক তারপরই আমরা যেই জগতে প্রবেশ করি, গল্প শেষে একদম ভিন্ন ধরণের বিচ্ছিন্নতা ও দূরত্ব নিয়ে আমাদের চিন্তার জগত আন্দোলিত হয়।

শাহাদুজ্জামান, জন্ম ১৯৬০ সালে, ঢাকায়। ছবি : ফেসবুক থেকে।

শাহাদুজ্জামানের গল্পের চরিত্ররা সবসময়ই হয় একটু গোছানো। ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও যেন সংলাপগুলো মেপে মেপে দেয়া। এটি যে কোন লেখার 'মসৃণ গল্প হয়ে ওঠা'র ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে বৈ কি। কারণ শাহাদুজ্জামানের গল্পে চরিত্র যখন গ্রামে চা খেতে দোকানে বসে, সে তখন ডিভিডিতে 'টাঙ্কি ফুটা' শিরোনামে একজন নায়িকার নৃত্য দেখতে পায়। মুশকিল হলো, সেই গল্পে এই নৃত্য উপভোগ করতে থাকা মানুষদের ব্যাপারে আর বলা হয় না। তারা কি কেউ চাষী? নাকি গ্রামের বয়োবৃদ্ধরা অখণ্ড অবসরের অংশ হিসেবে এই নৃত্য উপভোগ করে? সর্বোপরি, চরিত্রের পরিশোধিত সংলাপ গল্পগুলোকে কিছুটা স্বচ্ছ কাঁচের বাক্সে রাখা বলে মনে হয়। আমরা স্পষ্ট গল্পের আনন্দ, বেদনা ও সংকট দেখি বটে, কিন্তু কাঁচের ওপাড়ে থাকায় সেই গল্পগুলো ছুঁয়ে দেখা সম্ভব হয় না।

এজন্যই বোধ করি, রাজধানীর বুক ক্যাফেতে শাহাদুজ্জামানের বই উল্টেপাল্টে দেখার সময় অচেনা পাঠক স্বপ্রনোদিত হয়ে আমার কাছে এসে আলাপ জুড়ে দেয় এবং মোক্ষম সময়ে মন্তব্য জুড়ে দিয়ে জানায় তাকে অর্থাৎ শাহাদুজ্জামানকে এই পাঠক মূলত একজন অভিজাতদের লেখক হিসেবেই চেনে। এমনকি তার বিখ্যাত ডকু ফিকশন 'ক্রাচের কর্নেল' বইয়ের যতটুকু অংশতেই মুক্তিযুদ্ধের উপস্থিতি ছিলো, তা যেন বহুল চর্চিত সাধারণ মানুষের ডিসকোর্স থেকে যোজন যোজন দূরে থেকে ব্যাখ্যা। যা সাধারণ মানুষের চোখে তার সাহিত্যকে গুটিকয়েক ক্ষেত্রে 'অভিজাতদের সাহিত্য' হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়ে থাকে। যদিও পৃষ্ঠাজুড়ে একজন কর্নেল তাহেরের জীবন মানচিত্র অঙ্কন ছাড়াও লেখক পাক-ভারত দেশবিভাগ, মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব, মুক্তিযুদ্ধকালীন ও তার পরবর্তী সময়ের জানা-অজানা অনেক পরিপ্রেক্ষিত এবং নায়ক-খলনায়কের সাথে পাঠকের পরিচয় ঘটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।

কিন্তু শাহাদুজ্জামানের গল্পের যে স্তর, সেগুলো পর্যন্ত না যেতে পারলে গল্পের মূল রসদ পাওয়া যাবে না বলেই বোধ করি। আর সময়ের সঙ্গে পাঠকের পরিপক্কতা সেই স্তর পর্যন্ত পৌছাতে পারে। গত কয়েক দশকে ইলিয়াস কিংবা শহীদুল জহিরের মত যারা প্রচলিত ঘরানার বাইরে গিয়ে গল্প লিখেছেন, তাদের লেখায় শিল্পের অন্যান্য মাধ্যমের মত বেশ কয়েকটি স্তরের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। শাহাদুজ্জামানের গল্পগুলোতে ভাবনার চর্চাকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে সেগুলো বহু স্তরে নির্মাণ করতে হয়। ভাষাকে শুধুমাত্র গল্প বলার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেন না। নান্দনিকতার দিক থেকে বহুমাত্রিক ভাবে গল্পকে নির্মাণ করার চেষ্টা করেন। সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ যেই প্রক্রিয়া, মানুষের চিন্তাকে বহুমুখী ভাবে নাড়া দেয়া, সেগুলোও গল্পে ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করে। শাহাদুজ্জামান তেমনি ভাবে গল্পের একেকটা বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে পাঠককে নানা জায়গায় প্রবেশ করান; নিছক গল্প শোনানোর জন্য গল্প লেখেন না। একটি গল্পের মধ্যে আরও একটি গল্প, খানিকটা রাশিয়ান মাত্রুস্কা পুতুলের মত যেখানে একটি পুতুলের মধ্যে ভরে রাখা যায় আরেকটি পুতুল, সেই পুতুলের মধ্যে আরও একটা।

কেশের আড়ে পাহাড় বইতে শাহাদুজ্জামানের লেখা গল্পের বিচিত্রতা লক্ষণীয়। প্রথম গল্প 'মহাশূন্যে সাইকেল' আমাদের সামনে দূরত্ব ও একাকীত্ব বিষয়ে সরলরেখার বাইরে গিয়ে প্রশ্ন তোলে। পরের গল্প 'তারপর যেতে যেতে' আমরা গ্রামীণ মিথের আড়ালে বিচ্ছিন্নতার একটা গল্প শুনি। যেই বিচ্ছিন্নতা মানুষের ভেতর থেকে মানুষটা বেরিয়ে যায়। মানুষের সঙ্গে মানুষের বিচ্ছিন্নতার এরকম সুন্দর ও সরল উপস্থাপন আমি পড়িনি। এই গল্পটিই শহর ও গ্রামের সবার গল্প হয়ে উঠতে পারে। 'আমি ও মাইকোবেকটেরিয়াম টিউবারকুলি' নামের গল্পের নিছক রসবোধ পাঠককে স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে নিয়ে যায়। এই যে গল্পগুলোকে বইতে সাজিয়ে তোলা, সেক্ষেত্রে বিষয় ও বৈচিত্র্যকে যেভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, তা শাহাদুজ্জামানের মুনশিয়ানাকে আরও প্রকাশ করে। এই শহরের গল্পকার শহীদুল জহির তার জীবনে যে একমাত্র বই রিভিউটি লিখেছিলেন, তা ছিলো শাহাদুজ্জামানের বই নিয়ে। কারণ বিষয়-বৈচিত্র্য ও দর্শনের জায়গা থেকে তার গল্পগুলো মসৃণ ও নান্দনিক।

Comments

The Daily Star  | English

No active militant presence in Bangladesh: home adviser

The reports of suspected extremists' deportation from Malaysia shows no links to local terrorist networks, he says

26m ago