রবিবাসরীয় সম্পাদক হিসেবে যেমন ছিলেন জীবনানন্দ দাশ

জীবিকার প্রয়োজনে জীবনে কবি জীবনানন্দ দাশ নানা বৃত্তি অবলম্বন করেছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ. পাশ করার পর কলকাতার সিটি কলেজে ইংরেজি বিভাগের টিউটর হিসেবে নিযুক্তি লাভ করেন। প্রাতিষ্ঠানিক অর্থ সংকটের কারণে সিটি কলেজ কর্তৃপক্ষ জীবনানন্দ দাশকে চাকরীচ্যুত করে ১৯২৮ সালে। এতে জীবিকার গভীর অনিশ্চয়তায় পড়েন জীবনানন্দ। 

জীবিকার প্রয়োজনে জীবনে কবি জীবনানন্দ দাশ নানা বৃত্তি অবলম্বন করেছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ. পাশ করার পর কলকাতার সিটি কলেজে ইংরেজি বিভাগের টিউটর হিসেবে নিযুক্তি লাভ করেন। প্রাতিষ্ঠানিক অর্থ সংকটের কারণে সিটি কলেজ কর্তৃপক্ষ জীবনানন্দ দাশকে চাকরীচ্যুত করে ১৯২৮ সালে। এতে জীবিকার গভীর অনিশ্চয়তায় পড়েন জীবনানন্দ। 

পরবর্তীকালে ১৯২৯ এ খুলনারা বাগেরহাটে পি.সি. রায় কলেজে মাত্র তিন মাস অধ্যাপনা করার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। এরপর ১৯২৯ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৩০ এর মার্চ মাস পর্যন্ত দিল্লির রামযশ কলেজে অধ্যাপনা করেছেন।  

জীবিকার তাগিদে নানা কাজের কথা ভেবেছেন। এ সময় কলকাতায় অবস্থান করেছেন চাকুরীর খোঁজে। উল্লেখ্য যে তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল সাহিত্যিক প্রয়োজনে তাকে কলকাতায় থাকা দরকার। কলকাতায় বাড়িতে গিয়ে ছাত্র পড়ানো বা টিউশনি ছিল তার প্রধান জীবিকা। এতে টিকে থাকবার মতো আয়-রোজগার হলেও তিনি টিউশনি করা পছন্দ করতেন না। ৬ ডিসেম্বর ১৯৩০ তারিখে দিনলিপির খাতায় জীবনানন্দ লেখেন: "Tuition—Waste of time." কিন্তু কার্যত এ সময় আরও টিউশনি খুঁজছিলেন তিনি। কয়েকদিন পর ১৫ই ডিসেম্বরে প্রাইভেট টিউশনির জন্য একজন সম্ভাব্য ছাত্রীর মাকে চিঠি লিখেছিলেন তিনি। 

এ সময় তিনি প্রচুর কবিতা লিখেছেন কিন্তু বলা যায় প্রকাশ করেননি একটিও। কবিতার সঙ্গে গল্প-উপন্যাস রচনা শুরু করেন তিনি। তবে কোনো একটি গল্প বা উপন্যাস প্রকাশ করেননি। ১৯৩৫ সালের আগস্ট মাসে জীবনানন্দ দাশ বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে টিউটর (সহকারী প্রভাষক বলা যায়) হিসেবে নিযুক্তি লাভ করলে তার দীর্ঘ বেকার জীবনের অবসান ঘটে। পরের বছর এপ্রিল মাসে লেকচারার (প্রভাষক) পদে পদোন্নতি হয় তার। ১৯৪৬-এ কলকাতায় স্থানান্তরের পূর্বপর্যন্ত এ কলেজেই চাকরি করেছেন তিনি। তবে কলকাতায় চাকুরী লাভের চেষ্টা তিনি করে গেছেন। পরের বছর কবি বুদ্ধদেব বসুকে লিখিত পত্রপাঠে বোঝা যায় সিটি কলেজে পুনর্নিয়োগের জন্য দরখাস্ত করেছিলেন জীবনানন্দ দাশ। এ ব্যাপারে বুদ্ধদেব বসুর প্ররোচনা ছিল প্রতীয়মান হয়।

২.
কলকাতার দৈনিক স্বরাজ পত্রিকায় সম্পাদকীয় পদে চাকুরী লাভের বিষয়ে কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্যের বিশেষ ভূমিকা ছিল। বয়সের পার্থক্য স্বত্বেও কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্যের (১৯০৯) সঙ্গে জীবনানন্দের (১৮৯৯) বিশেষ ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। তবে ঠিক কবে সঞ্জয় ভট্টাচার্যের সঙ্গে জীবনানন্দের পরিচয় হয়েছিল এবং কীভাবে তা আন্তরিক ঘনিষ্ঠতার রূপ পরিগ্রহ করেছিল তা নিশ্চিতভাবে জানা যায় না। দেখা যায় ১৯৪৩ সালে কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য জীবননান্দ দাশের কবিতা নিয়ে 'নিরুক্ত' পত্রিকায় (আষাঢ় ১৩৫০) প্রশংসামূলক দীর্ঘ আলোচনা করেছিলেন। সঞ্জয় ভট্টাচার্য কুমিল্লা থেকে 'পূর্ব্বাশা' সাহিত্য পত্র প্রকাশ করেছিলেন ১৯৩২ সালে। পরের বছর থেকে পূর্ব্বাশা প্রকাশিত হতো কলকাতা থেকে। 

১৯৪৪ সালের জুলাই মাসে সঞ্জয় ভট্টাচার্যের প্রকাশনা সংস্থা পূর্বাশা লিমিটেড থেকে প্রকাশিত হয় জীবননান্দ দাশের চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ 'মহাপৃথিবী'। বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে অধ্যাপনায় নিযুক্ত তুলনামূলকভাবে অখ্যাত কবির কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হচ্ছে কলকাতার প্রকাশনা সংস্থা থেকে এটি কম কথা ছিল না; কারণ এর আগের তিনটি কাব্যগ্রন্থ জীবনানন্দ দাশ নিজ উদ্যোগে প্রকাশ করেছিলেন। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এ সময় সঞ্জয় ভট্টাচার্যের সঙ্গে জীবনানন্দের পত্রবিনিময় হয়েছিল। কিন্তু সে সবের কোনোটির সন্ধান পাওয়া যায়নি। যেগুলোর পাওয়া গেছে সেগুলো স্বরাজ-পরবর্তী কালের।

প্রায় প্রতি বছর পূজার ছুটি কলকাতায় কাটাতে চেষ্টা করেছেন বরিশালবাসী জীবনানন্দ দাশ। ১৯৪৬ এ ব্রজমোহন কলেজ থেকে দীর্ঘ ছুটি নিয়ে কলকাতায় গমন করেন তিনি আগস্ট মাসের শেষভাগে। ছুটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে বিনা বেতনে ছুটির জন্য দরখাস্ত করেন। এ সময় দৈনিক স্বরাজ প্রকাশের প্রস্তুতি চলছিল। সঞ্জয় ভট্টাচার্যের বন্ধু সত্যপ্রসন্ন সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা ছিল জীবনানন্দের। তিনি জীবনানন্দকে দৈনিক স্বরাজের ব্যাপারে অবহিত করেন এবং বরিশাল ছেড়ে কলকাতায় চলে এসে এ পত্রিকায় কাজ করার ব্যাপারে প্রণোদিত করেন।

সঞ্জয় ভট্টাচার্যের মৃত্যুর পর কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী 'দেশ' পত্রিকায় প্রকাশিত একটি নিবন্ধে স্মৃতিচারণক্রমে জানিয়েছেন, পত্রিকায় কাজ করার বিষয়ে জীবনানন্দের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল দৈনিক স্বরাজের পরিচালনা পর্ষদ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চাকুরিটি হয়ে যায়। এ চাকুরিপ্রাপ্তিতে সঞ্জয় ভট্টাচার্যের ভূমিকা ছিল মুখ্য।  

১৯৪৭ সালের জানুয়ারি মাসে জীবনানন্দ দাশ দৈনিক স্বরাজ পত্রিকায় যোগদান করেন। পদমর্যাদায় তিনি ছিলেন একজন সহকারী সম্পাদক। মাসিক বেতন নির্ধারণ করা হয় ২৭০ টাকা। এ সময়ই তিনি স্থির করেন যে বরিশালের পাট চুকিয়ে কলকাতায় হয়ে যাবেন। কলকাতায় থিতু হয়ে সাহিত্যচর্চ্চার আকর্ষণ ছিল, কিন্তু ব্রজমোহন কলেজের মাসিক ১৫০ টাকা বেতনের তুলনায় স্বরাজের মাসিক ২৭০ টাকার আকর্ষণও ছিল একটি নিয়ামক। 

৩. 
দৈনিক স্বরাজ সম্পর্কে বেশী কিছু জানা যায় না। ভারতের কোনো জাতীয় লাইব্রেরি বা অভিলেখগারে এ পত্রিকাটির কোনো কপি নেই। জীবনানন্দ দাশের কবিতা ও জীবন নিয়ে পিএইচডি গবেষণা করার সময় শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ক্লিনটন বুথ সিলি 'চতুরঙ্গ' পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক আতোয়ার রহমানের নিকট থেকে জেনেছিলেন, ১৯৪৭ সালের ২৬শে জানুয়ারি দৈনিক স্বরাজ এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। 

জীবনানন্দ বিশেষজ্ঞ ভূমেন্দ্র্র গুহ জানিয়েছেন, দৈনিক স্বরাজ প্রকাশের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন হুমায়ুন কবির। তাঁর প্ররোচনায় এতে যুক্ত হয়েছিলেন সত্যপ্রসন্ন দত্ত। তিনি স্বরাজের পরিচালনা পর্ষদের একজন সদস্য ছিলেন। দৈনিক স্বরাজের সম্পাদক ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার এবং প্রকাশক ছিলেন রমেশচন্দ্র বসু। অন্যান্যদের মধ্যে কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, নারায়ণ চৌধুরী প্রমুখ এ পত্রিকায় কাজ করতেন। অফিস ছিল ১০ ক্রিক রোডে। কুমিল্লা ব্যাংকিং কর্পোরেশনের আর্থিক সমর্থন ছিল। নিজস্ব প্রেস ছিল। বেশী চলেনি পত্রিকাটি। অচিরেই আর্থিক সংকটে পড়ে এর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।  

স্থির হয়েছিল, অন্যান্য দৈনিক পত্রিকার মতই 'স্বরাজ' প্রতি রবিবার বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করবে। এই ক্রোড়পত্রে কবিতা গল্প নিবন্ধ মুদ্রিত হবে। জীবনানন্দ হলেন এই রবিবাসরীয় সাময়িকীর সম্পাদক। তাকে সাহায্য করতেন জনৈক অখিলকুমার। যথারীতি জীবনানন্দ দাশের প্রধান কাজ লেখা সংগ্রহ ও প্রকাশের জন্য নির্বাচন। প্রতি মাসে চারটি রবিবাসরীয় ক্রোড়পত্রের জন্য তাকে লেখা সংগ্রহ করতে হতো। লেখার সঙ্গে অলংকরণের বিষয় ছিল। তখন লাইনো ব্লকে ফটো মুদ্রণও শুরু হয়েছে। লেখা প্রেসে পাঠানো, প্রুফ দেখানোর সঙ্গে সঙ্গে ছবি ও ফটো বাছাইয়ের কাজও তাকে করতে হতো।

শুরুতে এ কাজটি জীবনানন্দের পছন্দ হয়েছিল। তাছাড়া বলা হয়ে ছিল স্বরাজে তার চাকুরী পাকা। মে মাসে (১৯৪৭) তিনি বরিশাল গিয়ে মালপত্র ও পরিবারের সদস্যদের কলকাতায় নিয়ে আসেন। ১৮৩ নম্বর ল্যান্সডাউন রোডে অনুজ অশোকানন্দ দাশের বাসাতে ওঠেন তিনি। সেখান থেকেই স্বরাজের অফিসে যাতায়াত করতেন। 

সম্পাদনার কাজটি জীবনানন্দের জন্য জটিল কিছু ছিল না। কিন্তু দৈনিক স্বরাজের পরিবেশ তার জন্য অনুকূল ছিল না। অন্য দিকে তিনিও মানিয়ে নেয়ার মতো লোক ছিলেন না। দ্রুত পরিবেশ অস্তস্তিকর হয়ে ওঠে। কর্তৃপক্ষের বিশেষ করে সম্পাদক কারো কারো ব্যবহার ছিল অপমানজনক। অচিরেই 'স্বরাজ' হয়ে ওঠে অমর্যাদাকর কর্মস্থল। 
 
৩০ জুলাই ১৯৪৭ তারিখে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তকে লেখা একটি চিঠিতে জীবনানন্দ লিখেছেন, "স্বরাজের কাজ মন্দ ছিল না। কিন্তু কোনো কোনো কারণে ভালো লাগছে না। অন্য কিছু পেলেই -- কিংবা আগেই চলে যেতে হবে। বরিশালে ফিরে যেতে চাই না। ... ''

৪.
স্কুল ব্যবহার্য 'বাহাদুর' মার্কা লাল মলাটের রুলটানা এক্সারসাইজ খাতায় অনেক দিনলিপি লিখেছিলেন জীবনানন্দ দাশ। এরকম একটি খাতায় ১৯৪৭ সালের কিছু দিনলিপি লিখেছেন তিনি যার প্রথম অংশে তাঁর 'স্বরাজ' দিনের অভিজ্ঞতার কিছু বিবরণ রয়েছে। এ খাতাটির দ্বিতীয় অংশে রয়েছে 'স্বরাজ' পরবর্তী কিছু ঘটনার প্রসঙ্গ। 

দিনলিপির শুরুর দিকে 'স্বরাজ' পত্রিকার আলংকারিক চিত্রকর সুনীল কর ও কান্তি বলকে স্মৃতিচারণ রয়েছে। প্রথমেই লিখেছেন বারিধি রায়ের গল্প 'আগুন' এর জন্য সুনীল কর যে ছবি এঁকেছিলেন তা ছিল হতাশাকর। 

এরপর নানা বিচ্ছিন্ন প্রসঙ্গ এসেছে। অসংকোচে জীবনানন্দ স্বীয় জীবনের পাওয়া না-পাওয়ার কথা ব্যক্ত করেছেন। উঠে এসেছে অনেক আপাত মামুলি প্রসঙ্গ যার মধ্যে আমরা এক পর্যবেক্ষণশীল, সুক্ষ্মদর্শী মানুষের অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ করি। 'স্বরাজ' পত্রিকায় চাকুরীর অস্বস্তি ও অনিশ্চয়তার কথা প্রতিফলিত হয়েছে। আর্থিক সুবিধা থাকলেও মানসিক শান্তির ব্যাঘাতের কথা লিখেছেন। তাঁর কবিতার অনুরাগী পাঠক প্রভাকর সেনের সঙ্গে কথোপকথন ও কলকাতার কফি হাউজে যাতায়াতের কথা বিস্তর পরিসর নিয়েছে। জীবনের ব্যর্থতা ও হতাশার কথা, অচরিতার্থ কামনা ও হস্তমৈথুনের কথা, নিজের খৎনার কথা, আত্মহননের মধ্য দিয়ে সব সমস্যা সমাধানের সম্ভাব্যতার কথা ইত্যাদি লিখেছেন জীবনানন্দ যখন যা মনে এসেছে। এক জায়গায় লিখেছেন: "স্বরাজ-এর চাকরি কেবল ভিন্ন আদলে সমান এক নরকভোগ।" 

অন্যত্র আমরা পড়ি জীবনানন্দ লিখেছেন: "প্রায় প্রতিরাতেই ভাবছি জীবনের সমস্যাজট আত্মহত্যার মাধ্যমে শেষ করে দেয়ার কথা ... কারণ (১) 'স্বরাজ' পত্রিকায় চাকুরীর অনিশ্চয়তা; (২) কলকাতার জীবন একদম একঘেয়ে, তিক্ত এবং একাকী; (৩) পৃথিবীর কোথাও না আছে নিশ্চয়তা না আছে মর্যাদা; (৪) কোনো মেয়েমানুষ নেই-- কোনো প্রেম নেই-- আর আমি দ্রুত বার্ধক্যগ্রস্ত হয়ে পড়ছি; (৫) হেরোডিয়াসের কন্যারা; (৬) ব্যর্থতার অতলান্ত হতাশাবোধ। 

এ প্রসঙ্গে বলা দরকার যে, বারবার আত্মহত্যার কথা লিখলেও আত্মহত্যা করার মতো মানুষ ছিলেন না জীবনানন্দ। তার দিনলিপিতে আত্মহনন প্রসঙ্গ তার গভীর হতাশার কথা তুলে ধরেছে মাত্র। একজায়গায় লিখেছেন, "তবে আরও কয়েকটি বই প্রকাশ এবং আমার পাণ্ডুলিপিগুলির একটা পরিপাটি ব্যবস্থা না-করা পর্যন্ত আত্মহত্যা আমি করবো না।"

৫. 
উপরিউক্ত দিনলিপিতে জীবনানন্দ একজায়গায় লিখেছেন, "কান্তি বল --- সুশীল রায়ের গল্প 'রাহু'র যে ইলাস্ট্রেশন সে করেছে সেটি চিত্তাকর্ষক, এবং যদিও কোনো একটি বিদেশী ম্যাগাজিনের অনুকরণে করা (ওরা এ কাজ প্রায়ই করে থাকে), এ গল্পটির সঙ্গে খুব  যায়। সে "স্বরাজ"-এর শিল্পী হিসেবে নিযুক্তির চেষ্টা করছে।"

কান্তির কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে জীবনানন্দের পর্যবেক্ষণ: সে গল্প পড়ে দেখে। মনে হয় কেমন অলংকরণ দরকার সে বিষয়ে ধারণা লাভের চেষ্টা করে। কিন্তু পরমার্শও চায় --- এ ব্যাপারে আমি খুব একটা সাহায্য করতে পারি না (আমি নিজেই কি যথেষ্ট মনোযোগ সহকারে গল্পগুলো পড়ি? ...) ... তবে মোক্ষম পরামর্শ দেয়ার অনেক লোকজন আশেপাশে আছে ।

পত্রিকায় যারা লিখতেন বা অলংকরণ করতেন তাদের সম্মানীর প্রদানের স্বরাজ কর্তৃপক্ষের হাতটান ছিল। এ বিষয়ে পরিচ্ছন্ন নীতিও ছিল না। জীবনানন্দ দিনলিপিতে লিখেছেন, "আমার কেনো ধারণাই নেই কোন ছবি বা কোন ব্লকের জন্য কত টাকা প্রদেয় হতে পারে, বা কেমন করে বিল বানাতে হয় এবং কীভাবে তা অনুমোদন করতে হয়।"

জীবনানন্দ লিখেছেন, "কান্তির উদ্ভট অভ্যাস হলো সবসময় বাড়িয়ে বিল করা আর, অফিসে নয়, ব্যক্তিগত বাড়ীতে এসে আমাকে দিয়ে ওগুলো অনুমোদন করিয়ে নেয়া।-- সে হয়তো ধরে নিয়েছে আমি একটা নিরেট গর্দভ।"  -- বাড়িয়ে বানানো বিল অনুমোদনে জীবনানন্দ অনীহ ছিলেন। 

চিত্রকর কান্তির প্রতি জীবনানন্দের সহানুভূতি থাকলেও গোবিন্দ চক্রবর্তীর গল্প 'অন্ধকার বনপথে'-এর জন্য তার করা অলংকরণটি বিপর্যয় ডেকে আনে। চারদিক থেকে সমালোচনার ঝড় ওঠে। কেউ বললেন, এটি বটতলার বইয়ের উপযুক্ত হয়েছে, আরেক জন বললেন, এটি 'রমা ও মোহন' জাতীয় অলংকরণ। এ সব শুনে জীবনানন্দ লিখেছেন: ''আমি যারপরনাই হতবুদ্ধি হয়ে পড়লাম-- আমার উচিৎ ছিল ছবিটা বাতিল করে দেয়া, এমনকি ইলাস্ট্রেশন ছাড়াই গল্পটি ছেপে দেয়া-- এমনকি কান্তি নিজে আমাকে দুষতে লাগলো-- এবং যদিও অজিত কে. প্রমুখ ছবিটা অনুমোদন করে দিয়েছিল টু শব্দটি না ক'রে এবং আমাকে এটি ছাপতেই হতো-- কারণ একটি বিকল্প ছবির ব্যবস্থা করার কোনো সময়ই হাতে ছিল না এবং ইলাস্ট্রেশন ছাড়া গল্প মুদ্রণ (আমার কাছে গ্রহণযোগ্য হলেও) অন্য কারো কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি-- কিন্তু আমার যুক্তিটা অজিত কে. এবং কান্তি (ভণ্ডের দল) কারো মনঃপুত হলো না।" 

দিনলিপি থেকে আমরা জানতে পারি 'পূর্ব্ববসন্ত'র ইলাস্ট্রেশান কান্তি বলকে একেবারে শেষ করে দেয় এবং 'পদক'এর ইলাস্ট্রেশান দিয়ে স্বরাজে চিত্রকর গোপাল সরকারের উত্থান ঘটে। জীবনানন্দ লিখেছেন, "কিছু দিন ও বেশ পাত্তা পেল কিন্তু 'প্রতিবাদ' এর ইলাস্ট্রেশান ওকে ডুবিয়ে দিল।"

৬. 
সেকালেই দৈনিক পত্রিকা থেকে শারদোৎসব সংখ্যা প্রকাশের চল হয়েছিল। নতুন দৈনিক হলেও স্বরাজের কর্তৃপক্ষ আগেভাগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে স্বরাজ শারদোৎসব সংখ্যা প্রকাশ করবে। এ সংখ্যার জন্য সম্পাদকীয় দায়িত্ব দেয়া হয় জীবনানন্দ দাশকে। তাতে অফিসে তাঁর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তিনি তাঁর দায়িত্ব পালনে তৎপর হয়ে ওঠেন। পরিচিত-অপরিচিত সাহিত্যিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন জীবনানন্দ উপযুক্ত লেখা সংগ্রহের জন্য। 

৩০.৭.৪৭ তারিখে কথাসাহিত্যিক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তকে লেখা চিঠিতে  জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন: "স্বরাজে'র পূজো সংখ্যার জন্যে তোমার একটি শ্রেষ্ঠ গল্প পাঠিও। সর্বোচ্চ দক্ষিণা পঞ্চাশ টাকার কম হবে না। তোমাকে সর্বোচ্চ দক্ষিণাই দেওয়া হবে।" -- উল্লেখ্য যে জীবনানন্দের অনুরোধের সূত্রে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত তাঁর 'হাট-বাজার' গল্পটি পাঠিয়ে ছিলেন এবং তা মুদ্রিত হয়েছিল। তবে অচিন্ত্যকুমার প্রতিশ্রুত পঞ্চাশ টাকা পেয়েছিলেন কি না তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। লেখকদের সম্মানী প্রদানের বিষয়ে 'স্বরাজ' কর্তৃপক্ষের হাতটান জীবনানন্দকে অনেক সময় বিব্রত অবস্থায় ফেলে দিত।  

'স্বরাজ' শারদোৎসব সংখ্যা প্রকাশের আগেই জীবনানন্দের চাকুরীর অবসান ঘটে। তবে ক্লিনটন বুথ সিলি ২৭২ পৃষ্ঠার 'স্বরাজ' শারদোৎসব সংখ্যা দেখেছেন। তাঁর মতে, মুদ্রণ ও প্রকাশ দেখার সুযোগ না পেলেও সব লেখা যে জীবনানন্দেরই সংগ্রহ তাতে সন্দেহ নেই। এ সংখ্যায় নীহাররঞ্জন রায় প্রবন্ধ লিখেছিলেন যার শিরোনাম 'স্বাধীনতা ও সংস্কৃতি'। কবি অমিয় চক্রবর্তীর রচনাটির শিরোনাম ছিল 'বাংলা নাট্যমঞ্চের ভবিষ্যৎ'। বারোটি কবিতার মধ্যে আশরাফ সিদ্দিকীর একটি কবিতা মুদ্রিত হয়েছিল। এ কবিতার শিরোনাম ছিল 'সাহারার মেয়ে সাবেরা'। তবে জীবনানন্দের নিজের কোনো কবিতা স্বরাজের শারদোৎসব সংখ্যায় ছিল না। 

উল্লেখযোগ্য যে, জীবনানন্দ যে আট-নয় মাস স্বরাজে চাকুরী করেছেন, সে সময় তাঁর কোনো কবিতা স্বরাজে ছাপেন নি। তবে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আগস্টে মাসে 'রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ক্ষুদ্রায়তন একটি গদ্য লিখেছিলেন। তিনি 'মনমর্মর' নামে একটি সাহিত্য বিষয়ক রচনার বিভাগ চালু করেছিলেন। দু:খের বিষয় 'স্বরাজ' শারদোৎসব সংখ্যার সর্ববিধ সম্পাদকীয় দায়িত্ব পালন করলেও সম্পাদক হিসাবে গঙ্গাপত বসু ও নারায়ণ ভৌমিকের নাম মুদ্রিত হয়েছিল। 

কথিত রয়েছে যে, ৩০শে সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ তারিখে দৈনিক স্বরাজের সহকারী সম্পাদকের পদ থেকে কবি জীবনানন্দ দাশকে বিদায় দেয়া হয়। ভূমেন্দ্র গুহ জানিয়েছেন, "স্বরাজ" ১৯৪৭ এর আগস্টে একটি 'নজরুল সংখ্যা' প্রকাশ করেছিল। এ সংখ্যার জন্য ভূমিকাস্বরূপ কবি নজরুল ইসলামকে নিয়ে একটি ক্ষুদ্র নিবন্ধ লিখেছিলেন জীবনানন্দ দাশ। এটি মুদ্রিত হওয়ার আগেই প্রুফরিডারদের কল্যাণে স্বরাজের অভ্যন্তরে বিতর্কের সূত্রপাত ঘটে। নজরুলের কাব্যসিদ্ধি বিষয়ে জীবনানন্দের মূল্যায়ন সম্পাদক ও অন্যান্যদের অসন্তুষ্ট করেছিল। পত্রিকার সম্পাদক সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার চাননি প্রবন্ধটি ছাপা হোক। কিন্তু জীবনানন্দ তা কিছুটা সংশোধন করে মুদ্রণ করেন। এরই ফলশ্রুতিতে সম্পাদক সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার জীবনানন্দকে চাকুরীচ্যূত করেন। এ প্রবন্ধের শুরুটি ছিল এরকম: 'নজরুল ইসলামের কবিতার বই সম্প্রতি আমার হাতের কাছে নেই।'

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh Bank dissolves National Bank board

Bangladesh Bank again dissolves National Bank board

The bank’s sponsor director Khalilur Rahman made the new chairman

2h ago