আখতারুজ্জামান ইলিয়াস: সৃষ্টিশীলতার অনন্য এক পথিকৃৎ

তখন তার এক পা নেই, ক্যানসারের কারণে কেটে ফেলতে হয়েছে। ওই সময়ও ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ভেবে চলেছেন তার নতুন উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে। চিলেকোঠার সেপাই, খোয়াবনামার পর নতুন উপন্যাসের কাজ ততদিনে অনেক দূর এগিয়ে এনেছেন তিনি। কৈবর্ত বিদ্রোহ, মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিসহ নানা প্রেক্ষাপট ও সময় নিয়ে এই উপন্যাসের প্রেক্ষাপট বিশাল। উপন্যাসের নাম ইলিয়াস ঠিক করেছিলেন ‘করতোয়া মাহাত্ম্য’।
শিল্পীর কল্পনায় আপন সৃষ্টিতে নিমগ্ন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। এঁকেছেন আরাফাত করিম।

তখন তার এক পা নেই, ক্যানসারের কারণে কেটে ফেলতে হয়েছে। ওই সময়ও ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ভেবে চলেছেন তার নতুন উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে। চিলেকোঠার সেপাই, খোয়াবনামার পর নতুন উপন্যাসের কাজ ততদিনে অনেক দূর এগিয়ে এনেছেন তিনি। কৈবর্ত বিদ্রোহ, মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিসহ নানা প্রেক্ষাপট ও সময় নিয়ে এই উপন্যাসের প্রেক্ষাপট বিশাল। উপন্যাসের নাম ইলিয়াস ঠিক করেছিলেন 'করতোয়া মাহাত্ম্য'।

কেটে ফেলা পা নিয়ে কৌতুক করতেও ছাড়তেন না ইলিয়াস। বলতেন, 'দেখ, আমার যে পা টা নেই সেখানে প্রায়ই মশা কামড়ায়। মশা মারতে যাই। মশা কোথায়, পা-ই তো খুঁজে পাই না!'

কলকাতায় তার পা কাটা হয়। তাকে যখন কলকাতায় নেওয়া হচ্ছে তখন পথে এক ভক্ত এগিয়ে আসেন ছবি তুলতে। রসিক ইলিয়াস বলে উঠলেন, 'এই, ভালো করে ছবি তুলবে। যেন ২ পায়ের ছবিই উঠে। নইলে তো কেউ বিশ্বাস করবে না আমার ২টা পা ছিল।'

ইলিয়াস তখন শারীরিকভাবে বিধ্বস্ত হলেও তার মনের অবস্থা তখনো টনটনে। হাসপাতালে তাকে দেখতে গিয়েছিলেন তার বন্ধু আরেক প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক শওকত আলী। ইলিয়াসের পা ও তার শারীরিক অবস্থা দেখে কেঁদে দিয়েছিলেন শওকত আলী। ইলিয়াস এসব আবেগকে পাত্তা দিতেন না। ভেতরে কোমল হলেও বাইরে শক্ত ইলিয়াস ধমকে উঠে বলে উঠলেন, 'আশ্চর্য! পা গেল আমার, তুমি কাঁদছ কেন?'

বলে রাখা ভালো, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এক সময় থাকতেন শওকত আলীর হাটখোলা রোডের বাড়ির নিচতলার একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে। তারপর চলে গিয়েছিলেন শওকত আলীর বাড়ি থেকে সোজা পূর্বদিকে রোজ গার্ডেনের কাছাকাছি একটা বাড়ির নিচতলার ফ্ল্যাটে। বেশ অনেক বছর সেই বাড়িতে ছিলেন তিনি‌। তারপর চলে গেলেন আজিমপুরে। কিন্তু শওকত আলীর সঙ্গে তার বন্ধুত্ব ছিল আজীবন। এই ২ কিংবদন্তি সাহিত্যিক ছিলেন জগন্নাথ কলেজের শিক্ষক। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, তাদের ২ জনের জন্মই একই দিনে অর্থাৎ ১২ ফেব্রুয়ারি। শওকত আলী ইলিয়াসের চেয়ে ৭ বছরের বড় ছিলেন। কিন্তু তারা একে অন্যকে তুমি বলেই সম্বোধন করতেন।

কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামান স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন, 'ইলিয়াস ভাই আড্ডায় মজা করে বলতেন, আমার রক্তের গ্রুপ পি অর্থাৎ পোয়েট। অন্যের রক্তের সঙ্গে মিলবে না। তিনি বলতেন লেখকদের রক্ত আলাদা, কিন্তু তাই বলে লেখকদের জন্য জীবনের একটা সিংহাসন তিনি দাবি করতেন না। লেখক হয়েছেন বলে তার যাবতীয় বেপরোয়া জীবনযাপনের লাইসেন্স আছে বলে তিনি মনে করতেন না। তিনি মনে করতেন, জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের মতো লেখাও একটা কাজ। আর লেখা দাবি করে ব্যাপক শ্রম ও নিষ্ঠা। যে নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি শিক্ষকতা করতেন, সেই নিষ্ঠার সঙ্গে লিখতেন। সাহিত্যিক দলাদলিতে তার কোনো আগ্রহ ছিল না। ডায়েরি সম্পাদনা করতে গিয়ে দেখেছি, তার সবসময় দলবাজ লেখকদের প্রতি তীব্র ক্ষোভ।

ইলিয়াস ভাই প্রথম জীবনে সাহিত্যিকদের সঙ্গে প্রচুর আড্ডা দিলেও পরবর্তীকালে দেখেছি তার বাসায় যাদের সঙ্গে তিনি সময় কাটাতেন তাদের অধিকাংশই কোনো লেখক-সাহিত্যিক নন। দেখতাম তিনি তার সব লেখার অনুমোদন নিতেন তার বন্ধু মাহবুবুল আলম জিনুর কাছ থেকে, সাহিত্য জগতে যার কোনো পরিচিতিই নেই। জিনু ভাইকে তিনি তার খোয়াবনামা উৎসর্গ করেছিলেন।

তিনি থাকতেন ভাড়া বাড়িতে, চলাফেরা করতেন পাবলিক বাসে। খুব সাদামাটা জীবনযাপন করলেও বিলাতিদের মতো পাইপ টানতেন, লিখতেন টাইপ রাইটারে। এসব ছিল তার শখ। অথচ সেই পাইপটানা মানুষটিকে গোবিন্দগঞ্জের হাটে যখন এক গরুর ব্যবসায়ীর সঙ্গে আলাপ করতে দেখেছি, মনে হয়েছে যেন তারা কতকালের আপনজন। পরিষ্কার মন ছিল তার, অপার কৌতূহল ছিল মানুষের ব্যাপারে।'

বাংলা সাহিত্যে স্বতন্ত্র ভাষারীতির আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তার নিপুণ সাহিত্যকর্মের কারণে প্রসিদ্ধ হয়ে থাকবেন। তার আয়ুর মতো তার লেখার সংখ্যাও খুবই কম। মাত্র ২টি উপন্যাস, ২৮টি গল্প, কয়েকটি প্রবন্ধ মিলে একটি প্রবন্ধ সংকলন। এই নিয়েই তার সাহিত্যের পরিধি। এত স্বল্প সৃষ্টিকর্ম, কিন্তু ইলিয়াস স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তার ভাষারীতির জন্য। ইলিয়াসকে যদি সংখ্যার বিচারে আমরা বিচার করি তবে তা বড় ভুল হবে। তিনি কখনো সংখ্যার বিচারে লিখেননি। ইলিয়াস নিজেকে বলতেন, ২৪ ঘণ্টার লেখক। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার সঙ্গী ছিল টাইপ রাইটার। দুপুর নেই, রাত নেই, সন্ধ্যা নেই খটখট চলছে সেই টাইপ রাইটার। একেকটা গল্প লিখতেই তার কখনো কখনো চলে যেত সপ্তাহ।

সাহিত্যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের হাতেখড়ি হয়েছিল কবিতার মধ্য দিয়ে। মূলত তিনি শখের বশেই কবিতা লিখতেন। এরপর ধীরে ধীরে কথাসাহিত্যে চলে এলেন। প্রথম গল্পগ্রন্থেই উঠে এলেন আলোচনায়। হাসান আজিজুল হক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের 'অন্য ঘরে অন্য স্বর'পড়ে বলেছিলেন, 'এটি তীরের মতো ঋজু, ধানি লঙ্কার মতো বদমেজাজি, পরনারীর মতো আকর্ষণীয়।'ইলিয়াস কবিতাকে প্রথম সম্বল করেছিলেন ঠিক, কিন্তু তারপর পুরোপুরি কথাসাহিত্যে মনোযোগ দিলেন।

ইলিয়াসের কম লেখার কারণ হয়তো সাহিত্যের মানের প্রশ্নে। ইলিয়াস করতে চেয়েছেন পুরোপুরি বিশুদ্ধ ধারায় সৃষ্টি। এজন্যই তিনি ছিলেন ভীষণ নিরীক্ষাধর্মী। তাই ইলিয়াসের ভাষারীতির সঙ্গেও কারো মিল পাওয়া যায় না। ইলিয়াসের সাহিত্যকে বলা যায় নারকেলের খোলস। বাইরে শক্ত আবরণ,খোসা ছাড়ালেই নিঃসৃত রস। বাস্তবতার নিপুণ চিত্রণ, ইতিহাস ও রাজনৈতিক জ্ঞান, গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও সূক্ষ্ম কৌতুকবোধ তার সৃষ্ট কথাসাহিত্যকে দিয়েছে এক ব্যতিক্রমী সুষমা।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। ছবিটি তুলেছেন তার বন্ধু কবি ওমর শামস।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের জন্ম তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষের সময়। তেতাল্লিশের মন্বন্তরে জন্ম নেওয়া ইলিয়াস বাস্তব জীবন দেখেছিলেন খুব কাছ থেকে। তাই স্বাভাবিকভাবেই তার লেখায় সংগ্রাম, ক্ষুধা, অভাব, হাহাকার, দারিদ্র, নিপীড়ন বারবার উঠে এসেছে। কথাসাহিত্যে ইলিয়াসের নান্দনিকতা ঈর্ষণীয়। ইটের পর ইটের গাঁথুনিতে যেমন গড়ে উঠে ইমারত, ইলিয়াস তেমনই গড়েছেন তার সাহিত্যকে। ৩০ বছরের সাহিত্য জীবনে ইলিয়াস নিজেকে বারবার গড়েছেন, ভেঙেছেন, আবার নতুন করে গড়েছেন। ছোটগল্পে তিনি সৃষ্টি করেছেন এক নতুন ধারা।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তরুণ লেখককের সবসময় প্রাধান্য দিতেন। নানাভাবে পরামর্শ যেমন দিতেন, তেমনই উদ্দীপ্ত করতেন।

কবি ও সাংবাদিক ফারুক ওয়াসিফ লিখেছেন, '.... এর মধ্যে ইলিয়াস এলেন। জানতে চাইলেন কী করি। বলা হলো। কথায় কথায় উনি বললেন, ''তোমার গল্পগুলো পড়তে দেবে? আমি পড়তে চাই।'' বালকের প্রথম অহংবোধ আমাকে মনের ভেতর খাড়া করে ফেলল। বলে ফেললাম, ''আমরা তো আপনার লেখা খুঁজে খুঁজে পড়ি। আমার লেখা যদি সত্যিই পড়তে চান তাহলে আপনিও খুঁজে নেবেন। আজিজ মার্কেটসহ বিভিন্ন জায়গায় পত্রিকাগুলো পাওয়া যায়।'' এমন কথায় অন্য কারো হয়তো ভ্রু কুঁচকে যেত। কিন্তু ইলিয়াসের কণ্ঠে অগাধ প্রশ্রয় আর আগ্রহ। বললেন, ''আলবৎ! তাই তো, তাই তো, আমি অবশ্যই খুঁজে নিয়ে পড়ব।'' তারিফ করতে করতে এ গল্পটা তিনি ঢাকায় এসে অনেককে করেছিলেন। এক উঠতি তরুণের আত্মশ্লাঘাকে স্বীকৃতি দিয়ে তিনি আসলে লেখকের আত্মমর্যাদাবোধেরই জ্বালানি জুগিয়েছিলেন সেদিন।'

ইলিয়াসের সাহিত্যের অন্যতম প্রধান দিক হচ্ছে, ইলিয়াস ছিলেন নির্মোহ সাহিত্য সমালোচক। কারো লেখা যদি তার ভাল না লাগত, যত পছন্দসই মানুষই হোক না কেন তিনি তার লেখার প্রশংসা করতেন না।

কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন তার স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন, 'আমরা একবার তাকে এক লেখক সম্পর্কে ধরলাম। সেই লেখক ইলিয়াস ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ। সেই লেখকের নাম ধরে বলা হলো, ''তিনি লেখেন কেমন? তার লেখা আপনার কেমন লাগে?'' ইলিয়াস ভাই বললেন, ''সে মানুষ খুব ভালো।'' তারপর কথা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিলেন। কিছুক্ষণ পর আবার জিজ্ঞেস করলে ইলিয়াস ভাই পাইপ টানতে টানতে বললেন, ''বললাম তো সে লোক খুব ভালো।'' তারপর আবার অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন। প্রশ্নকর্তা নাছোড়বান্দা। কিছুক্ষণ পর আবার বলল, ''বললেন না তিনি লিখেন কেমন?'' ইলিয়াস ভাই খুবই সিরিয়াস মুখ করে বললেন, ''না না, তুমি বুঝতেই পারছ না সে লোক খুব ভালো।'' আমরা হাসতে লাগলাম। বুঝে গেলাম তিনি ওই লেখকের লেখা নিয়ে কথা বলবেন না।

বাংলাদেশ লেখক শিবিরের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। লেখক শিবির প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল প্রগতিশীল লেখকদের সংগঠিত করা। লেখক শিবির থেকে নব্বইয়ের দশকে 'লেখক শিবির তৃণমূল' নামে একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়, যার সম্পাদক ছিলেন ইলিয়াস নিজেই।

ক্যানসারে আক্রান্ত এবং এক পা হারিয়েও আখতারুজ্জামান ইলিয়াস শেষদিকে চেয়েছিলেন অন্তত কয়েক বছর যেন তিনি বেঁচে থাকেন। তাহলে তিনি তার ঐতিহাসিক 'করতোয়া মাহাত্ম্য' উপন্যাসটির কাজ শেষ করতে পারবেন। কিন্তু তা আর হলো না। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস প্রায় সময়ই বলতেন, 'একজন মানুষের অন্তত ৩০০ বছর বেঁচে থাকা উচিত।' কিন্তু ইলিয়াস চলে গেলন চিরতরে মাত্র ৫৪ বছর বয়সেই।

বেঁচে থাকলে আজ ৮০ বছরে পূর্ণ হতো আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের। বাংলা কথাসাহিত্যে ইলিয়াস স্বল্প সৃষ্টিতেও যে অবিস্মরণীয় উপাদান রেখে গেছেন, তা তাকে চিরস্মরণীয় করে রাখবে নিঃসন্দেহে। জন্ম দিবসে বাংলা কথাসাহিত্যের বিরলতম প্রতিভা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

তথ্যসূত্র:

ইলিয়াসের স্যান্ডেল, কবুতর অথবা পরম্পরার কথা/ শাহাদুজ্জামান

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ডায়েরি/ সম্পাদনা- শাহাদুজ্জামান

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস: আম্মার ঘরে কী ফেলে এসেছিলেন?/ ফারুক ওয়াসিফ

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English
Bangladeshi ship hijacked by Somalian pirates

MV Abdullah: Pirates bring in food as stock starts to deplete

As food stock in the hijacked Bangladeshi ship MV Abdullah was depleting, pirates recently started bringing in food.

15h ago