মধ্যদুপুরে আয়েশি শয্যার সমরেশ

সমরেশ থাকবেন স্বপ্নভঙ্গের অনিমেষে, থাকবেন জীবন যুদ্ধের ফিনিক্স পাখি দীপাবলির মাঝে, জয়িতার আত্মবিশ্বাসে কিংবা আমাদের অপ্রতিরোধ্য কৈশোরের সমগ্র স্বপ্ন বুননে।
সমরেশ মজুমদার
সমরেশ মজুমদার। ছবি: সংগৃহীত

ডুয়ার্সের চা বাগান, নুড়ি পাথরে ঢাকা আঙরাভাসা নদী, ভুটান থেকে নেমে আসা ঢল, অদূরে তিস্তার ঘ্রাণ। স্বর্গছেঁড়া চা বাগানঘেরা পাহাড়ি আঁকাবাকা সেই পথ মিলেছে দূর পাহাড়ে। শাল সেগুনের সারি সরিয়ে মাঝেমাঝে চোখে পড়ে দু-একটা ঘরবাড়ি। দূরের পাহাড়ে হয়তো এখন বৃষ্টি নেমেছে। খুঁটিমারির জঙ্গলে গড়িয়ে যায় তখন কুয়াশার দঙ্গল। আলো আঁধারির সেই স্বপ্নলোকের কল্পনারাজ্যে বুঁদ হয়ে দুপুরবেলার আয়েশি শয্যার মায়া কেইবা কবে ভুলতে পেরেছিল?

গল্পটা আমাদের কিংবা আমাদের বাঙালি মায়েদের। দুপুরবেলা সমস্ত কাজ সেরে খানিকটা জিরিয়ে নেওয়ার বাসনায় বিছানায় এলিয়ে দেয়া তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখ। কিন্তু সে চোখে হারিয়ে খোঁজা এক কালপুরুষ। কল্পনা কিংবা স্মৃতিলোকে গেঁথে থাকা এক অনি তথা অনিমেষ। যা আমাদের দিনে দিনে হয়ে দাঁড়ায় স্বপ্ন যাপনের সঙ্গী। কখনো শিরদাঁড়া উঁচু করে বাঁচার প্রেরণা, কখনো বিপ্লব, প্রেম, নিষিদ্ধাচার, সমাজতন্ত্র, শেষতক হয়তো স্বপ্নভঙ্গের তীব্র হাহাকারে মোড়ানো যাপিত জীবন আমাদের গ্রাস করে।

আমাদের সেই আয়েশি শয্যার মাঝেই ধীরে ধীরে অনি হয়ে উঠত অনিমেষ; একসময় আবির্ভূত হতো মাধবীলতা, সাতকাহনের দীপাবলি, গর্ভধারিণীর জয়িতা, আনন্দ, সুদীপ কিংবা কল্যাণ। এমন কত আয়েশি মধ্য দুপুর গড়িয়েছিল শেষ বিকেলে। মধ্য রাত ফুরিয়েছিল ভোরের সূর্য কিরণে, ইয়াত্তা নেই তার। অনিমেষ কলকাতায় উঠে এসেছিল স্বর্গছেঁড়া চা বাগান থেকে। অনিমেষের স্রষ্টা উঠে এসেছিলেন তার কল্পলোকের সে একই চা বাগান থেকেই। যদিও নামটা ভিন্ন, স্বর্গছেঁড়া নেহাতই কল্পনা, আঙরাভাসা নদী ঘেরা চা বাগানটির নাম গয়েরকাটা।

সাহিত্যাঙ্গনে তখন এক সমরেশের পাকাপোক্ত আসন। সমরেশ বলতেই একজন, তিনি ভ্রমর কিংবা প্রজাপতির স্রষ্টা সমরেশ বসু। সালটা ১৯৬৭। দেশ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল এক অচেনা তরুণের গল্প 'অন্তর আত্মা'। সেই গল্প ছাপাতে গিয়ে যে ঝক্কি হয়েছিল সেটি আরেক গল্প। গল্প জমা দেয়ার পর সাহিত্য সম্পাদকের আশ্বাস, 'সামনের সপ্তাহেই ছাপা হবে গল্পটি'। শুনে আনন্দে আটখানা হয়ে সাত বন্ধুকে কফি হাউজে খাওয়ালেন তরুণ। কিন্তু অজানা কারণে পরের সপ্তাহে ছাপা হলো না গল্পটি।

পাবলিক টেলিফোন থেকে সম্পাদক বিমল করকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে গল্প ছাপা না হওয়ার বদলা নিলেন তরুণ। ভাবলেন সেই শেষ। কিন্তু দেড় মাস পরে হঠাৎই সেই তরুণের কাছে ফেরত এল গল্পটি।

তরুণের মনে তখন বিস্ময়ের প্রশ্ন। গল্প ছাপা হয়নি ঠিক আছে, তাই বলে ফেরত আসবে। তাও কিনা আবার দেড়মাস পর। কৌতূহল দমন করতে না পেরে বন্ধুদের নিয়ে তরুণ ছুটলেন দেশ পত্রিকার অফিসে। সাহিত্য সম্পাদকের কাছে কৈফিয়ত চাইতেই সাহিত্য সম্পাদকের সহাস্য জবাব, 'গল্প যাওয়ার কথা ছাপাখানায়, কিন্তু ভুলবশত চলে গেছে আপনার ঠিকানায়। আগামী সপ্তাহেই গল্প ঠিক ছাপা হবে।' ঠিক এক সপ্তাহ বাদেই দেশ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল গল্পটি। বিনিময়ে গল্প লেখার পারিশ্রমিক হিসেবে সেই তরুণ পেলেন ১৪ টাকা।

অবশ্য সে তরুণের লেখক হওয়ার কোনো পরিকল্পনা তো দূরের কথা বাসনাই ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় অনেকটা ঝোঁকের বশেই গ্রুপ থিয়েটারে জুড়েছিল সে তরুণ। নামী নাট্যকাররা তখন নতুন থিয়েটারের জন্য নাটক লেখা ছেড়েই দিয়েছেন। কেউ ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। ফলে অভিনেতার সংকট না হলেও সংকট ছিল নাট্যকারের। বন্ধুরাই একবার বলে বসল 'তোর তো লেখার হাত ভালো। একটা নাটক লিখে ফেল।' আবদারটি অগ্রাহ্য করার শক্তি ছিল না তরুণের। তরুণ ভেবেছিলেন নাটক লেখা বুঝি সবজি কেনার মতো সহজ কাজ। নাটকের প্রথম দৃশ্য লেখার পর তরুণের আর অপেক্ষার তর সয় না। বন্ধুদের একত্রিত করে সেই নাটকের দৃশ্য পড়ে শোনানো মাত্রই বন্ধুদের সেকি হেসে কুটিকুটি দশা। এক বন্ধু তো বলেই বসল, 'এ তো নাটকের 'ন' ও হয়নি।'

মুহূর্তেই কালো মেঘে ঢেকে গেল তরুণের মুখ। অবশ্য বন্ধুদের কেউ কেউ সাহস জুগিয়ে বলল, 'তুই তো গল্প পড়িস। আগে একটা গল্প লিখে ফেল, তারপর নাহয় ওটাতে নাট্যরূপ দিস।' তিন দিন বহু ভেবেচিন্তে একটা গল্প লিখলেন তরুণ। কিন্তু নাট্যরূপ দিতে গিয়েই মরণদশা। গল্পের একটি অংশে দৃশ্য ছিল এমন ট্রামে চেপে বাড়ি ফিরছে গল্পের নায়ক। পথিমধ্যে ঝামেলা হওয়ায় গল্পের নায়ককে ট্রাম থেকে ফেলে দেয়া হলো। শুনেই বন্ধুরা হতভম্ভ। মঞ্চে ট্রাম চলবে কী করে! কেউ কেউ বলে বসল, তোকে দিয়ে নাটক হবে না। ওসব কেবল গল্পেই মানায়। শুনে জেদ চেপে গেল তরুণের। নাটকের বদলে তরুণ গল্পটি পাঠিয়ে দিলেন দেশ পত্রিকায়। নানা ঘটনার পর দুমাস বাদে ছাপা হওয়া গল্পটির নাম ছিল 'অন্তর আত্মা'। গল্পের লেখক সমরেশ মজুমদার।

বিগত শতাব্দীর ষাটের দশক। যখন বাংলা সাহিত্যে লেখকেরা করছেন নানাবিধ নিরীক্ষা। ঠিক তখনই সমরেশের হাতে উঠে এল 'বড় পাপ হে'র মতো গল্প। যে গল্পটা সচরাচর আমাদের সাহিত্যিকেরা বলেন না, কিংবা বলতে চান না। যে গল্পটি এক দেহপসারিণীর অন্ধকার জীবনের আত্মকথা।

সমরেশ মজুমদারের উপন্যাসের যাত্রাটা তারও ৮ বছর পরে। সালটা ১৯৭৫। দেশ পত্রিকায় ছাপা হওয়া সেই উপন্যাসের নাম 'দৌড়'। অবশ্য তা স্বনামে নয়, 'গৌচপ্রম' ছদ্মনামে। উপজীব্য রেসের মাঠ। কলকাতার জীবন। চা বাগান থেকে উঠে আসা মফস্বলের সমরেশকে যে প্রথম মুগ্ধ করেছিল রেসের মাঠই।

চা বাগানের মদেসিয়া সমাজ থেকে কলকাতার নিম্নবিত্ত মানুষেররা তার কলমে ধীরে ধীরে উঠে আসেন রক্ত মাংসের জীবনের চরিত্র হয়ে। আঙরাভাসা নদীর কোল থেকে উঠে আসা কোমল হৃদয়ের অনি'র অনিমেষ হয়ে উঠার গল্পটা তাইতো আমাদের বিপুলভাবে আন্দোলিত করে। নকশালপন্থী আন্দোলনে দুচোখে যার বিপ্লবের স্বপ্ন। রাজনীতিকে সমরেশ জড়িয়েছেন জীবনের সঙ্গে। বলতেন 'জীবন তো আর রাজনীতির বাইরে নয়। রাজনীতির অংশই তো জীবন।'

একসময় বাম রাজনীতিতেই ছিলেন অন্তঃপ্রাণ। তার উপন্যাসেও তাই বাম রাজনীতিই ছিল মূল উপজীব্য। সেই বাম রাজনীতির স্বপ্ন, হতাশা, আশা প্রত্যাশা বিপ্লব সমস্ত কিছু মিলিয়েই সমরেশ তুলে আনলেন লেখার পাতায়। সৃষ্টি হলো 'উত্তরাধিকার', 'কালবেলা, 'কালপুরুষ' ট্রিলজি। এ যেন সমরেশের জীবনকাব্য। যেখানে দেখা মেলে ডুয়ার্সের স্বর্গছেঁড়া চা বাগান হতে উঠে আসা অনি নামক এক চরিত্রের। ধীরে ধীরে কলকাতার বাম রাজনীতিতে জুড়ে যায় সে। প্রথম উপন্যাস উত্তরাধিকারে খানিকটা সযতনে চরিত্রের নির্মাণ। যেখানে এক শিশুর শৈশব গাঁথা, অতঃপর কৈশোরে রূপান্তর। তারুণ্যের প্রারাম্ভেই সে মিশে যায় কলকাতার আঙ্গিনায়।

'কালবেলা'য় উঠে আসে অনির রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়া। কলকাতায় আসার দিনই রাজপথে গুলি খেয়ে থুবড়ে পড়া অনি ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়ে নকশালপন্থী আন্দোলনে। যেখানে তার সঙ্গী হয়ে দাঁড়ায় তরুণী মাধবীলতা। কালবেলা যখন দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে বের হচ্ছে তখন নকশাল আন্দোলন ফুরিয়েছে। সমরেশের কলমে উঠে আসতে থাকে বিগত সময়ের অন্তঃপ্রবাহ। বিষয়টি প্রথমে পাত্তা না দিলেও একসময় নকশালপন্থী আন্দোলন উপন্যাসের উপজীব্য হওয়ায় সমরেশ কারো কারো চোখে হয়ে ওঠেন চক্ষুশূল। কারো কারো চোখ 'কালবেলা'য় আটকে যায় বিগত সময়ের স্মৃতিচারণে। স্বপ্নভঙ্গের বেদনা ট্রিলজির পরবর্তী উপন্যাস 'কালপুরুষ' এ। যেখানে আমরা দেখি জেল থেকে ছাড়া পাওয়া বিধ্বস্ত অনিমেষ। ছোট্ট একটি নীড়ে বাস করা মাধবীলতা আর পুত্র অর্কের জীবন সংগ্রাম। যেখানে বেঁচে থাকাটিই সবচেয়ে বড় সংগ্রাম। অনিমেষের চোখে তখন স্বপ্নভঙ্গের বেদনা। ক্রাচ হাতে অনিমেষ, পরনে ঈষৎ মলিন শাড়ির মাধবীলতা যেন আমাদের জীবনেরই একটি অংশ হয়ে দাঁড়ায়। মধ্য দুপুরের আয়েশি শয্যায় আমাদের চোখে কখনো ভর করে জল। সে মোহ ছাড়তে আমাদের ঢের সময় লাগে।

কিংবা সাতকাহনের দীপাবলি। সেই মেয়েটি তো সমরেশের আপন চোখেরই নির্মাণ। বাড়ির পাশে একবার বারো বছর বয়সী এক মেয়ের জোর করে বিয়ে হলো। বিয়ের আট দিন পর বিধবা হয়েই ফিরল মেয়েটি। যা কাঁপিয়ে দিল সমরেশের গোটা অন্তর্জগত।

সেই পরিপ্রেক্ষিতেই সাতকাহনের নির্মাণ। যেখানে প্রধান চরিত্র প্রগতিশীল দীপাবলি। যেখানে আমরা দেখতে পাই একাকী পাখির মতো দীপাবলিকে। জন্মের পরপরই মাকে হারিয়েছে যে, বাবা পাড়ি জমিয়েছে অন্যত্র। মাসি মেসোর কাছে যার বেড়ে ওঠা। কিছু বুঝে উঠার আগেই ১১ বছর বয়সে বিয়ে নামক অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ। সেদিনই প্রথম দীপাবলি জানতে পারল তার পরিচয়। সে তো বিয়ে নয় দায়মুক্তি। বাসর রাতেই স্বামীর মৃত্যু। অতঃপর সমস্ত ছেড়ে পালানো। কিন্তু এই সমাজ কি তাকে ছেড়ে দিয়েছে। বিধবা অপবাদে যাকে মিশিয়ে দেয়া হয় মাটির সঙ্গে। আপন প্রচেষ্টায় তীব্র জেদি মেয়েটি জয় করে সমস্ত কিছু। সাতকাহনের 'দীপাবলি' যেন ছাই থেকে উঠে আসা এক ফিনিক্স পাখি। যে পাখিটির স্বপ্ন গ্রাস করে সব তরুণীকে।

কোথায় ছিলেন না সমরেশ? কোথায় স্তব্ধ হয়েছিল তার সৃষ্টি? গল্প উপন্যাসে সমরেশ যখন পুরোপুরি পাকাপোক্ত। তখন তার হাতে জন্ম হলো অর্জুন কাহিনীর। অতঃপর গল্পের পরিসীমা ছাড়িয়ে সমরেশের সৃষ্টি পৌঁছেছিল কল্পবিজ্ঞানেও।

যার লেখক হওয়ার কোনোরূপ পরিকল্পনা তো দূরে থাক, স্রেফ বাসনাটুকুও ছিল না সে সমরেশ হয়ে দাঁড়ালেন আমাদের অবাধ্য দুপুরগুলোয় স্বপ্ন বোনার সঙ্গী। দুপুর ভেঙে একসময় বিকেল গড়ায়। আমাদের বারান্দাগুলোর মতো ডুয়ার্সের পাহাড়ের চা বাগানে নামে সন্ধ্যা। আঙরাভাসা নদীতে ঢল নামে। নিয়ম মেনে রাতের আঁধার ভেঙে উঁকি দেয় ভোরের সূর্য কিরণ। জীবনের নিয়মে একসময় সমরেশ ফিরে যান আপন গন্তব্যে। কিন্তু আমাদের প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির ছিন্নপত্রে লালিত নিরস দুপুরের চরিত্রগুলোর মায়াভরা চরিত্রগুলো কি তাতে ছিন্ন হয়?

তাইতো সমরেশ, ছিলেন আছেন এবং থাকবেন। তিনি থাকবেন স্বপ্নভঙ্গের অনিমেষে, থাকবেন জীবন যুদ্ধের ফিনিক্স পাখি দীপাবলির মাঝে, জয়িতার আত্মবিশ্বাসে কিংবা আমাদের অপ্রতিরোধ্য কৈশোরের সমগ্র স্বপ্ন বুননে। আমাদের মধ্যদুপুরের আয়েশি শয্যার সেই সমরেশের যে মৃত্যু নেই!

তথ্যসূত্র –

উপন্যাস সমগ্র/ সমরেশ মজুমদার

'লেখক হওয়ার তেমন কোনো পরিকল্পনাই আমার ছিল না'- সমরেশ মজুমদারের সাক্ষাৎকার/ আবুল বাসার

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English
High temperature days record in Bangladesh

High Temperature Days: Barring miracle, record of 76yrs breaks today

At least 23 days of this month were heatwave days, which equals the record set in 2019 for the entire year.

14h ago