আমৃত্যু জনগোষ্ঠীর ভাবনায় ছিলেন সাংবাদিক আকরম খাঁ
![](https://tds-images-bn.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/images/2023/06/12/mohaammd_aakrm_khaan.jpg?itok=jYhxYimv×tamp=1686577321)
মনীষী সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ ও সাহিত্যিক মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ। সাংবাদিকতায় এক প্রবাদতুল্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে ইতিহাসে নিজেকে তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছেন। বিশেষত সাংবাদিকতায় মুসলমানদের আকৃষ্ট করতে তার ছিল বিরাট অবদান। অন্যদিকে ব্রিটিশ ভারতে মুসলমানদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষায় যেসব মুসলমান নেতা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম তিনি। তার লড়াইয়ের হাতিয়ার ছিল সংবাদপত্র ও সাময়িকী। পত্রিকা প্রকাশনার পেছনে তার ভাবনা ছিল, 'যত বক্তৃতা আর সভা করা হোক না কেন, পত্রিকা না থাকলে মুসলমান সমাজের উন্নতি ত্বরান্বিত হবেনা। কারণ দারিদ্র্য ও শিক্ষা বঞ্চিত মুসলমান সমাজের অভাব অভিযোগ তুলে ধরার জন্য ও তাদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ও অন্ধ কুসংস্কার দূর করার জন্য দরকার পত্রিকা'।
হয়তো এই ভাবনা থেকে খুব অল্প বয়সে তার সাংবাদিকতা শুরু করেন তিনি- 'আহলে হাদিস' সাপ্তাহিক পত্রিকার মাধ্যমে। এই পত্রিকায় থাকেননি বেশি দিন। এরপর কাজী আবদুল খালেক সম্পাদিত সাপ্তাহিক 'মহাম্মদি আখবার'য় সহ-সম্পাদক পদে যোগ দেন। এখানে একই পৃষ্ঠায় উর্দু ও বাংলায় দুই ভাষায় কলাম থাকতো। এই সময়ে তিনি নিজস্ব একটি পত্রিকা প্রকাশের বিষয়ও গভীরভাবে ভেবেছিলেন কিন্তু তার আর্থিক অবস্থাটা তেমন ছিল না। তবুও মনে লালিত আশার ওপর ভর করে হাকিমপুরের বাড়িতে যান খালার কাছে এবং খালা এক টাকার ব্যবস্থা করেন এবং তার নিজস্ব সম্বল বলতে তখন পকেটে মাত্র তের পয়সা।
কলকাতা ফিরে এক ব্যবসায়ীর কাছে পান ৫০ টাকা; মোট ৫১ টাকা তের পয়সা নিয়ে ১৯০৩ সালের ১৮ আগস্ট প্রকাশ করেন 'মোহাম্মদী'র প্রথম সংখ্যা। কিন্তু দুর্ভাগ্য, অজানা কারণে প্রেস কর্তৃপক্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা আর ছাপতে রাজী হননি। ওই বছরের শেষে কুষ্টিয়ার উদার ব্যবসায়ী হাজী আবদুল্লাহ- এর সহায়তায় এবং আকরম খাঁ-র সম্পাদনায় মাসিক পনের টাকা বেতনে দ্বিতীয় পর্যায়ে মাসিক মোহাম্মদী'র প্রকাশনা শুরু হয়। পত্রিকাটিতে ধর্মীয় তর্ক-বিতর্কের বিষয় বস্তুই সাধারণত প্রকাশ হতো। পত্রিকার স্বত্বাধিকারী আবদুল্লাহ ছিলেন নিরীহ মানুষ; একবার প্রেসে পুলিশ আসে লেখা প্রকাশের ভয়ে তিনি পত্রিকা ও প্রেসের মালিকানা আকরম খা'কে দিয়ে ওখান থেকে বিদায় নেন। মাসিক মোহাম্মদী পরে পাক্ষিক ও ১৯০৮ সাল থেকে মোহাম্মদী সাপ্তাহিক হিসেবে তারই সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়।
মুসলমানরা বহুদিন পর একটি নিজেদের পত্রিকা পেলেন। যেখানে তাদের নিজের কথা লেখা হচ্ছে। খেলাফত আন্দোলন আকরম খাঁর জীবনকে সর্বভারতীয় ভিত্তিভূমিতে উন্নীত করে। খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে যোগদানের ফলে হিন্দু-মুসলমানগণের মধ্যে সাপ্তাহিক 'মোহাম্মদী'র প্রচার যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। ব্রিটিশ সরকারকে আক্রমণ করে তখন অত্যন্ত তেজোদৃপ্ত ভাষায় 'মোহাম্মদী'তে লেখা ছাপা হতো। এই সময় বিরুদ্ধবাদীরা বিদ্বেষের স্বরে তাকে 'আক্রমণ' খাঁ বলেও অভিহিত করতেন। অল্প সময়ের মধ্যে সাপ্তাহিক মোহাম্মদী বাংলা, আসাম ও বার্মার মুসলমানদের প্রিয় পত্রিকা হয়ে ওঠে। পরবর্তীকালে নজীর আহমেদ চৌধুরী এবং আরও পরে সম্পাদনা করেন মওলানার পুত্র মোহাম্মদ খায়রুল আনাম খাঁ। দেশভাগের পরও কলকাতায় এর প্রকাশ অব্যাহত ছিল। সাপ্তাহিক 'মোহাম্মদী'র মাধ্যমে বহু মুসলমান তরুণকে সাংবাদিকতা পেশায় তিনি উদ্বুদ্ধ করেন এবং অনেকে সাংবাদিকতা পেশায় প্রবেশের সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।
মোহাম্মদী প্রতিষ্ঠান থেকে মওলানা আকরম খাঁ নিজ সম্পাদনায় ১৯১৫ সালে 'আল এসলাম' নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশনা শুরু করেন। উল্লেখ্য ড: মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এই পত্রিকার সহ-সম্পাদক ছিলেন এবং ফজলুল হক সেলবর্ষী পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করতেন। ধর্মীয় চিন্তা প্রকাশের চমৎকার সুযোগ পেয়েছিলেন মওলানা আকরম খাঁ-এই পত্রিকার মাধ্যমে। একই আদর্শে উদ্বুদ্ধ বহু খ্যাতনামা লেখক পত্রিকায় সংখ্যায় লিখেছেন। পত্রিকাটি টানা ৬ বছর প্রকাশ হয়েছিল।
১৯২০সালের ১৪ মে উর্দু দৈনিক 'জামানা' প্রকাশ করেন, সম্পাদক ছিলেন আকরম খাঁ। সে সময়টায় ছিল খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের জোয়ার। এই আন্দোলনের খবরাখবর উর্দু ভাষী জনগণের গোচরে আনার প্রয়োজনে তার এই পত্রিকা প্রকাশর ছিল চিন্তা ভাবনা। প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ মওলানা আবুল কালাম আজাদের বহু গুরুত্বপূর্ণ লেখা 'জামানা'য় প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া ভারতের বহু খ্যাতনামা রাজনীতিবিদরা ওই পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যায় লিখেছেন। খেলাফত আন্দোলন শেষ হয়ে যাবার পর পত্রিকা প্রকাশের আর প্রয়োজন হয়নি, পত্রিকাটির প্রকাশ চার বছর অব্যাহত ছিল। ভারতে উর্দু সাংবাদিকতায় 'জামানা' একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
১৯২১ সালের ডিসেম্বরে মওলানা আকরম খাঁ প্রকাশ করেন দৈনিক 'সেবক'। সাপ্তাহিক 'সেবক'কে দৈনিকে রূপান্তরিত করা হয়। এই সময়ে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সারাদেশ উত্তপ্ত। মহাত্মা গান্ধী থেকে শুরু করে বহু নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। 'সেবক' পত্রিকায় 'অগ্রসর' শিরোনামে এক জ্বালাময়ী সম্পাদকীয় প্রকাশের অপরাধে গ্রেপ্তার করা হয় তাকে। জামানত তলবসহ পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়া এবং এক বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। 'সেবকে'র প্রকাশনা বন্ধ করার সঙ্গেই সাপ্তাহিক 'মোহাম্মদী'কে দৈনিকে রূপান্তরিত করে দৈনিকের প্রকাশনা অব্যাহত রাখা হয়। দৈনিক মোহাম্মদী'র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, মঈনউদ্দীন হুসাইন প্রমুখ। এছাড়াও কাজী নজরুল ইসলাম দৈনিক 'মোহাম্মদী'তে নিয়মিত 'কাতুকুতু' নামে একটি ব্যঙ্গরসাত্মক কলাম লিখতেন। ইতোমধ্যে জনপ্রিয় 'সেবক'-এর ওপর থেকে সরকারী নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে পুনরায় প্রকাশনা শুরু হয়। কাজী নজরুল কিছু দিন এখানে কাজ করার পর চলে যান; কাগজের জনপ্রিয়তায়ও ভাটা পড়ে। আকরম খাঁ কারাগার থেকে বন্ধ করার নির্দেশ দিলে কাগজের প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়।
![](https://tds-images-bn.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/images/2023/06/12/emran_bhai_bangla_web_-_2023-06-12t194227.143.jpg?itok=BlH3ynXx×tamp=1686577540)
সাংবাদিকতার জন্য মওলানা আকরম খাঁ দুঃখ কষ্টকে অবলীলায় বরণ করেছেন। সংবাদপত্রের কণ্ঠকে অবিচল রাখার একাগ্র সাধনা এবং তার এ সম্পর্কিত নিরবিচ্ছিন্ন সংগ্রামের দৃষ্টান্ত শুধু এ উপমহাদেশে নয় বিরল। সংবাদপত্র এবং সাময়িকী ছিল তার জীবনে বেঁচে থাকার রসদ। 'একটি সাপ্তাহিক এবং চারটি দৈনিকেরও তিনি জন্ম দিয়েছেন। সাম্রাজ্যবাদী দমন নীতির খড়গ একটি কাগজের কণ্ঠরোধ করলে প্রায় রাতারাতি আরেকটি কাগজ বের করেছেন। কখনও তিনি সংগ্রামের পথকে নিষ্প্রদীপ হতে দেননি। সাপ্তাহিক মোহাম্মদী, দৈনিক মোহাম্মদী, দৈনিক জামানা, দৈনিক সেবক এবং সবশেষে দৈনিক আজাদ-এ জাগ্রত সাংবাদিক চেতনারই একেকটি অগ্নি ফসল।
পত্রিকা জগতে মওলানা আকরম খাঁর একটি বিশেষ কীর্তি মাসিক 'মোহাম্মদী' পত্রিকার প্রকাশ; এটি ছিল প্রধানত মুসলমান নবজাগরণের কণ্ঠস্বর! পত্রিকাটির দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৯২৭ সালের ৬, নভেম্বর প্রকাশনা শুরু হয়। খায়রুল আনাম খাঁ কর্তৃক মোহাম্মদী প্রেস, ২৯, আপার সার্কুলার রোড, কলকাতা থেকে পত্রিকাটি মুদ্রিত ও প্রকাশিত; পরবর্তীতে কার্যালয়ের স্থানান্তর ঘটে ৮৬-এ, লোয়ার সার্কুলার রোডে। একবিংশ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা (কার্তিক ১৩৫৪) বের হবার পর দু'বছরের জন্য পত্রিকার প্রকাশ বন্ধ থাকে। একবিংশ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা (অগ্রহায়ণ ১৩৫৬) থেকে আবার প্রকাশ পায় ২৭/ক, ঢাকেশ্বরী রোড, ঢাকা থেকে।
এ সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলমান ছাত্ররা 'শ্রীপদ্ম' বিরোধী আন্দোলন সংগঠিত করে তোলেন। ঘটনাটি ছিল, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় মনোগ্রামে শ্রীপদ্ম সংযুক্ত করে। শ্রীপদ্ম হিন্দু ধর্মের সঙ্গে যুক্ত। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এই একদেশদর্শী সিদ্ধান্তে মুসলমান ছাত্ররা ক্ষুব্ধ হয়ে, প্রতিবাদ জানান। 'মোহাম্মদী' পত্রিকা এই আন্দোলনে মুসলমান ছাত্রদের পক্ষে জোরালো ভূমিকা পালন করে। আকরম খাঁ নিজে স্বনামে একাধিক প্রবন্ধ লিখে পরিস্থিতি সৃষ্টি করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে দায়ী করেন। পাশাপাশি 'প্রবাসী' পত্রিকায় রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় শ্রীপদ্মের সমর্থনে প্রবন্ধ লিখতে থাকেন। 'মোহাম্মদী' পত্রিকায় আবার তার জবাব দেয়া হয়। 'মোহাম্মদী' পত্রিকা এসময় মুসলমান ছাত্রদের মুখপত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভকরে। ছাত্রদের আন্দোলন ও 'মোহাম্মদী'র লেখা এই দুইয়ের ফলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অবশেষে মনোগ্রাম থেকে শ্রীপদ্ম বাদ দিতে বাধ্য হন।
মুসলমান ছাত্রদের সঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিমাতৃসুলভ আচরণের স্বরূপ উন্মোচনের জন্য আকরম খাঁ 'মোহাম্মদী'র (নবম বর্ষ, অষ্টম সংখ্যা,জ্যৈষ্ঠ, ১৩৪৩)। একটি বিশেষ 'কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সংখ্যা' প্রকাশ করেন। মুসলমান ছাত্রদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় আকরম খাঁ ও মাসিক 'মোহাম্মদী' পত্রিকা নিঃসন্দেহে সে সময় এক যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেছিল। কোন বিশেষ অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার মধ্য দিয়ে 'মোহাম্মদী' মুসলমান পাঠকের আনুকূল্য লাভ করেছিল। কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে 'মোহাম্মদী'র প্রথম দিকে কোন সংশ্রব না থাকলেও ১৯৩২ সালের দিকে আবুল কালাম শামসুদ্দীন মাসিক 'মোহাম্মদী'তে যোগ দেবার পর তিনিও 'মোহাম্মদী'তে লিখতে শুরু করেন। উন্নতমানের গল্প, কবিতা, প্রবন্ধে মাসিক 'মোহাম্মদী' একটি বিশিষ্ট পত্রিকা হয়ে উঠেছিল পাঠক মহলে।
আকরম খাঁ সাংবাদিক জীবনের সবচেয়ে কৃতিত্বের অধিকারী হয়েছিলেন দৈনিক আজাদ পত্রিকা প্রকাশ করে। তার আগে পর্যন্ত যত পত্রিকা হয়েছে তার সঙ্গে মান ও মর্যাদার দিক থেকে দৈনিক আজাদ ছিল অনন্য ও অসাধারণ। দৈনিকটি আত্মপ্রকাশ করে ১৯৩৬ সালের ৩১ অক্টোবর। 'মুসলিম বাংলার 'প্রাচীনতম' বাংলা দৈনিক পত্রিকা আজাদ প্রকাশিত হয়েছিল উপমহাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলন,ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুসলিম নবজাগরণের পটভূমিতে এক ঐতিহাসিক সময় সন্ধিক্ষণে।
'আজাদ' পত্রিকার দীর্ঘ দিনের সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন পত্রিকাটি সম্পর্কে তার আত্মজীবনীতে লেখেন: 'সেসময় মুসলিম লীগের নবজন্ম লাভের ফলে ভারতের মুসলিম রাজনীতিতে যে উৎসাহ, উদ্দীপনার জোয়ার এসেছিল তাতে দেশের বিভিন্ন স্থান ও মহল থেকে মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ'র কাছে অবিলম্বে একখানা দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশ করার অনবরত তাগিদ আসছিল। ---মওলানার সম্পাদনায় দৈনিক আজাদ প্রকাশিত হলো নির্দিষ্ট দিনে।' তিনি আরও বলেছেন, 'বাঙলার মুসলিম সাংবাদিকতার পরিচয় দিতে বসে এ কথা না বললে সম্ভবত বক্তব্য অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যে, আজাদ থেকেই বাংলায় মুসলিম দৈনিকের স্থায়ী প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছে। ১৯৪০সাল থেকে এর সম্পাদনের ভার পড়ে এই প্রবন্ধের লেখকের উপর এবং তা অব্যাহত থাকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত--।' আজাদ পত্রিকা সম্পর্কে তিনি আর এক জায়গায় লিখেছেন, 'সত্যিই আজাদ বাঙলার মুসলিম সমাজে উৎসাহ উদ্দীপনার যে জোয়ার এনেছিল, তা ছিল অভূতপূর্ব। অল্প দিনের মধ্যেই আজাদ মুসলিম বাংলার জাতীয় দৈনিক মুখপত্র হয়ে উঠল। বাঙলা আসামের সুদূর প্রান্ত থেকে এ কাগজের চাহিদার খবর আসতে লাগল। আজাদকে প্রথম শ্রেণীর কাগজে পরিণত করার জন্য মওলানা এবং আমাদের উৎসাহ ও কর্মতৎপরতার অন্ত ছিল না। ' (অতীত দিনের স্মৃতি)
![](https://tds-images-bn.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/images/2023/06/12/image-39736.jpg?itok=CR-kvgcw×tamp=1686577526)
'নির্ভীক ও স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করার অপরাধে ব্রিটিশ-পাকিস্তান উভয় শাসনামলেই আজাদকে সরকারি কোপ দৃষ্টিতে পড়ে যথেষ্ট ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। তবুও আজাদ পিছপা হয় নি। 'দৈনিক আজাদকে মুসলিম লীগ সরকারের আমলে 'বুঝহ লোক যে জান সন্ধান' শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রকাশ করার অপরাধে তিন বছর কোনো বিজ্ঞাপন দেয়া হয়নি। এর দ্বারা প্রমাণিত হয়, দৈনিক 'আজাদ' দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে দেশ, জাতি ও নীতি আদর্শকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিতো। তাই মুসলিম লীগ সরকারের ভ্রষ্টনীতির বিরুদ্ধে আজাদ প্রয়োজনে কঠোর সমালোচনা করেছে। সেকালে আজাদ ছিল জাতির দিকদর্শন ও পথপ্রদর্শক।
১৯৪৬ সালে ভারতীয় রাজনীতির ধারা নতুনদিকে মোড় নিলে মওলানা আকরম খাঁ একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক 'কমরেড' প্রকাশনা শুরু করেন। পত্রিকাটির প্রথম মালিক ছিলেন মোহাম্মদ আলী। মওলানা আকরম খাঁ-র ছেলে সদরুল আনাম খাঁ পত্রিকাটির স্বত্ব কিনেন খাজা নুরুদ্দীনের কাছে; খাজা নুরুদ্দীন আগেই পত্রিকার স্বত্ব কিনেছিলেন মাওলানা মোহাম্মদ আলী'র কাছ থেকে। এই পত্রিকা প্রথমদিকে মাওলানা আকরম খাঁ, সম্পাদনা করলেও পরবর্তীকালে মুজিবুর রহমান খাঁ ও সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন এই পত্রিকার সম্পাদনা করেন। বাংলা, আরবি, উর্দু, ফার্সি, ইংরেজি প্রভৃতি ভাষায় মাওলানা আকরম খাঁ-এর দখল ছিল ঈর্ষনীয়। সাধারণত তিনি ইংরেজি ভাষা চর্চা করতেন না কিন্তু তার এই ভাষায় জ্ঞানের গভীরতা লক্ষ্য করা যায় 'কমরেড' সম্পাদনা কালে।
'আজাদ' পত্রিকার লেখা সম্পর্কে তিনি অত্যন্ত সজাগ ছিলেন। সাংবাদিকতায় তার একটা ভাষা নীতি ছিল, মুখের ভাষাকে যতটা সম্ভব লেখার ভাষায় স্থান দেয়া। ভাষার সরলীকরণ ও অলঙ্কার-বিহীন ভাষা ব্যবহারের তিনি পক্ষপাতী ছিলেন। এর বিরুদ্ধাচরণ হলে শেষ বয়সেও তাকে ক্ষুব্ধ হতে দেখা যেত।' 'বৃদ্ধ বয়সেও তিনি প্রতিদিন 'আজাদ' খুঁটিয়ে পড়তেন। প্রতিদিনের কাগজ মিলিয়ে দেখতেন ঢাকা, কলকাতা, করাচীর অন্যান্য দৈনিকের সঙ্গে। প্রতিদিনের 'আজাদ-' এ তিনি অনুবাদের ভুল, বাক্যগঠনের ভুল, বানান- এর ভুল, তথ্যের ভুল, তথ্যের অসম্পূর্ণতা সবকিছু লাল পেন্সিল দিয়ে দাগ দিতেন। এসব ভুলের জন্য সংশ্লিষ্ট সাংবাদিককে জবাবদিহি করতে হতো।' (মোহাম্মদ আকরম খাঁ/ মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর।
মওলানা আকরম খাঁ রাজনীতির সঙ্গে তার ছিল সম্পৃক্ততা হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। দেশভাগের পর তিনি পূর্ব বাংলায় চলে যান ও স্থায়ীভাবে ঢাকায় বসবাস শুরু করেন। বিভিন্ন সময়ে তিনি নিখিল ভারত মুসলিম লীগ, পাকিস্তান মুসলিম লীগ প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সহ-সভাপতি ও সভাপতি হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫১ সালে প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং ১৯৫৪ তে গণপরিষদ ভেঙে দিলে তিনি রাজনীতি থেকে অবসর নেন। কিন্তু কখনো রাজনীতি কখনো সাংবাদিকতা সবসময়- সমাজ ও মানুষ নিয়ে ভাবনা ছিল তার আমৃত্যু।
আলিমুজ্জমান, শিক্ষক ও গবেষক। মুর্শিদাবাদ
Comments