লেখক হিসেবে দেশ ছাড়া আমার জীবনের ভুল: হরিপদ দত্ত
হরিপদ দত্ত। প্রভাব বিস্তারকারী একজন কথাশিল্পী। শিক্ষাজীবন কেটেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পেশায় ছিলেন শিক্ষক। জীবিকার প্রয়োজনে পরিবর্তন করেছেন পেশা। যুক্ত হয়েছেন নতুন নতুন পেশায়। লেখাকে ভালোবেসে অনেককিছু থেকে বঞ্চিতও হয়েছেন। সেই আক্ষেপ আজও রয়েছে মনে। তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাস- অজগর, জন্মজন্মান্তর, দ্রাবিড় গ্রাম, মোহাজের, চিম্বুক পাহাড়ের জাতক' প্রভৃতি। এছাড়াও প্রকাশিত হয়েছে গল্প সমগ্র, প্রবন্ধ সমগ্র ও শিশু-কিশোর সমগ্র। সাহিত্যের সাহিত্যের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন ২০০৬ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার।
প্রবাসে দীর্ঘ এগারো বছরপর কথাশিল্পী হরিপদ দত্ত সম্প্রতি এসেছেন ঢাকায়। তার সঙ্গে আগে কখনো আমাদের (আমি ও কথাশিল্পী শামস সাঈদ) দেখা হয়নি, কথাও হয়নি। কিন্তু তাকে জানি আমি। তবে সেদিন কোনো আনুষ্ঠানিক পরিচয় পর্ব ছাড়াই আমাদের আলাপ শুরু। কোনো ভূমিকা ছাড়া নিজেই (হরিপদ দত্ত) করলেন। দৈনিক বাংলার সাহিত্য সম্পাদক আহসান হাবীব বলছেন- 'ও- হরিপদ তোমার কাছে তিনটা টাকা আছে? আমার কাছে ভাংতি নেই, তুমি আমার জন্য এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে আসো। আমি অবাক হচ্ছি যে অনেকের কাছ থেকে তিনি নেবেনও না কিন্তু আমাকে সিগারেটের জন্য পাঠাচ্ছেন। তিনি আমাকে কতটা ভালোবাসেন!
আমি তখন দৈনিক বাংলায় প্রকাশের জন্য একটা গল্প দিয়েছিলাম। কিন্তু গল্পটা তিনি ছাপলেন না, তার পছন্দ হয়নি। তিনি গল্পটা আবার এডিট করতে বললেন। পছন্দ হয়না, আবার ঠিক করতে দিলেন। তৃতীয়বার লেখার পর গল্পটা তার পছন্দ হলো এবং তিনি প্রকাশ করলেন। তিনি শিখিয়েছেন- গল্প কীভাবে লিখতে হয়। তিনি বললেন- শোন, গল্পে তোমার সম্ভাবনা আছে কিন্তু তুমি অমনোযোগী। তোমার কি স্ত্রী সন্তান আছে? আমি বললাম, আমার একটি বাচ্চা আছে। তিনি বললেন 'বুঝেছি ঘরে যুবতী স্ত্রী তো এজন্য লেখালেখি হয় না'। পরপর দৈনিক বাংলায় তিনি তিনটি লেখা ছাপলেন। একদিন বলছেন- হরিপদ, শাহরিয়ার কবিরকে চিন? বিচিত্রায় কাজ করে। তার কাছে যাও, আমার কথা বলো। লেখা নিয়ে গেলাম। এরপর পাঠালেন দৈনিক সংবাদে, সন্তোষ গুপ্তের কাছে। এভাবে আমাকে তৈরি করলেন।
তার মানে দৈনিক বাংলায় তিনি আপনার লেখা ছাপলেন না? তিনি বললেন, ' না, তা নয়। আসলে তিনি আমাকে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। হয়েছেও তাই। তারপর তো সব কাগজেই লিখেছি। এমন সাহিত্য সম্পাদক এখন আর নেই, হবেও না। কিছুদিন পর দৈনিক বাংলায় গেলাম, আহসান হাবীব ডাকছেন- এই.. শুনো, তোমার একটা বিল হয়েছে, নিয়ে যাও। তারপর অফিসের একটা ছেলেকে ডেকে বললেন, ওর লেখার বিলটা নিয়ে আসো। আমাকে ৪০ টাকা দিলেন, লেখার বিল। বললেন- 'এই নাও, ৪০ টাকায় অনেক কিছু হবে'। আমার পেছনে তার অবদান আছে। শুধু তিনি নন, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বদরুদ্দিন ওমর- তাদের অবদান আছে। এবার দেশে আসার মাস দুই আগে, ওমর ভাই হঠাৎ আমাকে ফোন করলেন- হ্যালো, আমি বাংলাদেশ থেকে বদরুদ্দীন উমর বলছি। ওমর ভাই ফোন করেছে, আমিতো ভাবতেও পারি নাই!। ওমর ভাই বলছেন- হরিপদ, ভাই কেমন আছেন? প্লিজ আপনাকে একটা দায়িত্ব দিতে চাই, না করবেন না'। তিনি আমার কাছে তার সংস্কৃতি পত্রিকার জন্য লেখা চাইলেন।
প্রসঙ্গে হরিপদ দত্ত বাংলায় সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে তার আক্ষেপ করে বলছেন- বাংলায় সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বদরুদ্দীন উমর অনেক লেখালেখি করেছেন। এমনটা কম লেখা হয়েছে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক থাকা অবস্থায়ও লিখেছেন। তখন মনে হয়েছে, একটা আশ্রয় পেয়েছি।
আপনি কি লেখক শিবির করতেন? জবাবে বললেন- 'করতাম, তবে সক্রিয় কেউ ছিলাম না। পাশে পাশে থাকতাম। চাঁদা দিতাম। তবে এই লেখক শিবির কিন্তু বদরুদ্দীন উমর এর একার নয়। এর সাথে আবুল কাসেম ফজলুল হক ছিলেন, আরও অনেকে ছিলেন।
বর্তমানে বাংলাদেশের কারা ভালো লিখছেন, কা-দের লেখা পড়ছেন? জবাবে বললেন- আহমদ বশীর এর লেখা পড়েছি। তিনি ইতোমধ্যে ভালো কিছু লেখা লিখেও ফেলেছেন। তিনি অত্যন্ত শক্তিমান লেখক। লেখায় বিরতি দিয়ে তিনি নিজের ক্ষতি করেছেন। দেশের ক্ষতি করেছেন, আমারও ক্ষতি হয়েছে। আমার প্রশ্ন, এমন আত্মঘাতী কাজ কেউ করে? আশা করি- বশীর দ্রুতই লেখায় মনযোগী হয়ে ওঠবেন। আরে আমি ও তো আমেরিকায় ছিলাম। ওখানে আমি হোটেলে কাজ করেছি। ডলার উপার্জন করেছি। উপন্যাসও লিখেছি। একটি উপন্যাস লেখার জন্য কানাডায় চলে গিয়েছিলাম। আমি হাঁটতে হাঁটতে আমেরিকা থেকে কানাডা সীমান্ত পার হয়েছি। সেখানে আমার স্ত্রীর-সূত্রে এক আত্মীয়র বাসায় ছিলাম। আগে থেকেই ওর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। কানাডায় ওর বাসার পাশে একটি নদী আছে, সেই নদীর পাশে বসেই আমি লিখেছি 'জন্মজন্মান্তর' উপন্যাস। উপন্যাসটি রিভিউ করেছিলেন কলকাতার একজন লেখক। রিভিউটা প্রকাশের পর বইটা বেশ বিক্রি হয়। পাঠকও দারুণভাবে গ্রহণ করেছেন।
বাংলা সাহিত্যের বর্তমান অবস্থার কথা বলতে গিয়ে বারবার সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর প্রসঙ্গ আনেন। বাংলা সাহিত্যে আরও আরও সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর জন্ম হোক। তিনি যেভাবে বলতে পেরেছেন, লিখতে পেরেছেন, তা অন্য কেউ পারেনি। 'শস্যের চেয়ে টুপি বেশী, ধর্মের আগাছা বেশী।' চিন্তা করুন তো মুসলমান লেখক হয়েও এমন করে কে বলেছেন?
লেখক সঙ্গের প্রসঙ্গ আনতেই বললেন, সূর্য দীঘল বাড়ির- লেখক আবু ইসহাকের সঙ্গে আমার বেশ সর্ম্পক ছিল। আমি মাঝেমধ্যে তার বাসায় যেতাম। তিনি অনেক খুশি হতেন। তিনি পান খেতে পছন্দ করতেন। আমাকেও পান খাওয়াতেন। যদিও তার পান খাওয়া বারণ ছিল। তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন, আমি জানতাম না। তার স্ত্রী পান খাওয়া পছন্দ করতেন না। এখন অবশ্য আমারও পান খাওয়া বারণ, তবুও খাই।
সব ঠিক আছে। কিন্তু একটু বলবেন কি কেন দেশান্তরী হলেন?
খানিকটা বিরক্ত হয়ে সাম্প্রদায়িক কারণে দেশ ছাড়িনি। পারিবারিক চাপে বাধ্য হয়ে গিয়েছি। তবে আমার আত্মীয়-স্বজন অনেক আগেই ভারতে। বাবাও গিয়েছিলেন। বাবা ব্রিটিশ সরকারের চাকরি করতেন। আমাদের অনেক কৃষিজমি ছিল। আইয়ুব খান যখন ঘোড়াশালে সার কারখানা স্থাপন করলো, তখন আমাদের জমি-জমাসব একোয়ার হলো। বিশাল একটা গ্রাম সরকার দখল করে নিলো। কিন্তু আমরা ক্ষতিপূরণ পেলাম না। তখন ১৯৬৫ সালের দাঙ্গা হয়ে গেছে। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। খুব খারাপ সময় ছিল। তবে, এটা ঠিক লেখক হিসেবে দেশ ছাড়া উচিত হয়নি। ভারতে যাওয়া আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।
কলকাতার পাঠক আপনাকে গ্রহণ করেছে কেমন?। তিনি বলেন, না তারা তো আমাকে চিনেই না। সেখানে আমার কারো সাথে যোগাযোগ নেই। লেখকদের সাথেও নেই। কলকাতার কোনো বাণিজ্যিক কাগজে আমি লিখিনি। তবে কিছু লিটল ম্যাগাজিনে লিখেছি। একবার আমার ছেলে ওর ইউনিভার্সিটির একটি সংকলনে আমার লেখা জোড় করে ছাপতে চাইলো, আমি তাতেও বাধা দিয়েছি।
তার মানে ছাপতে দেননি? 'না'। আমার যা বইপত্র বেড়িয়েছে সব ঢাকা থেকেই।
পুরস্কার নিয়ে কোনো অতৃপ্তি? কোনো অভিমত? জবাবে বললেন- না, না। কোনো অতৃপ্তি নেই। পুরস্কার আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। ছিলও না। আমি তখন কলাবাগান এলাকায় থাকি। আমার বাসায় কাজের লোক একদিন ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে খাটের নিচ থেকে বের করে আনে বাংলা একাডেমি থেকে পাওয়া পুরস্কারের ক্রেস্ট। কীভাবে যে ওখানে পরে থেকে ওটা নস্ট হলো, বুঝতেই পারলাম না। পরে অবশ্য ভেবেছিলাম বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষকে বলে ক্রেস্টের একটা রেপ্লিকা আনবো, কিন্ত তা আর হয়নি।
জীবনে কোনো আক্ষেপ আছে? জবাবে বললেন- আছে...। আর সে আক্ষেপ না জেনেই সময়টা যেন মুহূর্তেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো।
Comments