নিষ্ফলা মাঠের কৃষক, ছাত্র না শিক্ষক?
'একজন শিক্ষক দাঁড়িয়ে ক্লাস নিচ্ছেন। ছাত্ররা লক্ষ্য করল তিনি অসুস্থ। তার মুখ ও শরীর আগুনের আঁচ-লাগা পাতার মতো তিরতির করে কাঁপছে। ছাত্ররা বুঝল স্যার জ্বর নিয়ে পড়াতে এসেছেন। কেবল আজ নয়, কলেজে না-আসা ছিল তাঁর ব্যাকরণের বাইরে। স্যারের অবস্থা অনেককে উদ্বিগ্ন করল। দুয়েকজন মুখ ফুটে এ নিয়ে কথাও বলল। রোজকার মতো শিক্ষকদের চৌকির ওপরে দাঁড়িয়েই পড়াচ্ছিলেন স্যার। এক ছাত্র বলল, 'আপনাকে অসম্ভব অসুস্থ দেখাচ্ছে, স্যার। আপনি বসে পড়ান।'
তিনি বসলেন না। শিক্ষার্থীরা জোরাজুরি করলে না বসার কারণ জানালেন স্যার- 'একটু আগে আমি যখন ক্লাসে এসেছিলাম তখন তোমরা উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে শ্রদ্ধা দেখিয়েছিলে। এখন আমার সম্মান ফেরত দেওয়ার পালা। এখন তোমরা বসে থাকবে, আর সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আমি তোমাদের দেওয়া সেই শ্রদ্ধাকে সম্মান জানাব।'
কথাগুলো অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের কলেজ জীবনের। এভাবেই 'নিষ্ফলা মাঠের কৃষক' বইতে তুলে ধরেন সময়ের চিত্র। স্যারের কথা শুনে বোকা হয়ে গিয়েছিলাম। মানুষের প্রতি কী অসীম শ্রদ্ধাবোধ থাকলেই-না এভাবে ভাবা যায়!'। বইটিতে তিনি তুলে ধরেছেন তার ছাত্রজীবন ও শিক্ষক জীবনের কথা। ছাত্র হিসেবে পেয়েছিলেন মহান শিক্ষকদের সান্নিধ্য, তেমনি শিক্ষক হিসেবেও পেয়েছিলেন উজ্জ্বল ছাত্রদের। ছাত্র ও শিক্ষক হিসেবে শিঙ্গাঙ্গনের সঙ্গে তাঁর পাঁচদশকের নিবিড় সম্পর্ক। মাত্র ২২ বছরে লেখাপড়া করে তিনি শিক্ষাকতা পেশায় নিযুক্ত হন এবং একটানা ৩০ বছর এ পেশায় ছিলেন।
ছাত্রজীবনে অনেক শিক্ষকদের দেখা পেয়েছেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। ৫-৬ বছর বয়সে তিনি যখন প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হন তখন বাড়িতে পড়াতে আসতেন শরদিন্দুবাবু। বহুবছর পর শরদিন্দু স্যারের কথা স্মরণ করে লিখেছেন, 'স্যারের কথা মনে হলে আজও চোখের সামনে দেখতে পাই তেঁতুল, শিমুল আর আমগাছে ছাওয়া কোনো-একটা আশ্চর্য রাস্তা হেঁটে আমাদের বাড়ির দিকে সেই একলা মানুষটি একা-একা যেন কেবলই আসছেন, কেবলই আসছেন।'
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বাবা আযীমউদ্দীন আহমদও ছিলেন একজন শিক্ষক। তাকে নিয়ে লিখেছেন, 'আব্বা ছাড়া যেসব মানুষের নিবিড় ও শ্রদ্ধেয় মুখ আমাকে শিক্ষকতার পথে ডাক দিয়েছিল ছেলেবেলার শরদিন্দুবাবু তাঁদের একজন। শরদিন্দুবাবুর স্নেহের গভীর স্পর্শের ভেতর দিয়ে আমি প্রথম মানুষের ভালোবাসাকে চিনতে শিখি।'
পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অমরবাবু স্যারের কাছে পড়েছিলেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। তিনি ছিলেন রাধানগর মজুমদার একাডেমির শিক্ষক। অমরবাবু ইছামতী নদীর মতো। নদীর দুইধারের দারুচিনি জামরুল আর কাঞ্চনের অপরাভূত শোভার মতো ছিলেন। স্নেহ আর প্রীতি ছাড়া ছাত্রদের কিছুই দিতে জানতেন না। ছাত্ররা পড়া না পারলে এমনভাবে তাদের মনে করিয়ে দিতেন যেন কোনো কারণে হঠাৎ এ-মুহূর্তের জন্যই তারা জবাব দিতে পারছে না। অমর পাল স্যারের কথা স্মরণ করে লিখেছেন, 'উজ্জ্বল সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী প্রিয়দর্শন অমরবাবুর দেবদুর্লভ জ্যোতির্ময় মুখাবয়ব আমি এই মুহূর্তেও চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। কৈশোরের উপেক্ষিত দিনগুলোয় তাঁর কাছে সম্মান আর নিরাপত্তার একটা মমতা স্নিগ্ধ আশ্রয় পেয়েছিলাম আমরা। সেই সম্মানের মর্যাদা রাখার জন্য আরও ভালো করে পড়াশোনা করতে আমরা উদ্দীপ্ত হয়েছি।'
নবম শ্রেণিতে উঠে পাবনা জিলা স্কুলে ভর্তি হন। স্কুলের যেসব শিক্ষক তার কিশোর-হৃদয়কে স্বপ্ন আর ভালোবাসার পৃথিবীতে জাগিয়ে তুলেছিলেন, স্কুলের মওলানা কসিমউদ্দিন আহমদ ছিলেন তাদের সবার ওপরে। কমিউদ্দিন স্যার তাদের উর্দু পড়াতেন। পড়ানোর ভেতর দিয়ে অস্তায়মান মোগল-সাম্রাজ্যের বিষণ্ণ-ধূসর চেহারাটা চোখের সামনে তুলে ধরতেন। মাঝে মাঝে আবৃত্তি শোনাতেন বিখ্যাত সব উর্দু কবিতা। ধার্মিক হয়েও কসিমউদ্দিন স্যার ছিলেন অন্ধত্ব আর সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে। একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধে কসিউদ্দিন স্যার শহীদ হন।
উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হন বাগেরহাট প্রফুল্লচন্দ্র কলেজে। অন্য অনেক শিক্ষকদের পাশাপাশি দেখা পেয়েছিলেন আশ্চর্য এক শিক্ষকের। ইংরেজি বিভাগের খুদা নওয়াজের। তিনি ছিলেন নিঃসঙ্গ আর কিছুটা অসামাজিক। যাকে ভালোবেসেছিলেন, সেই স্ত্রীকে হারিয়ে মানুষের পৃথিবীকেই বিদায় জানিয়েছিলেন খুদা নওয়াজ। নিজেকে সারাক্ষণ ডুবিয়ে রাখতেন বইয়ের ভেতর। শিক্ষার্থীদেরও পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন প্লেটো, পুশকিন, জয়েস, হেগেল, ফ্রয়েড, পাবলভ, আইনস্টাইন, অ্যারিস্টটল- একের পর এক শ্রেষ্ঠ মানুষদের বইয়ের সঙ্গে। সমৃদ্ধ হয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
মাত্র ৭দিনের সিদ্ধান্তে শিক্ষকতা ছাড়ার প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, 'একদিন, তরুণ বয়সে, স্বপ্নতাড়িতের মতন এসে যোগ দিয়েছিলাম শিক্ষকতায়। প্রতিটা শিরা-ধমনিতে সেদিন যা কামড়ে ধরেছিল তা এক উদ্ধাররহিত স্বপ্ন সমৃদ্ধ মানুষ গড়ে তোলার অংশ নেবার স্বপ্ন- সেইসব মানুষ যারা একদিন জাতির জীবনে পালাবদল ঘটাবে। আমার সে স্বপ্ন সফল হয়নি। গত চার দশকে, জাতীয় জীবনের সামগ্রিক অবক্ষয়ের হাত ধরে, আমাদের শিক্ষাঙ্গন ধীরে ধীরে এমন এক নির্বীজ মৃত্যু শিকারে পরিণত হয়েছিল যে, সম্পন্ন বা মহৎ কোনোকিছুর জন্মই সেখানে কার্যত অসম্ভব হয়ে গিয়েছিল। এই বিশাল পতনের মুখে কোনো একক ব্যক্তির আলাদাভাবে কিছু করার ছিল না। আমার পক্ষেও তা সম্ভব হয়নি। আমার এই বই আমার সম্পন্ন শিক্ষাঙ্গনের নীরক্ত মাঠে অবসিত হবার গল্প।'
প্রিয় শিক্ষকদের দেখে দেখে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ছাত্রজীবনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন শিক্ষক হবার। যদিও শিক্ষকতা তখন অর্থকড়ির দিক দিয়ে তেমন সফল পেশা ছিল না। তারপরও বাবা ও প্রিয় শিক্ষকদের দেখাদেখি সম্মানজনক এই পেশাটি বেছে নেন। এবং সফল হন। সম্ভবত শিক্ষক হিসেবে তাঁ চাইতে জনপ্রিয়তা বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল। ঢাকা কলেজে যখন তিনি ক্লাস নিতেন তখন নাকি অন্য ক্লাসের ছাত্ররাও এসে ভিড় করত। তারপরও কেন তিনি শিক্ষকতা ছেড়ে দিলেন তার কথাই বলছেন তিনি এ-বইয়ে।
১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হলেও বিত্তের বিকাশ শুরু হয় ষাটে। অনেকের হাতে কাঁচা-পয়সা আসতে থাকে। ষাটের দশক আমাদের জাতির জীবনে ও প্রথম সুযোগের যুগ। এই সময় আমাদের দেশের শিক্ষা, পুঁজি, ব্যবসা, বাণিজ্য থেকে শুরু করে শিক্ষা, যোগাযোগ-ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য- এককথায় আমাদের উন্নয়ন-প্রক্রিয়ার প্রতিটি আলাদা প্রদীপ দেশের প্রতিটি সম্ভাব্য চত্বরে জ্বলে উঠল। দেশের ছোটবড় শহরগুলোকে কেন্দ্র করে সীমিত স্বপ্ন ও সুযোগের ভেতর বেড়ে-ওঠা এই মধ্যবিত্তের চেহারা ছিল মোটামুটি শান্ত, সুস্থিত ও আত্মতুষ্ট। ব্রিটিশ আমাদের দীর্ঘ, পরিবর্তনহীন, নিস্তরঙ্গ ও সনাতন আবহাওয়ায় লালিত হবার ফলে এরা একধরনের সুশীল ও চিরায়ত মূল্যবোধে যেমন ছিল জাগ্রত তেমনি নিজেদের ভঙ্গুর ও পরজীবী অস্তিত্বের কারণে ভেতরে ভেতরে এরা ছিল কমবেশি মেরুদ-হীন।
ষাটের দশকের সূচনায় বিত্তের এই অপ্রত্যাশিত পদপাত আমাদের সামাজিক জীবনের পুরো পরিস্থিতিটাকে ওলটপালট করে দেয়। স্বাধীনতার পর এই বৈষয়িক সুযোগের পরিমাণ বেড়ে হয় বহুগুণ। এই পুঁজি উল্লিখিত মধ্যবিত্তের সম্ভাবনাময় চোখের সামনে কোটি কোটি সুযোগের দরজা উন্মোচিত করে দেয়। সুযোগ- অপ্রতিহত, গণনাহীন, দুর্বার-সমস্ত সামাজিক চত্বরকে উচ্চকিত আন্দোলিত করে তোলে। টাকাই হোক, সম্ভাবনাই হোক, স্বপ্নের কাম্য গোলাপই হোক- উড়ে বেড়াচ্ছে বাতাসে। কেবল শক্তি আর সাহস থাকলেই যে- কেউ তা ছিনিয়ে নিতে পারে, কেড়ে নিতে পারে। এও এক ধরণের 'গোল্ড রাশ'। কোনো কিছুর বৈধতা ছিল না। দরিদ্র জনগণের জন্যে আসা ভিক্ষা লুট করে গড়ে উঠতে লাগল বিত্তের পাহাড়। এই দস্যুদের বাধা দেবার কেউ ছিল না।
এর সঙ্গে শিক্ষাঙ্গনে অবক্ষয়ের শুরু হয় অসংখ্য স্কুল-কলেজ রাজনৈতিক স্বার্থে জাতীয়করণের মধ্য দিয়ে। ষাট-দশকের গোড়ার দিকে এ-দেশে সরকারি কলেজের সংখ্যা ছিল ছ-সাতটি। সরকারি কলেজের শিক্ষার মান ছিল অত্যন্ত উঁচু। এ- দেশে বেসরকারি কলেজ জাতীয়করণ প্রথম শুরু হয় পাকিস্তান আমলে- পূর্বপাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানের উদ্যোগে। দেশের প্রধান প্রধান কলেজ থেকে ছাত্ররাজনীতি উচ্ছেদ করাই ছিল এর লক্ষ্য। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ লিখেছেন, আবদুল মোনায়েম খান এই সরকারীকরণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন কেবল দেশের বড় বড় কলেজগুলোতে, সীমিত আকারে। কিন্তু, স্বাধীনতার পর সমাজতন্ত্রী ধ্যানধারণার সঙ্গে সংগতি রেখে ব্যাপকভিত্তিতে সেসরকারি কলেজগুলোকে জাতীয়করণের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
দেখতে দেখতে সারাদেশের ছোটবড় শহর থেকে শুরু করে গ্রাম-গ্রামান্তের বিপুলসংখ্যক কলেজের সরকারীকরণ হয়। কোনোরকম বিচার-বিবেচনা ছাড়াই চলতে থাকে এই প্রক্রিয়া। যে যেদিক থেকে পারে-ব্যক্তিগত রাজনৈতিক বা অন্যান্য অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে। ফলে গাছবাড়িয়া সরকারি কলেজের সাথে ঢাকা কলেজের কোনো পার্থক্য থাকল না। জাতীয়করণ-করা কলেজ থেকে বন্যার, স্রোতের মতো শিক্ষক বদলি হয়ে আসতে লাগল ঢাকা কলেজে। তাঁদের শিক্ষকতার যোগ্যতা বা শিক্ষাগত মান দেশের শ্রেষ্ঠ ছাত্রদের শিক্ষকতার উপযুক্ত কি না তা যাচিয়ে খতিয়ে দেখার কোনো ব্যবস্থা রইল না। বন্যার তোড়ে ভেসে গেল ঢাকা কলেজের যা ছিল প্রায় সবকিছু।
এরপর থেকে তো ছাত্ররাজনীতির হাত ধরে শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসই শুরু হয়। শিক্ষাঙ্গন পুরোটাই চলে যায় ছাত্রনেতাদের হাতে। শিক্ষকরা তাদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েন । তারপর সময় শুরু ভয়াবহ নকল-সন্ত্রাস।
এসব অবক্ষয় দেখে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ঢাকা কলেজের অধ্যাপনা পেশা থেকে অব্যাহতি নেন। অধ্যাপনা ছেড়ে দিলেও শিক্ষকতা থেকে অবসর নিয়েছেন বলা যাবে না। অন্যভাবে ছাত্রছাত্রীদের শেখানো যায় কিনা সে-কথা ভাবেন। সে স্বপ্ন থেকেই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। আজ তিনি স্বপ্নের বাতিওয়ালা। রাষ্ট্রীয় শিক্ষার দুরবস্থার বিরুদ্ধে আলোর প্রদীপ হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। যিনি নিজেকে নিষ্ফলা মাঠের কৃষক দাবি করলেও তিনিই অনন্য চাষী- আগাছা মাড়িয়ে স্বপ্ন দেখেন সোনালী ফসলের।
Comments