সৈয়দ হকের ‘প্রতিধ্বনিগণ’: সংকট ও সম্ভাবনার প্রতিধ্বনি
আমি সৈয়দ শামসুল হক কখনো বেঁচে ছিলাম
কবিতা লিখতাম
সশব্দ আড্ডায় রাজপথ ভাসিয়ে দিয়ে মাঝরাতে
বাসা ফিরতাম...
আমি সৈয়দ শামসুল হক এখনো বেঁচে আছি
আমার সমস্ত অভিধান পুড়ে যাবার পরও
আমি বেঁচে আছি যখন আমার বেঁচে থাকাটাই
সমস্ত সংকলনে একটিই প্রমত্ত কবিতা।। (যারা বলেন, আপনার নতুন কবিতা কই)
২০১৬ সালে আজকের দিনে সৈয়দ শামসুল হক কর্কট রোগের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। তিনি ঈর্ষণীয় এক কবিতাজীবন কাটিয়ে গেছেন। জীবনের একেবারে শেষ সময়ে- রোগশয্যাতেও- যতক্ষণ বাকশক্তি সচল ছিল- জীবনসঙ্গী আনোয়ারা সৈয়দ হকের সহযোগিতায় লিখে গেছেন অমর কবিতামালা। সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মতো কবিতার মধ্য দিয়ে তিনি এখনো বেঁচে আছেন, থাকবেন প্রাসঙ্গিকও।
বাংলাদেশের বাংলা কবিতার অগ্রযাত্রা যাদের হাত ধরে আরম্ভ হয়েছিল, তাদের মধ্যে সৈয়দ শামসুল হক অন্যতম। ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত 'বুনোবৃষ্টির গান' স্বীকৃতি দিলে কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের দিক থেকে সমকালের অনেক জ্যেষ্ঠ কবির চেয়ে তিনি অগ্রবর্তী। তবে আত্মস্বীকৃত প্রথম কাব্যগ্রন্থ একদা এক রাজ্যে। তাঁর কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা অর্ধশতাধিক। শৈশব অতিবাহিত করেছেন কুড়িগ্রামে। প্রায় এক দশক কাটিয়েছেন লন্ডনে; বাকি সময় নিরবচ্ছিন্নভাবে কাটিয়েছেন ঢাকায়।
তার হাতে নিখাদ নগরকেন্দ্রিক কবিতা যেমন রচিত হয়েছে, তেমনি তার কবিতায় অনুভূত হয় শেকড়ের প্রতি টান। রাজনীতি সচেতন কবিতা যেমন রচনা করেছেন, তেমনি প্রেম-প্রকৃতিও বিষয় হিসেবে ধরা পড়েছে অনায়াসে। পাশাপাশি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস-ঐতিহ্য, ব্যক্তিমনের নানা প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ, অকৃত্রিম দেশাত্মবোধ, বাংলার নিসর্গ-প্রকৃতি, মানব-মানবীর প্রেম প্রভৃতিকে উপজীব্য করে তার কবিতার জগত গড়ে উঠেছে। প্রচলিত সাহিত্যের প্রায় সব শাখায় সমান বিচরণ থাকলেও নিজের কবিখ্যাতিতেই ছিল তাঁর অধিক সায় ও স্বাচ্ছন্দ্য। কারণ, তার 'কবিতার ব্রতকথা' হলো, 'আমাকে যদি আরেকটি জীবন দেয়া হয় আমি শুধু কবিতাই লিখতাম।'
তার কবিতার বৈচিত্র্য বাড়িয়েছে বাংলাদেশের ঋতুবৈচিত্র্য। তার প্রিয় ঋতু গ্রীষ্ম। প্রিয় মাস বৈশাখ। বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা নামে রয়েছে দীর্ঘ এক কবিতা, যেটি স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি কাব্যগ্রন্থও। বৈশাখ নানাভাবে সৈয়দ হকের কবিতার শ্রীবৃদ্ধি ঘটিয়েছে, করেছেকবিতাকে সমৃদ্ধও । তার কবিতায় অন্যতম প্রবণতা ব্যক্তির স্বরূপ অন্বেষার পাশাপাশি বাঙালির শেকড়কে অবলম্বন কওে এগিয়ে চলা। ফলে বাংলা ও বাঙালির নিজস্ব পুরাণ, বাঙালির সংস্কৃতি, লোকবিশ্বাস, লোক-ঐতিহ্যের প্রতি ছিল অগাধ পক্ষপাতিত্ব।
অত্যন্ত সচেতনভাবে গড়ে তুলেছিলেন তার নিজস্ব কবিতা-জগত; যেখানে পাশ্চাত্য প্রভাবকে এড়িয়েছেন সচেতনভাবে। বলেছেন, 'কবিতার উপাদান নিতে আমি ইউরোপের কাছে যাইনি।' সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মতো কবিতা নিয়েও তিনি নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। তাঁর কাব্যযাত্রার প্রারম্ভিককালে বাংলাদেশের নগর ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি কেবল উদীয়মান। কৃষিই তখন জনমানুষের উপার্জনের প্রধান অবলম্বন। তারা জীবনসংগ্রামী কিন্তু অধিকার-বঞ্চিত। এ সবই সৈয়দ হকের কবিতাশিল্প গঠনে সমৃদ্ধি দান করেছে। কবিতায় সমষ্টি ও ব্যক্তির চৈতন্যই তার কাছে প্রধান।
আলোচনা তার চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ প্রতিধ্বনিগণকে কেন্দ্র করে। সেই সময় তিনি থাকতেন বিলেতে। তার আগে শেষ কাব্যগ্রন্থ বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা। সুতরাং অনায়াসেই বলা যায়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকাল থেকে পরবর্তী সময়ে রচিত কবিতাগুলো হয়তো প্রতিধ্বনিগণ কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকবে। আর এ-সময় প্রবাসের অধিবাসী হলেও খুব স্বাভাবিকভাবেই নিজ দেশের সংকট ও সংগ্রাম তাকে বিচলিত করে তুলেছিল, শোষিত মানুষের চেহারা অস্থির করে তুলেছিল। তাকে প্রতিনিয়ত তাড়িত করেছে শ্বাপদসংকুল পরিবেশ উপেক্ষা করেও শস্য উৎপাদনের নিশ্চয়তা দেওয়া কৃষকদের দুর্দশাপীড়িত জীবন। সবচেয়ে প্রান্তিক, সবচেয়ে বঞ্চিত এই পেশাজীবীদের জীবন যেন শোষকদের জন্য সবচেয়ে উপাদেয় খাবার:
যাই বলো, মানুষের স্বাদ বড় ভালো,
এরচেয়ে উপাদেয় মাংস কিছু নেই;
অনেক দেখেছি চেখে পীত শাদা কালো,
এশিয়ায় আফ্রিকায় অবিকল সেই
একই স্বাদ; নিয়মিত খেতে বড় শখ।
তবে যদি প্রশ্ন করো উত্তম কোথায়?-
সবচেয়ে খেতে ভালো বাংলার কৃষক। (খাদ্য ও খাদক)
অত্যন্ত তীক্ষ্ম ভাষায় কৃষক-শোষণের 'ব্যঞ্জনা' তুলে ধরেছেন কবি। যেখানে অবস্থান করুন না কেন, স্বদেশকে কবি স্থান দিয়েছেন সর্বাগ্রে। কারণ তিনি ছিলেন খাঁটি বাঙালি। তাই তিনি যখন বলেন, 'আমারও সংসার হবে- শিল্পের সংসার। চন্দ্রাবতী হবে বোন,/ কালীঘাটে আত্মীয় আমার।', তখন শিল্পপ্রেম ও দেশপ্রেম একাত্ম হয়ে যায়। ফলে তার অকৃত্রিম উপলব্ধি হয় এমন, 'আমিও বাংলার লোক, স্বভাবত বাংলার মতই/ সমতল সংগীতের শস্যভারে নত, দূরগামী/ পদ্মার মতই ধীর, পলিমাটি আত্মায় সঞ্চিত।...বর্ষায় কোমল কাদা, পোড়ামাটি চৈত্রে সেই আমি।' (আমিও বাংলার লোক)
ষাটের দশকে বাঙালির রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রাম-সংঘবদ্ধতার অন্যতম কারণ ছিল সংকটের ব্যাপকতার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অবস্থান। তাদের কারণেই ছয়দফার ভিত্তিতে বাঙালির সর্বৈব আন্দোলন ও অস্তিত্বের লড়াই হয়েছে এবং তাদের অবদান ও অংশগ্রহণের কারণেই ঊনসত্তরের গণ আন্দোলন সফল হয়েছে। এ দেশের কৃষক-শ্রমিক শ্রেণিকে বাদ দিয়ে এসব আন্দোলন ছিল অসম্ভব। তাই তার প্রবাসজীবনকালে জারিত স্মৃতিকে তিনি তুলে আনতে পেরেছেন এভাবে: 'এশিয়ার ধানখেতের ভেতর দিয়ে/ পূর্ণিমায় কাননঘেরা বিদ্যালয়ের দিকে যেতাম;/ সেই ধানখেতের ভেতর দিয়েই আমি আজ/ অমাবস্যার আগুনঘেরা বসতির দিকে।।'
একটা প্রকট অনিশ্চয়তাকে 'অমাবস্যার' সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি জানেন, তাকে জয় করতে প্রয়োজন প্রতিজ্ঞার বারুদ। সেই চেতনায় উজ্জীবিত হতে হতে তিনি জাগ্রত জনতার দিকে অগ্রসর হয়েছেন। স্বগত উচ্চারণে মুক্তিকামী সেই জনতা সম্পর্কেই বলেছেন: 'এবং মাত্র গতকাল জনতার আকাশ থেকে খসে পড়া/ কয়েকটি তারা আমি দেখলাম/ বিপ্লবের শহরে/ কিংবা আশা নামক কোন ভাস্করের/ জ্যোতির্ময় হাতুড়ি ও ছেনিতে/ আবেগের প্রস্তরখ-ে কয়েকটি কাজ/ আমি জিজ্ঞেস করলাম তোমরা কার আদলে নির্মিত/ তারা বলল তোমার/ বললাম আমি/ বাসস্থান/ চৈতন্যে/ স্থায়ী ঠিকানা/ ইতিহাস/ উচ্চতা/ স্বাধীনতা সমান।' (তেসরা ফেব্রুয়ারী ১৯৭০)
১৯৭১ সালের মার্চ মাস বাঙালির জন্য ছিল ঘোর সংকটকাল। পাকিস্তানিদের শোষণ ও অত্যাচার থেকে পূর্ববাংলার বাঙালি তখন মুক্তি খুঁজছে। মিছিলে মিছিলে উত্তাল তখন সমগ্র দেশ। কবি-সাহিত্যিক-সংস্কৃতিকর্মীরা চেতনায় শান দিচ্ছেন মানুষকে উজ্জীবিত করতে। তখনো কবি ঢাকার অধিবাসী। তিনি লিখে ফেললেন, 'পহেলা মার্চ ১৯৭১', যেখানে দেশমাতা আর স্বাধীন দেশের পতাকা কোটি কোটি প্রাণের জোয়ার হিসেবে অভিন্নরূপে উদ্ভাসিত হয়েছে।
যেমন:
দ্যাখো, আমি নিরস্ত্র। কিন্তু-
আমার আছে সেই অস্ত্র যা নিঃশেষিত হয় না,
প্রতি ব্যবহারে তীক্ষ্ম থেকে তীক্ষ্মতর হয়ে ওঠে-
আমার প্রাণ।
আমার তো একটিই প্রাণ নয়, কোটি কোটি প্রাণ।
দ্যাখো, আমি পতাকাহীন। কিন্তু
আমার আছে সেই পতাকা
যা দাম্ভিকের দণ্ড থেকে উত্তোলিত হয় না-
আমার পতাকা আমার মায়ের মুখ।
আমার তো একটিই মা নয়, কোটি কোটি মা।
প্রাণ বিসর্জন দেওয়ার প্রতিজ্ঞায় যখন অবিচল মুক্তিকামী সাধারণ মানুষ, তখন সেই বিজয়ে কেউ বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। শোষকের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয় যখন অগণিত মানুষ, পশ্চাতে যাওয়ার সীমানায় যখন আটকে যায় নিজের অস্তিত্ব, তখন নিঃস্ব মানুষ জেগে ওঠে সেই সীমানা-দেয়াল থেকে শক্তি আহরণ করেই। সেই লড়াকু প্রাণের স্ফুলিঙ্গই হতে পারে জাতিগত জাগরণের মোক্ষম অস্ত্র। ফলে তিনি তুলে আনেন প্রেরণা-সঞ্চারী বাস্তবতা:
কারণ, সংখ্যায় কি আসে যায়?
সংখ্যায় কি হবে?
এই কি যথেষ্ট নয়,
একটি মায়ের গেছে একটি সন্তান?
একটি মানুষের গেছে একটি মানুষ?
এই কি যথেষ্ট নয়,
একটি ফুল ছিঁড়ে নিলে
আন্দোলিত হয় সম্পূর্ণ মালাটাই
এবং একটি শূন্যতাই বিক্ষুব্ধ করে সমস্ত স্বস্তি? (প্রেস রিপোর্টারকে)
এ-কবিতার মতো অভিন্ন ভাবনায় রচিত হয় 'দুপুরে হঠাৎ কারফিউ' কিংবা 'একাত্তরের পঁচিশে মার্চের অসমাপ্ত কবিতা'। পঁচিশে মার্চ গভীর রাতে ঘুমন্ত মানুষের ওপর যে বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, কবি ছিলেন তার প্রত্যক্ষদর্শী। সুতরাং তাকে যেভাবে কাতর করে তুলেছিল কালরাত্রির বাস্তবতা, তা চিত্ররূপময়তায় ভাস্বর হয়ে আছে কবিতায়:
দ্যাখো অন্ধকার চাপা আলোয় যখন উঠে আসে মুয়াজ্জিন
পবিত্র, গম্ভীর
দাঁড়ায় মিনারে
ভরে তোলে ভোর তার আকুল আজানে
তখনি আকাশ তার গোল দেহ ফেটে পড়ে লাল
স্বর্গীয় ফলের মতো
ঈশ্বরের রাজপথ রক্তে ভেসে যায়। (একাত্তরের পঁচিশে মার্চের অসমাপ্ত কবিতা)
'ঈশ্বরের রাজপথ' যখন 'রক্তে ভেসে যায়', আদতে তখনই ধ্বনিত হয় সম্ভাবনা; সংকট সত্ত্বেও তখনই প্রতিধ্বনিত হয় সংগ্রামী মানুষের কণ্ঠস্বর। আলোচ্য কবিতাসমূহের ভিত্তিতে বলাই যায়, সংকটপীড়িত ও শোষিত মানুষের সংগ্রামী জীবনকে কবিতার আঙ্গিকে তুলে আনার মধ্য দিয়ে সৈয়দ শামসুল হক নিজের দৃষ্টিকে নিবদ্ধ করেছেন শেকড়ের দিকে। জনজীবনের সঙ্গে যে তার নিবিড় সম্পর্ক ছিল; ছিল গভীর উপলব্ধির সাঁকো, তার সাক্ষ্য বহন করে কবিতায় ব্যবহৃত সুচিন্তিত শব্দসমূহ। সংগ্রাম-শিল্প-জীবনের রূপকে শিল্পিত কৌশলে ধরতে পেরেছিলেন বলে প্রতিধ্বনিগণ রচনাকালে তিনি হয়তো সম্ভাবনার প্রতিধ্বনিও শুনতে পেয়েছিলেন।
Comments