জসীম উদ্দীনের চোখে ‘ঠাকুর বাড়ির আঙিনা’
রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্র অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর জিজ্ঞেস করলেন, "কি হে, জসীম, কোন কথা বলছ না যে?" জসীম উদ্দীন কী কথা বলবেন! বসে বসে দেখছেন অবনবাবু আর গগনবাবু ছবি আঁকা। দুই ভাই রঙের জাদুকর, রাত-দিন বসে বসে শুধু ছবি আঁকেন,জসীম উদ্দীন সুযোগ পেলেই ছুটে যান তাদের কাছে, পায়ের কাছে বসে থেকে দেখেন কাগজের উপর রঙের খেলা, দেখে দেখে সাধ মেটে না।
অবনীন্দ্রনাথের বাড়ি থেকে রবীন্দ্রনাথের ঘর তিন মিনিটেরও পথ নয়। তাও অনেক দিন রবীন্দ্রনাথের দেখা পাচ্ছেন না জসীম উদ্দীন। কবি তখন শান্তিনিকেতনেই বেশি থাকেন। ইচ্ছে করলে শান্তিনিকেতনে গিয়েই কবির সঙ্গে দেখা করতে পারেন। কিন্তু, সাহস পান না। সেবার কবি খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ১৯৩০ সালের কথা। একটু সুস্থ হয়ে বাড়ি এলেন। এবার জসীম উদ্দীন ভাবলেন একবার দেখা করে আসা যাক। যদি আর কখনো বয়োবৃদ্ধ কবির সঙ্গে দেখা করার সুযোগ না হয়! তিন মিনিটের পথ যেতে যে কতক্ষণ যে লাগল! ভয়ে বুক কাঁপছে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জসীম উদ্দীনের মনে হচ্ছিল তিনি যেন অতীত যুগের কোনো তীর্থযাত্রী। জীবনের শত বন্ধুর পথ অতিক্রম করে আজ মহামানবের মন্দিরপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছেন।
এক সময় কবির সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ হলো। তার দুটো বই- 'নকশীকাঁথার মাঠ' আর 'রাখালী' নিয়ে গিয়েছিলেন সঙ্গে করে। বই দুটি কবিকে উপহার দিলেন। দুদিন পরেই এক শুভাঙ্খীর কাছে শুনলেন কবিগু বই দুটোর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। পরদিনই জসীম উদ্দীন কবির সঙ্গে আবার দেখা করতে গেলেন। কবি বললেন, বই দুটো নিয়ে তিনি লিখবেন। জসীম উদ্দীনকে তিনি শান্তিনিকেতনে গিয়ে থাকার প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু, তিনি তখন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম. এ. পড়ছিলেন। তাই আর শান্তিনিকেতনে গিয়ে থাকা হলো না। এর পর কবি আরও বারো বছর বেঁচে ছিলেন, সুদীর্ঘ বারো বছর কবিগুরুর সান্নিধ্যে থাকার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলেন, এটা ছিল সারাজীবনের একটা বড় আফসোস।
যদিও তারপর অনেক দিনই জসীম উদ্দীন অতিথি হিসেবে শান্তিনিকেতনে গিয়ে থেকেছেন। সেখানে গিয়ে নিবিড় সান্নিধ্য পেয়েছেন। শুধু কবি নন, আরও মহান মানুষদের সান্নিধ্য পেয়ে ধন্য হয়েছেন। তাদের মধ্যে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, জগদানন্দ রায়, ক্ষিতিমোহন সেন, শান্তিদেব ঘোষ অন্যতম। তবুও জসীম উদ্দীনের জীবনের একটা বড় অতৃপ্তি ছিল যদি কবিগুরুর সান্নিধ্যে আরও বেশিদিন থাকতে পারতেন তাহলে আরও অনেক কিছু শিখতে পারতেন।
রবীন্দ্রনাথ জসীম উদ্দীনের পুরো জীবনটাকে বদলে দিয়েছিলেন। জসীম উদ্দীন একে তো গ্রামবাংলার কবি, তার উপর মুসলমান, কলকাতায় গিয়ে প্রথম জীবনে খুব একটা মূল্য পাননি। রবীন্দ্রনাথের স্বীকৃতিই তাকে বিখ্যাত করে তোলে, এবং তার সমালোচকদের মুখ বন্ধ করে দেয়। রবীন্দ্রনাথ জসীম উদ্দীনের কবিতা সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, "জসীম উদ্দীনের কবিতার ভাব ভাষা ও রস সম্পূর্ণ নতুন ধরণের। প্রকৃত হৃদয় এই লেখকের আছে। অতি সহজে যাদের লেখবার শক্তি নেই, এমনতর খাঁটি জিনিশ তারা লিখতে পারে না।"
শুধু কবিতা নিয়ে নয়, জসীম উদ্দীনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ আলাপ করতেন হিন্দু-মুসলমান সমস্যা নিয়েও। তখনই বাঙালি-সমাজে সাম্প্রদায়িকতার বিষ-বাষ্প জেগে উঠতে দেখা গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ স্বীকার করেছেন এই আগুন বহুকাল ধরেই বাঙালির ঘরে সঞ্চিত ছিল।
'বন্দেমাতরম্' গানটির মধ্যেও যে মুসলমানের আপত্তি করবার বিষয় আছে তাও রবীন্দ্রনাথ স্বীকার করেছিলেন। যদিও রবীন্দ্রনাথ নিজে গানটির একবার সুর করেছিলেন এবং গেয়েছিলেনও। আবার বন্দেমাতরম গানটি নিয়ে যখন দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচণ্ড বিরোধের সৃষ্টি হয় তখন রবীন্দ্রনাথ একটি কথাও বলেননি, তাও জসীম উদ্দীন এক সভায় উত্থাপন করেছিলেন।
জসীম উদ্দীনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ হিন্দু-মুসলমান সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতেন এবং উত্তেজিত হয়ে উঠতেন। তাই একবার কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ জসীম উদ্দীনকে বলেন কবির কাছ থেকে কিছুদিন দূরে থাকার জন্য। কারণ, কবি তখন খুব অসুস্থ ছিলেন। (জসীম উদ্দীন তার লেখায় রবীন্দ্রনাথকে সব সময় কবি বলে সম্মোধন করেছেন)
জসীম উদ্দীন লিখেছেন, মুসলমানদের প্রতি কবির মনে কিছু ভুল ধারণা ছিল। কারণ, তিনি সাধারণত হিন্দু পত্রিকাগুলোই পড়তেন। তা ছাড়া, তখন কবির কাছে যারা যেতেন কবি শুধু তাদের সম্পর্কেই জানতেন। এর বেশি খবর নেয়ার মতো শরীর-স্বাস্থ্য তার তখন ছিল না। তবে, জসীম উদ্দীন বলেছেন, কবির মনে একদেশদর্শী হিন্দুত্বের স্থান ছিল না, মুসলমানদের মধ্যে যারা স্বাধীন মতবাদ নিয়ে ধর্ম ও সমাজ-ব্যবস্থার সমালোচনা করতেন তাদের প্রতি কবির অনুরাগ ছিল।
এ-প্রসঙ্গে এত কথা বলার কারণ এই, রবীন্দ্রনাথ মুসলমান-সমাজ সম্পর্কে অনেকটাই চুপ ছিলেন এই নিয়ে এখনো অনেক সমালোচনা হয়। পাশের এই বৃহৎ-প্রতিবেশীকে নিয়ে তিনি কেন আরও বেশি লিখলেন না? তার কিছু উত্তর জসীম উদ্দীনের এই গ্রন্থ থেকে জানা যায়। রবীন্দ্রনাথ মুসলমান লেখকদেরই উৎসাহ দিতেন মুসলমান-সমাজ নিয়ে লেখার জন্য।
'ঠাকুর-বাড়ির আঙিনায়' কেবল রবীন্দ্রনাথের কথাই নেই। বরং আরও বেশি করে আছে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সূত্রধরেই ঠাকুর বাড়ির আঙিনায় পা ফেলার সৌভাগ্য হয় জসীম উদ্দীনের। যদিও বালকবয়সে একবার কলকাতা বেড়াতে গিয়ে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর-বাড়িতে প্রথমবার ঢুকেছিলেন তিনি। সেবার ঠাকুর-বাড়িতে 'শেষ বর্ষণ' নাটক অভিনয় হয়েছিল। আট আনা দিয়ে সর্বনিম্ন টিকিট কেটে জসীম উদ্দীন নাটক দেখতে গিয়েছিলেন। হলঘরের একেবারে শেষ প্রান্তে বসেছিলেন। নাটক শেষে রবীন্দ্রনাথকে কাছ থেকে দেখার জন্য কাছে গিয়ে মুগ্ধ চোখে কেবল তাকিয়েই রইলেন।
ঠাকুর-বাড়িতেজসীম উদ্দীনের পাকাপোক্ত আসন হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম. এ পড়তে গিয়ে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরই তাকে খবর পাঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। খবর দিয়েছিলেন কল্লোল পত্রিকার সম্পাদক দীনেশরঞ্জন দাশ মারফত। এর কারণ জসীম উদ্দীনের সংগৃহীত কিছু গান তিনি পড়েছিলেন, এবং তার এক-প্রবন্ধে একটি গান ব্যবহারও করেছিলেন।
এরপর জসীম উদ্দীন অবনবাবুর ঘরের মানুষ হয়ে গেলেন। এক সময় ঠাকুর-বাড়িতে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে তিনি এক বছর বাস করেছেন। ফলে ঠাকুর-বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গেও জসীম-উদ্দীনের দারুণ এক আত্মীয়তা হয়ে যায়। বিশেষ করে শিশুদের সঙ্গে। শিশুরা হয়ে উঠে তার খেলার সাথী। কাছ থেকে দেখা ঠাকুর-বাড়ির অন্দরমহলের অনেক অজানা খবর জানিয়েছেন জসীম উদ্দীন।
ঠাকুর-বাড়িকে বাঙালি-সংস্কৃতির একটি তীর্থস্থান বললে অত্যুক্তি হবে না। রবীন্দ্রনাথ-গগনেন্দ্রনাথ- অবনীন্দ্রনাথের সূত্র ধরে সে-সময়ের কোনো বিখ্যাত লোকের পা পড়েনি ঠাকুর-বাড়ির আঙিনায়! আর কতসব বিষয়ে আলাপ! খুড়ো-ভাইপোর আলাপ চলতো ঘণ্টার পর ঘন্টা। সবই শিল্প-সাহিত্য নিয়ে। জসীম উদ্দীন শুধু বসে বসে শুনতেন। এসব আলাপ শুনতে শুনতে তিনি কতটা সমৃদ্ধ হয়েছেন তারই ঋণ স্বীকার করতে জসীম উদ্দীন লিখেছিলেন 'ঠাকুর-বাড়ির আঙিনায়' নামক অনন্য সাধারণ স্মৃতিগ্রন্থটি। বইটি লিখেছিলেন তিনি ১৯৬১ সালে। তখন তিনি ঢাকায় স্থায়ী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জসীম উদ্দীনের চাকরি হয়েছিল রবীন্দ্রনাথেরই একটি সুপারিশের কারণে।
অনেকটা স্মৃতিভারাক্রান্ত ভঙিতেই জসীম উদ্দীন বইটি শুরু করেছেন এবং শেষও করেছেন। কীভাবে প্রথম রবীন্দ্রনাথের নাম শুনেছেন এবং কীভাবে তার কবিতা পড়তে শুরু করেছেন তার বিস্তৃত বর্ণনা দিয়ে বইটি শুরু করে শেষ করেছেন ঠাকুর-বাড়ির ভগ্নদশার বর্ণনা দিয়ে। অবনীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর তার বাড়িটি নিলাম হয়ে যায়। বাংলার এত বড় শিল্পীর বাড়ি কেউ সংরক্ষণ করলো না ভেবে দুঃখ পেয়েছেন। বাড়িটি এখন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত হলেও "আজ ঠাকুর-বাড়ির সেই ইন্দ্রপুরী শ্মশানে পরিণত হইয়াছে', বলে মন্তব্য করেছেন জসীম উদ্দীন।
গ্রস্থের শেষে একটি বাড়তি লেখা সংযোজিত রয়েছে। সেটি নজরুলকে নিয়ে। নজরুল জসীম উদ্দীনের চেয়ে বয়সে মাত্র চার বছর বড় ছিলেন। অথচ, কবি নজরুলের প্রতি জসীম উদ্দীনের শ্রদ্ধা দেখলে মনে হবে কতই-না বড়! আসলে বয়সে খুব বেশি বড় না হলেও গুণে যে খুব বড় ছিলেন এ-কথা স্বীকার করতে জসীম উদ্দীন কুণ্ঠা করেননি। কবি নজরুলকে জসীম উদ্দীন ডাকতেন কবিভাই, আর জসীম উদ্দীনকে কবি নজরুল ডাকতেন শিশুকবি। তাদের প্রথম সাক্ষাৎ থেকে শেষ সাক্ষাৎ পর্যন্ত কত যে চমকপ্রদ কথা আছে! কবি নজরুল অনেকবার এসেছেন জসীম উদ্দীনের ফরিদপুরের বাড়িতে।
কবি নজরুল এলেই জসীম উদ্দীন একটা পাটি বিছিয়ে দিতেন বাড়ির পাশের নদীর তীরে। নজরুল সেখানে বসে বসে গান গাইতেন, কবিতা লিখতেন। আর নজরুলের কলকাতার বাড়িও বহুবার গেছেন জসীম উদ্দীন। প্রথম দিকে যেমন কবির সুন্দর পরিবারটি কাছ থেকে দেখেছেন, পরবর্তীতে কবির দুর্দশাও কাছ থেকে দেখেছেন। অসুস্থ কবিকে ঢাকায় নিয়ে আসার পরও প্রায়ই কবিকে দেখতে যেতেন। কবি নজরুলের সারাজীবনের একটি চিত্র পাওয়া যায় জসীমউদ্দীনের এই লেখা থেকে।
জসীম উদ্দীনের 'জীবনকথা'য় জানা যায় সাধারণ মানুষের কথা, আর 'ঠাকুর-বাড়ির আঙিনা'য় জানা যায় বিখ্যাত মানুষদের কথা। নিজেকে উহ্য রেখেজসীম উদ্দীন অন্যের কথা এমন আন্তরিকতা ও শ্রদ্ধার সাথে বলেন যে পড়লে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় তিনি নিজেও একজন বিখ্যাত কবি! লেখার মধ্যে কী বিনয়, কী মায়া, কী সরলতা, কী গভীরতা, কী সততা!
Comments