দুঃখী মানুষের ভাষ্যকার
জীবনের সীমানা পেরিয়ে গেলেন আবুবকর সিদ্দিক। সীমানা তো সবাইকে পেরোতে হয়। পেরোতে পেরোতে জীবনের সঞ্চয় রেখে যেতে পারেন কজন! আবুবকর সিদ্দিক পারলেন। দীর্ঘজীবনে রেখে গেলেন অজর-সঞ্চয়। কারণ তিনি কবি। দীর্ঘ, জটিল ও বিচিত্র সমারোহমুখর কবিতার পথ পেরিয়ে কালে তিনি হয়ে উঠলেন আমাদের অগ্রগণ্য কবিদের একজন। তবু, কী কবি হিসেবে কী কথাকার হিসেবে সেই স্বীকৃতি তাঁর ভাগ্যে কোনোদিন জুটলো না।
জীবনের শেষ দশ বছর কাটালেন খুলনায় নিজের স্বজনদের কাছে। ঢাকা-নগরের কলকোলাহল ছেড়ে কেন তিনি বেছে নিলেন এ নির্বাসন! একবার তিনি লিখেছিলেন, 'পিছনের দিকে তাকিয়ে আজ বড় অসহায় মনে হয়। নস্ট্যালজিয়া নয়, ধূসর এক অনিশ্চয়তায় ঢেকে আসে যৌবনের উজ্জ্বল স্মৃতি থেকে বর্তমানের তামাটে মেঘঢাকা আদিগন্ত আকাশ। সবই কি প-শ্রম? এত রক্তক্ষরণ, মন্ত্রপূত ব্রতউদযাপন, এত তিল তিল শব্দের অক্লান্ত সীবন, এত বিনিদ্র জাগরণের কাব্যোৎসর্গ, কালের উদাস মাড়াইকলে সবই কি বর্জ্য? একটি অক্ষর, একটি স্বর, একটি ধ্বনিও কি উত্তরকালের কৃপাকটাক্ষে পুনর্জীবনধন্য হবে না?' এভাবে তিনি কেন বলেছিলেন! নিরাশায় দীর্ণ হতে হতে হয়তো জীবনের কাছে তাঁর প্রচুর অভিমান জমা হয়েছিল। সেই অভিমানে তিনি নিজেকে ভিড়ের বাইরে নিয়ে নির্লিপ্ত একটা দশক কাটিয়ে জীবনের সীমানা পেরোলেন।
অথচ আবুবকর সিদ্দিক কেবলই কবি ছিলেন না, ছিলেন আমাদের দুঃখী ও পীড়িত ভূখণ্ডের গদ্য-ভাষ্যকারদেরও একজন। বারো বছর বয়সেই লিখেছিলেন প্রথম কবিতা এবং গল্প। ১৯৪৬ সালের আগস্ট মাসে 'বর্ধমানের কথা' পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল সেই কবিতা। ক্লাস ফাইভে পড়ুয়া কবির প্রথম কবিতাটি আহামরি কিছু ছিল না। সে-কবিতাকে 'বালখিল্য' বলে স্বীকার করতে তাঁর কোনো দ্বিধাও ছিল না। তবে, সন্দেহ নেই, উত্তরকালের কবি ও কথাকার আবুবকর সিদ্দিকের সাহিত্যজীবনের রেখাচিত্র নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল সেই বালখিল্য কবিতাটিই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ আবুবকর সিদ্দিককে যুক্ত করে দিয়েছিল আধুনিক কবিতা বিপুল ভুবনের সঙ্গে। আর ঢাকা মহানগর তাকে দিয়েছিল তখনকার প্রতিষ্ঠ কবিদের সঙ্গে মেশার সুযোগ। ১৯৫৭ সালে সিকান্দার আবু জাফর এবং হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদিত সমকাল পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল তাঁর যুগল কবিতা: 'পাপপুণ্য' ও 'শীতের শেষরাত'। বর্ধমানের কথায় বালখিল্য কবিতাপ্রকাশ দিয়ে শুরু হয়েছিল অনির্দেশ্য যাত্রা সমকাল-এ এসে প্রথমবারের মত সে-যাত্রায় দেখা গেল কবি-স্বীকৃতির আভাস। কারণ সমকাল-এর সেই সংখ্যায় তাঁর সঙ্গে ছাপা হয়েছিল মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, আল মাহমুদ প্রমুখের কবিতা।
বর্ণাঢ্য জীবনযাপন আবুবকরকে যে অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ করেছিল, তার প্রভাব পড়েছিল তার কবিতাশিল্পেও। তিনি জন্মেছিলেনবাগেরহাটে। জন্মের পরের বছরই পরিবারের সঙ্গে হুগলি চলে যেতে হলো। এরমধ্যে বেজে উঠল বিশ্বযুদ্ধের দামামা। মন্বন্তর, দাঙ্গা, দামোদরের বন্যা, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের আবহে কলকাতায় ফুটল জাপানি বোমা। ১৯৪৩-এ আবুবকরের পরিবার বর্ধমানের বাসিন্দা হলো। বর্ধমানে স্কুল ছুটির পরে বইয়ের দোকান 'পুস্তকালয়'-এ বসে বই পড়ার অভ্যাস তাঁর মধ্যে ঠেসে দিয়েছিল কবিজীবনের আকাক্সক্ষা। কিন্তু প্রথম কবিতা প্রকাশিতের দুবছরের মধ্যে এসে পড়েছিল দেশবিভাগের ধাক্কা। দেশভাগ চিরভ্রাম্যমাণ আবুবকরকে ফিরিয়ে এনেছিল শৈশবে ফেলে যাওয়া পূর্ববাংলায়। পূর্ববাংলার মাঠ-ঘাট, জনপদ, রাজনীতি আবুবকরকে গড়ে তুললো ভূখ-ের প্রথম পঙ্ক্তির সাহিত্যশিল্পী হিসেবে।
১৯৬৯ সালে যখন বের হলো আবুবকর সিদ্দিকের প্রথম কবিতাগ্রন্থ ধবল দুধের স্বরগ্রাম তখন তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের শিক্ষক। সাহিত্যে শিক্ষকতা আর দুই বাংলার কবিদের সান্নিধ্য তাঁর কবিতার অন্তর্গঠনে প্রভাবদায়ী হয়ে উঠেছিল। ধবল দুধের স্বরগ্রাম ছিল উনত্রিশটি কবিতা দিয়ে গঠিত এমন এক কবিতাপুস্তক—কবি নিজে জানাচ্ছেন, 'আমার প্রথম কবিতার বই ধবল দুধের স্বরগ্রাম বের হয় বহিরঙ্গে বিষ্ণু দে'র (একই ধ্রুপদি আধুনিকতার ঘরানা সাঙ্গীকৃত সুধীন্দ্রনাথ দত্তেরও) ও অন্তরঙ্গে জীবনানন্দ দাশের অনুসারী অঙ্গভূষণ নিয়ে।'
২০১০ সালে শেষ কবিতাগ্রন্থ হাওরের হাহাকার প্রকাশের পর তিনি পরিত্যাগ করেছিলেন ঢাকানগরের জীবন। স্বনির্বাসিত খুলনাজীবনে আর কোনো কবিতাগ্রন্থ লিখেছেন কিনা তা আমাদের জানা নেই। যদিও আবুবকর কবিতাকে ভাবতেন একটি নিত্যসৃজমান শিল্পোৎসার—ভাবতেন কবিতা চলমান মানব-অস্তিত্বের বিনুনিতে পুষ্পস্তবকের মতো অবিচ্ছিন্ন। তিনি লিখেছিলেন, 'যতদিন বেঁচে আছি, কবিতা আমাকে লিখে যেতে হবে। জীবনে-মরণে দুঃখে-প্রেমে ক্রান্তিক্ষণে এমন আত্মসঙ্গী আর নেই। পাঠকের অমনস্কতা, সম্পাদকের উন্নাসিকতা, প্রকাশকের নীরবতা এবং সর্বোপরি, সমকালের তিক্ত অবমূল্যায়ন, উঃ, একজন কবিতাসেবকের জন্যে এমন ধারা কত না দূরদৃষ্ট! তবু তো কবিতা, হ্যাঁ, কবিতাই লিখে যেতে হবে।
নিজের শরীরের মাংসরস লোল হয়ে খসে যাবে, নারীর মধু কটুকষায় হয়ে যাবে, পৃথিবীর সমস্ত ধান্য শুকিয়ে চিটে হয়ে যাবে; তবু মেধার সলিতাটুকু পুড়িয়ে পুড়িয়ে কবিতাই লিখে যেতে হবে।' ফলে, নির্বাসনের কবিতা এখনও আমাদের হাতে নেই—কিন্তু সেগুলো যে নিশ্চয়ই আছে, এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আমাদের জানা সময়ের দীর্ঘ ৪১ বছরে মোট আঠারোটি কবিতাবইয়ে আবুবকর হয়ে উঠেছিলেন এক মুখর কাব্য-ভ্রামণিক।রবীন্দ্রনাথের মতো না-হলেও বিভিন্ন পর্বে ভাগ হয়ে গড়ে উঠেছিল আবুবকরের কবিতাজীবন। কবিতার কেন্দ্রিকতা নিয়ে কবি একবার বলেছিলেন, 'মনে পড়ে প্রথমবেলায় কবিতা লিখতাম আকাশে বাতাসে প্রান্তরে ব্যাপ্ত জনৈকা অদৃশ্য কাল্পনিক নারীকে কেন্দ্র করে। পবিত্র সরল কাতর প্রেমের কবিতা।...তারপর যখন রক্তমাংসের রূপ নিয়ে মানবীর অভ্যুদয়, সে বড় সর্বগ্রাসী জ্বরের দুকূলপ্লাবী জোয়ার। আর তার বিশ্বস্ততম অনুবাদক কবিতাই।
প্রেমানুভূতি আমার কবিতার সিংহভাগ।' কিন্তু আরেক পর্বে এই মানবী প্রেমিকার মুখ থেকে মাতৃমূর্তিতে স্থিত হয়েছিল। যদিও মা-কে খুব বেশি কবিতা তাঁর নেই। কিন্তু কবির জীবনদর্শনে 'মা' সারাজীবন নিঃশব্দ ধ্রুবপদ হয়ে ছিল। আর ছিল নারকেল-সুপারি ঘেরা তাঁর নিজের বৈঠপুর গ্রাম। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ডাকিনীমোহিনী দড়াটানা নদী নারীর অধিক অধিকার নিয়ে আবুবকরের কবিতাকে বিস্তার করে তাঁর কবিতাভুবনের পরিসর ক্রমান্বয়ে বড় থেকে বড়তর করে তুলেছিল।
কিন্তু যে বহুবর্ণিল জীবন কাটিয়ে গেছেন আবুবকর সিদ্দিক সেই অভিজ্ঞতার, আনন্দের বা বেদনার ভাষিক উদ্ভাসন কি সম্ভব! এক জীবনে কতকিছু যে দেখেছেন কবি! দক্ষিণবাংলার সাইক্লোন দেখেছেন বার বার। সুন্দরবনের শ্বাপদ-সান্নিধ্যে কাটিয়েছেন বহু-সময়। বাওয়ালিদের ঘুরেছেন জঙ্গলের বিস্ময় দেখতে। বাংলাদেশের চাখার থেকে দৌলতপুর, বাগেরহাট-কুষ্টিয়া থেকে রাজশাহী।
এসব জায়গার অভিজ্ঞতার ছাপ আকীর্ণ হয়ে আছে তাঁর কবিতায়, কথাসাহিত্যে। কিন্তু বকর নিজে জানিয়েছেন, 'সেই দলিত অজগরসড়ক কোথাও উজ্জ্বল, কোথাও ধূসর, কিছুটা ধূলিলিপ্ত, কিছুটা পিচঢালা, তবে তার দশআনাই দুর্ভেদ্য আলো-আঁধারীর রহস্যে অজ্ঞেয়। মানুষের কবিতায় তার কতটুকু অনুলিখন সম্ভব!' হয়তো বর্ণমালা ততটা প্রকাশক্ষম নয়, যতটা শিল্পী প্রকাশ করতে চান। তবু সারাজীবন আবুবকর এই ধ্যান করে গেছেন। কবির সার্বভৌম ক্ষমতা নিয়ে চেষ্টা করেছেন ভাষার সর্বোত্তম ব্যবহার করতে।
কবিতা যাপন করেছেন। যখন কবিতা লেখেননি তখনও কবিতার কথাই ভেবেছেন। এমন আত্মনিমগ্ন হয়ে কবিতার কথা ভেবেছেন যে, কবি ও কবিতা কখনো কখনো একীভূত হয়ে গেছে। কবি নিজে চমৎকার করে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন: 'কবিতাসংসর্গ আমার জীবনে এক বিশুদ্ধ সঙ্গম। কবিতা লেখাটাই অন্তত আমার কাছে সেরাভাবে বেঁচে থাকা। জীবনে এমনকিছু নিগূঢ় বোধ আছে, যা শুধু কবিতায়ই অভিব্যক্তি পেতে পারে। পৃথিবীর অনিরুদ্ধ গতি যখন আমাতেই বেন্দ্রবিন্দু খুঁজে পায়, তখন নিশিগন্ধা কমলের মত নিঃশব্দে দল মেলে ফুটে ওঠে একটি দিব্য কবিতা।' ফলে, গল্প-উপন্যাসে যথাযোগ্য সাফল্য লাভ করলেও আবুবকর ভেতরপ্রাণে একজন কবি ছাড়া আর কিছুই ছিলেন না। একটি সদ্য রচিত কবিতার কাছে জীবন সমর্পণ করে তিনি ভুলে যেতেন জীবনের বৈষয়িক ব্যর্থতার গ্লানি। একটি কবিতা তাঁকে মুক্তি দিত সংসারের হিংস্রতা, বন্ধুর শাঠ্য, উপকৃতের কৃতঘ্নতা, অযোগ্যের উল্লম্ফন আর দৈন্যের অভিশাপ থেকে। তিনি বলতেন, 'চারদিকে এত হলাহল, কবিতা বিনা বাঁচতাম কী করে!
কবিতা তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। মনে হয়, কবিতাই তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে। অনিবার্য মৃত্যু এসে তাঁকে আড়াল করে দিলেও সেই আড়াল থেকে কবিতাই তাঁকে ফিরিয়ে দেবে আমাদের কাছে। কারণ, মৃত্যু কখনো প্রকৃত কবিকে বিস্মৃত করতে পারে না। আর আবুবকর সিদ্দিক নিজেও মৃত্যুকে কখনো তত গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেননি। কবিতায় বলেছেন, 'মৃত্যু কি মিলিয়ে দেবে আঁশমাস?/ মৃত্যু কতখানি নির্ভরশীল পোস্টম্যান?/ সে কি পারে পঁচিশবছরের হারানো/ঠিকানা খুঁজে দিতে?'('পঁচিশবছর': নিজস্ব এই মাতৃভাষায়) আবার মৃত্যুকে খুব নিভৃতে গ্রহণ করে আমাদের সবিনয়ে জানিয়েছিলেন সে-কথা:
আমি চলে যাচ্ছি। আজ ব্লাডপ্রেশার কাল
চুলে শাদা ছোপ পশু কিডনি ড্যামেজ; আমি
ঘণ্টা নেড়ে নেড়ে বর্ণহীন বীথি ধরে ধরে,
আমি এক আমার মতো নিপাট নিরিবিলি
কবি চলে যাচ্ছি রক্তক্ষত নিয়ে। এই ছায়া
নিরাময় নিমের ফুলপাতাবাকলবর্জিত
পুরাবৃক্ষ, পতিত ছায়ার কংকাল। আমি-
আমি চলে যাচ্ছি আমার মতো, যেমন গোসাপ
চলে যায় জলার হিমতলায় জল শুকিয়ে
যেতে যেতে। হে পথিকবর, আমার কবরের
কাছে এসে ভয় নেই হোঁচট খাবার।
আমি কোনো কীর্তি কোনো স্তম্ভ যাচ্ছি না
রেখে। কোনো আন্দোলন নেই আমাকে
নিয়ে অন্তরীক্ষে ধুলোবালিলিপ্ত সংসারে।
শিল্প মানেই মানুষের চোট খাওয়া স্বপ্ন মূলত;
ছায়া ঘনতর ও লম্বা হয়ে আসছে, বিদায়! ('চোট': নিজস্ব এই মাতৃভাষায়)
আবুবকরের অনাড়ম্বর মৃত্যু তার কবিতার মতই সত্য। কিন্তু কবিতার উজ্জ্বল আলো তাকে কখনো অন্ধকারে ঢেকে দেবে না।
Comments