গ্রন্থাগার আছে, পাঠক নেই
গ্রন্থাগার বা পাঠাগার, যে কোন সমাজের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রসঙ্গে রংপুর বিভাগের গ্রন্থাগার নিয়ে আমার দেখা অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে চাই। এই বিভাগে সরকারি-বেসরকারি-ব্যক্তি উদ্যোগে অনেক গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তার মধ্যে অল্পসংখ্যক গ্রন্থাগারের অবকাঠামোগত অবস্থা এবং পড়ার পরিবেশ ভালো। এই অঞ্চলের অনেক পুরনো গ্রন্থাগারের অবস্থা পরিচর্যার অভাবে জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে আছে।
রংপুর একই সাথে মহানগর, বিভাগীয় শহর, মেট্রোপলিটন শহর, দেশের পুরনো জেলাগুলোর একটি। এই শহরে পুরোনো গ্রন্থাগার আছে। রংপুর সরকারি গণগ্রন্থাগারের পাশে এমন আরেকটি গ্রন্থাগার যেন কঙ্কালসার হয়ে আছে। শুধু কয়েকটি জাতীয় দৈনিক পড়ার জন্য কিছু পাঠক আসে। অথচ, সমৃদ্ধ পাঠাগার ছিল এটি। এখানে বিপুল সংখ্যক বই ছিল। এখন সেই বইও কমে যাচ্ছে। রংপুরের আদি শহর মাহিগঞ্জ। সেখানেও অনেক পুরোনো গ্রন্থাগার ছিল। এখন শুধু সেই গ্রন্থাগার ভবনের ঠিকানাটুকু আছে।
কারমাইকেল কলেজে একটি গ্রন্থাগার আছে। যেমন পুরাতন তেমন বইয়ের দুর্লভ সংগ্রহ। বিপুল পরিমাণ বইয়ের সম্ভার আছে। বই আছে, গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনাও ভালো। পরিচর্যাও আছে। কেবল পাঠকের অভাবেই এখানে গ্রন্থাগার মলিন।
দিনাজপুর শহরে একটি পুরনো পাঠাগার আছে। এই পাঠাগারে এখনো অনেক পুরোনা দুর্লভ বই আছে। সেসব বইয়ের প্রকৃত পরিচর্যার খুবই অভাব। অবহেলা আর অযত্নে সেগুলো ধ্বংস হতে বসেছে। দিনাজপুর শহরেই এক ব্যক্তি ব্যক্তি উদ্যোগে নিজ বাড়িতে একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার গড়ে তুলেছেন। সেটির অবস্থা ভালো। প্রতিষ্ঠাতা কয়েক বছর হলো মারা গেছেন। পাঠাগারটির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। রংপুর বিভাগের যে কটি লাইব্রেরি খুব ভালো চলছে তার মধ্যে অন্যতম হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থগার। এখানে পাঠকে ভরা থাকে গ্রন্থাগারটি।
কুড়িগ্রাম জেলা শহরে গণগ্রন্থাগার ছাড়াও দুটি পুরাতন গ্রন্থাগার আছে। পুরাতন শহরে একটি গ্রন্থাগার আছে। পাঠকের অভাব আছে সেখানে। আরেকটি আছে কলেজ মোড়েই। এখানেও পাঠকের উপস্থিতি নগণ্য। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য জনলেরও সংকট আছে। সব মিলে এদুটি গ্রন্থাগারের অবস্থা ভালো নেই। গাইবান্ধা জেলা শহরের প্রাণকেন্দ্রে একটি বেসরকারি গ্রন্থাগার আছে। জেলা পৌর পার্কের ভেতরেই এই এর অবস্থান। গ্রন্থাগারটিতে প্রচুর পুরনো বইয়ের সংগ্রহ আছে। কিন্তু এসবের ওপর ধুলো-বালি জমেছে। অনেকগুলো তাক খোলাই হয়না। পঞ্চগড় শহরে একটি পুরোনা বেসরকারি গ্রন্থাগার আছে। এই গ্রন্থাগারে সাধারণত যারা আসেন তারা পত্রিকা পড়তেই আসেন। গ্রন্থাগারের ভেতরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদি হয়।
নীলফামারী সরকারি গণগ্রন্থাগারের সামনে আরেকটি বেসরকারি গণগ্রন্থাগার আছে। সেটি দুর্বল ব্যবস্থাপনা আর পাঠক স্বল্পতার কারণে তার অতীত ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। এখন পাঠকও কম, যত্নও সেরকম নেই। এসব পুরনো গ্রন্থাগার ছাড়াও নতুন গড়ে ওঠা অনেক গ্রন্থাগারও আছে। এগুলোর মধ্যে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। গাইবান্ধা জেলা সদর এর ফুলছরি উপজেলায় বেশ কয়েকটি গ্রন্থাগার স্থানীয়রা গড়ে তুলেছেন। সেই গ্রন্থাগারগুলো ভালো চলছে। বই সংখ্যাও অনেক কম। বাসদের পরিকল্পনায় এগুলো প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। পাঠক সীমিত হলেও অন্যান্য গ্রন্থাগারের তুলনায় বইয়ের স্বল্পতা সত্ত্বেও ভালো চলছে।
রংপুর বিভাগে মোট ৮টি জেলা। এই আটটি জেলায় ৮টি জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগার রয়েছে। ৮টি গণগ্রন্থাগারের অধীনে দুই শতাধিক নিবন্ধিত গ্রন্থাগার আছে। সরকারি কলেজগুলোতে আছে একটি করে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার। বেসরকারি কলেজগুলোতেও গ্রন্থাগার আছে। বেসরকারি কলেজে যখন স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর কোর্স চালু করা হয় সেখানে নির্দিষ্ট সংখ্যক বই না থাকলে কোর্স চালুর অনুমিত দেওয়া হয়না। অনেক স্কুলেও গ্রন্থাগার আছে।
উল্লিখিত গ্রন্থাগার ছাড়াও স্থানীয়দের উদ্যোগে অনিবন্ধিত আরও অনেক গ্রন্থাগার আছে। গ্রন্থাগারের সংখ্যা বাড়ছে। বর্তমানে স্থানীযভাবে তরুণদের উদ্যোগে বেশ কিছু গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে।
জেলাভিত্তিক সরকারি গণগ্রন্থাগারগুলোতে উপযুক্ত কাঠামো আছে। জনবলের মাধ্যমে প্রকৃত পাঠব্যবস্থাপনাও এগুলোতে বিদ্যমান। হয়তো কোথাও কোথাও জনবল সংকট আছে। সেই সংকটের কথা বাদ দিলে পাঠক চাইলে উপযুক্ত পরিবেশে তারা গ্রন্থাগারগুলোতে পড়তে পারেন। গ্রন্থগারগুলোতে যে গ্রন্থাগারিক আছেন তারাও পাঠকের সন্ধান করেন। গ্রন্থাগারের অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অধিকাংশই চেষ্টা করেন পাঠক আসুক পাঠগ্রহণ করতে।
কোভিড এর সংক্রমণের আগে আমি রংপুর বিভাগের গণগ্রন্থাগারগুলো পরিদর্শন করেছি। সেই সময়ে গ্রন্থাগারগুলোতে যে সংখ্যক বই পেয়েছি তার চেয়ে বর্তামনে খুব বেশি বই বেড়েছে বলে মনে হয়না। সে সময়ে সরকারি গণগ্রন্থাগারগুলোর চিত্র এখানে তুলে ধরছি।
বইয়ের সংখ্যা দৈনিক পত্রিকা পাঠক (প্রায়) ইস্যু (মাসিক)
ঠাকুরগাঁও ২৭০০০ টি ১১ টি ৪৫০০ জন ১০ টি
কুড়িগ্রাম ৩২০০০ টি ১১ টি ৪৫০০ জন ১০০ টি
নীলফামারী ৩০০০০ টি ১১ টি ২৫০০ জন ৫০ টি
রংপুর ৫০০০০ টি ১৩ টি ৫৫৫০ জন ৫০০ টি
গাইবান্ধা ২৬০০০ টি ১১ টি ৩৫০০ জন ১০০ টি
দিনাজপুর ৩৬০০০ টি ১১ টি ৫২০০ জন ৫০ টি
পঞ্চগড় ৩৩০০০ টি ১১ টি ৫০০০ জন ২০ টি
লালমনিরহাট ৩৪০০০ টি ১১ টি ৪৫০০ জন ১৫ টি
রংপুর বিভাগের সরকারি গণগ্রন্থাগারগুলোর পাঠকের শ্রেণীবিন্যাস পর্যালোচনা করলে কোন শ্রেণীর পাঠক কেমন আসছে বই পড়তে তার একটি ধারণা পাওয়া যায়। বই পড়তে আসা পাঠকের মধ্যে পুরুষ পাঠকের সংখ্যা সব জেলার সরকারি গণগ্রন্থাগারে বেশি পাওয়া যায়। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে শিশু। তৃতীয় স্থানে নারী।
পত্রিকার পাঠকদের শ্রেণীবিন্যাস পর্যালোচনা করে দেখা যায় এখানেও পুরুষ পাঠকের সংখ্যা বেশি। নারী পাঠকের সংখ্যা পত্রিকার পাঠাকের তালিকায় দ্বিতীয়। এবং তৃতীয় অবস্থানে আছে শিশু। এর কারণই হলো পত্রিকা পড়ার মতো শিশুরা হয়ে ওঠেনি। মোট পাঠকের প্রায় অর্ধেক পাওয়া যাচ্ছে পুরুষ। তিন কিংবা চারভাগের এক ভাগ হচ্ছে শিশু। বাকিরা নারী পাঠক। শিশুরা মূলত স্কুলের শিক্ষার্থী। কলেজের শিক্ষার্থীও কম। এখন ইন্টারনেটের মাধ্যমেও অনেকে পড়তে আসেন। এই সংখ্যা গ্রন্থাগার বিশেষে এবং মাসের তারতম্য অনুযায়ী ২০ জন থেকে ১৫০ জন পর্যন্ত হচ্ছে।
মোবাইল/কম্পিউটার এর যুগে এসে যে পাঠকের সংখা কমেছে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। বই বিক্রির দোকানগুলোতে থেকেও জানা যায়, পাঠক ক্রমে ক্রমে কমছে। কথা ছিল- যেহেতু দেশে সাক্ষরতার হার বাড়ছে তাই পাঠকের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাওয়ার কথা ছিল। বাস্তাবে ঘটছে তার উল্টোটা। বাড়ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাড়ছে শিক্ষিতের হার। আর কমছে পাঠক সংখ্যা। মোবাইল/কম্পিউটারের প্রতি অত্যধিক মাত্রায় আসক্তিও পাঠক সংখ্যা কমাচ্ছে।
বর্তমানে স্কুল-কলেজ পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা পাঠগ্রহণের পরিবর্তে ফলাফল ভালো করার চেষ্টায় থাকে বলে গ্রন্থাগারভিত্তক পাঠকের সংখ্যা খুবই কমে আসছে। শিশুদের পাঠগ্রহণের স্বাধীনতা থাকেলে তিনি হয়তো গ্রন্থাগারমুখী হতে পারতেন। কিন্তু অভিভাবকদের চাপেও অনেক সময় স্কুল-কলেজেরে শিক্ষার্থীরা নিজেদের পাঠক্রমভুক্ত বইয়ের মধ্যে বন্দী রাখতে বাধ্য হয়। আর এই বয়সে পাঠাভ্যাস গড়ে না ওঠার কারণেও তথাকথিত শিক্ষিতজনেরা গ্রন্থাগারমুখী হননা।
সরকারি গণগ্রন্থাগারগুলোতে বৈচিত্র্যপূর্ণ বইয়ের সমাহার। সেই বৈচিত্র্যপূর্ণ বইও পাঠককে আকৃষ্ট করতে পারছে না। বিচিত্র স্বাদের পাঠকগণ চাইলে সেখানে নিজেদের পছন্দের বই পড়তে পারেন। তারপরও পাঠক উপস্থিতি হতাশাব্যঞ্জক।
সমাজে যত নৈরাজ্য তার মূলে মানুষের শিক্ষা না থাকা। শ্রেণিকক্ষ হয়ে উঠেছে সনদনির্ভর। গ্রন্থাগারগুলো আলো দেখাতে পারতো। কিন্তু জ্ঞাননির্ভর সমাজ নির্মাণে রাষ্ট্রীয়-সামজিক-পারিবারিক চেষ্টা না থাকায় গ্রন্থাগার বিমুখ হয়েছি। একটি সুস্থ জাতি গঠন করতে হলে আমাদের গ্রন্থাগারমুখি তথা পাঠমুখী হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।
Comments