১ যুগ গবেষণা শেষে ৬ ‘নতুন জাতের’ ধান উদ্ভাবনের দাবি কৃষক আরুনির

দীর্ঘ ১২ বছরের চেষ্টায় সংকরায়ণ বা ইম্যাসকিউলেশন ও পলিনেশন করে ৬ ধরনের নতুন ধান উদ্ভাবনের দাবি করেছেন খুলনার বটিয়াঘাটার গঙ্গারামপুর গ্রামের কৃষক আরুনি সরকার।
১ যুগ গবেষণা শেষে ৬ ‘নতুন জাতের’ ধান উদ্ভাবনের দাবি কৃষক আরুনির
ইম্যাসকিউলেশন ও পলিনেশন করে ৬ ধরনের নতুন ধান উদ্ভাবনের দাবি কৃষক আরুনি সরকার। ছবি: স্টার

দীর্ঘ ১২ বছরের চেষ্টায় সংকরায়ণ বা ইম্যাসকিউলেশন ও পলিনেশন করে ৬ ধরনের নতুন ধান উদ্ভাবনের দাবি করেছেন খুলনার বটিয়াঘাটার গঙ্গারামপুর গ্রামের কৃষক আরুনি সরকার।

স্থানীয় কৃষকরা নতুন জাতের ধানগুলো চাষ করছেন। নতুন এ ধানের স্বীকৃতির জন্য তিনি সরকারের কাছে আবেদন করেছেন। 

আরুনির স্বপ্ন ছিল বিলুপ্তপ্রায় স্থানীয় আমন ধানের নতুন জাত উদ্ভাবন করবেন। যার মাধ্যমে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষকদের দরিদ্রতা রোধ হবে এবং অধিক ফলন হবে। তার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। 

আরুনি সরকারের উদ্ভাবিত ধানগুলো উপকূলীয় অঞ্চলের স্থানীয় আমন ধানের থেকে আরও বেশি লবণাক্ততা ও জলাবদ্ধতা সহিষ্ণু, ফলনও ভালো। তুলনামূলক কম কীটনাশক ও সার প্রয়োগ করতে হয় এ জাতের ধান চাষে। 

আরুনি সরকার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গবেষণায় দেখা গেছে, নতুন ধরনের ৬টি ধানের ফলন তাদের মাদার ও ফাদার ধানের তুলনায় বেশি। ওই ৬ ধরনের ধান স্থানীয় ও উচ্চফলনশীল ধানের চেয়েও ভালো ফলন দিচ্ছে।' 

নতুন ধানগুলোর গাঁথুনি ঘন, শীষ লম্বা ও দুর্যোগসহিষ্ণু হয়েছে বলে জানান তিনি। 

খুলনা মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন কেন্দ্রের জৈষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অমরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আরনি দাবি করেছেন, তার উদ্ভাবিত ধান আরও বেশি লবণসহিষ্ণু যা আড়াই থেকে ৩ ডিএস পর্যন্ত লবণ সহিষ্ণু। তাছাড়া এসব ধান ১০-১৫ দিন পর্যন্ত জলাবদ্ধতায় টিকে থাকতে পারে। সাধারণত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে চাষ হওয়া হাইব্রিড কিংবা উচ্চফলনশীন আমন মৌসুমের ধান ৫-৬ দিন পানির নিচে থাকলে পচে যায়।' 

খুলনার বটিয়াঘাটার কাতিয়ানাংলা গ্রামের কৃষক আইয়ুব আলীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৯ সাল থেকে তিনি জমিতে কাটারিভোগ ও চাপশাইল ধান চাষ করেন। সে সময়ে তিনি ৫০ শতকের প্রতি বিঘায় পেতেন প্রায় ১৬ মণ ধান। গত বছর আরুনি উদ্ভাবিত 'আলো ধান' চাষ করে প্রতি বিঘায় প্রায় ২৪ মণের মতো ফলন পেয়েছেন।

খুলনা অঞ্চলের স্থানীয় আমন ধানের জীবনকাল সর্বোচ্চ ১৭০ পর্যন্ত হয়ে থাকে। যেমন, বিআর ২৩-এর জীবনকাল ১৫৪ দিন আবার 'জটাই বালাম'-এর জীবনকাল ১৪৫ দিন। কিন্তু আরনি উদ্ভাবিত এই দুই ধানের সমন্বয়ে উদ্ভাবিত 'আলো ধান'-এর জীবনকাল দেখা গেছে ১৩৫ দিন। তেমনিভাবে দেখা গেছে 'মৈত্রী ধান' বা 'গঙ্গাধান'-এর জীবনকাল ফাদার- মাদার-এর চেয়ে ১০ থেকে ১২ দিন কম। 

এ ছাড়া নতুন উদ্ভাবিত ধানগাছগুলো তুলনামূলক মোটা হওয়ায় বাতাসে পড়ে যাওয়ার ভয় নেই বলে জানান আরুনি সরকার। 

খুলনা অঞ্চলে গত ২ বছর আগে যখন 'কারেন্ট' পোকার আক্রমণে অধিকাংশ খেতের ধান নষ্ট হয়ে যায়, তখন আরুনির ধানে কোনো পোকা লাগেনি। যা দেখে আশপাশের কৃষকদের আগ্রহ আরও রেড়ে যায়। 

তার উদ্ভাবিত নতুন এই ধানগুলো হলো—'আলো ধান', 'লোকজ ধান', 'আরুনি ধান', 'গঙ্গা ধান', 'মৈত্রী ধান' ও 'লক্ষ্মীভোগ' ধান। স্থানীয় কৃষকরা এই ধানগুলোর নামকরণ করেছেন। 

স্থানীয় জাতের জটাই বালাম (মাদার) ও বিআর তেইশ (ফাদার) জাতের ইম্যাসকুলেশন ও পলিনেশন বা মিশ্রণে যে ধান তৈরি হয়েছে, সেটির নাম দেওয়া হয়েছে 'আলো ধান'। এটি প্রতি বিঘায় ২৪ মণ পর্যন্ত উৎপাদিত হতে পারে। সাহেবকচি ও কাঁচড়া জাতের মিশ্রণে তৈরি ধানের নাম 'লোকজ ধান'। এটি প্রতি বিঘায় ২৩ দশমিক ৮৬ মণ পর্যন্ত উৎপাদন হয়েছে বলে জানান স্থানীয় কৃষকরা। 

এ ছাড়া চাপশাইল ও কুমড়াগইর জাতের সংকরায়ণে তৈরি ধানের নাম রাখা হয়েছে 'আরুনি ধান'। এই ধানের উৎপাদন সবচেয়ে বেশি ২৪ দশমিক ১৫ মন প্রতি বিঘায়। 

এ ছাড়া বেনাপোল ও ডাকশাইল ধানের মিশ্রণে তৈরি হয়েছে 'গঙ্গা ধান'। এর ফলন হয়েছে প্রতি বিঘায় ২১ দশমিক ২৫ মণ। বিআর–২৩ (মাদার) ও জটাই বালাম (ফাদার) জাতের ধানের মিশ্রণে তৈরি ধানের নাম দেওয়া হয়েছে 'মৈত্রী ধান'। এর উৎপাদন ২২ দশমিক ৭৫ মণ। বজ্রমুড়ি ও কুমড়াগইর ধানের মিশ্রণে তৈরি হয়েছে 'লক্ষ্মীভোগ ধান'। এর উৎপাদন প্রতি বিঘায় ২২ মণ পর্যন্ত হতে পারে। 

আরুনি সরকার ২০১০ সালের অক্টোবর মাসে স্থানীয় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা লোকজ-এর অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতায় পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার গুলিসাখালি রিসোর্স সেন্টারে আমন ধানের সংকরায়ণ বিষয়ে ৬ দিনের প্রশিক্ষণে অংশ নেন। ফিলিপাইনের কৃষিবিজ্ঞানী ও গবেষক বংকায়া বান তাদের প্রশিক্ষণ দেন।

আরুনি সরকার। ছবি: স্টার

প্রশিক্ষণ শেষে বাড়ি ফিরে আরুনি বিলুপ্তপ্রায় স্থানীয় আমন ধানের জাতগুলোর মধ্যে ১০টিকে মাদার এবং ১০টি জাতকে ফাদার হিসেবে নিয়ে কাজ শুরু করেন। প্রথম বছরই কৃত্রিম সংকরায়ণের মাধ্যমে ১০ ধরনের ধানের বীজ (এফ-১) তৈরি করেন। পরের বছর থেকে ওই বীজগুলো খেতে রোপন করে নির্ধারণের কাজ করেন তিনি। দীর্ঘ ১০ বছর গবেষণা শেষে ৬ ধরনকে উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য চাষাবাদ উপযোগী হিসেবে স্থানীয় কৃষকরা স্বীকৃতি দেন এই ৬ প্রকার ধানকে। ইতোমধ্য এই ধান চাষ করা শুরু করেছেন স্থানীয় কৃষকরা। 

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাগ্রোটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আরনি সঠিক পথেই এগুচ্ছেন। আরুণি যে কাজটি করেছেন, আমরা তাকে সংকরায়ণ পদ্ধতি বলে থাকি।'

অধ্যাপক মনিরুল আরও বলেন, 'তাকে এখন জাতীয় বীজ প্রত্যয়ন বোর্ডের নিকট আবেদন করতে হবে এর স্বীকৃতি পাবার জন্য। আরুনি তার কাজটুকু করে দেখিয়েছেন এখন সরকারের বিরিকে এগিয়ে আসতে হবে।'

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) পরিচালক ডক্টর মোহাম্মদ শাহজাহান কবীর দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নিশ্চয়ই সে সঠিক পদ্ধতি মেনে গবেষণা করেছেন। দেখার বিষয়, অধিক ফলনের বৈশিষ্ট্য ধারাবাহিকভাবে থাকে কি না। কখনো কখনো আমরা দেখি দুবছর পর বৈশিষ্ট্য চেঞ্জ হয়ে যায়। আমি বিরির সাতক্ষীরার গবেষকদের বলবো তার উদ্ভাবিত ধান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখার জন্য।'

তিনি আরও বলেন, 'এই কৃষকের উদ্ভাবিত ধানকে কীভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া যায় তা ভেবে দেখব। আসলে কৃষকরাই আমাদের পথ দেখান।' 

ইতোমধ্যেই দাকোপ-বটিয়াঘাটা অঞ্চলের কৃষকরা আরুনি উদ্ভাবিত ৬টি জাতের ধান চাষাবাদ শুরু করেছেন। ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণ হচ্ছে এই জাতগুলো। চলতিবছর এ অঞ্চলের ৫৮ জন কৃষক ২ শতাধিক বিঘা জমিতে আরুনি উদ্ভাবিত ধানগুলো চাষ করেছেন। যে ধানের ফলন ভালো, লবণাক্ততা ও জলাবদ্ধতা সইতে পারে, তুলনামূলক কম কীটনাশক ও সার প্রয়োগ করতে হয়। ফলে কৃষকরা এই ধান চাষে ঝুঁকছেন।
 

Comments