তেঁতুলিয়ায় সৌন্দর্য ছড়াচ্ছে শীতের দেশের টিউলিপ
![](https://bangla.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/images/2023/02/09/thakurgaon_pic-tulip-07.jpg?itok=KDS3X7iT×tamp=1675915789)
শীত প্রধান দেশের শোভাবর্ধক টিউলিপ ফুল প্রস্ফুটিত হয়ে আপন মহিমায় সৌন্দর্য ছড়াচ্ছে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায়।
নৈসর্গিক এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ ছুটে আসছেন তেঁতুলিয়ার দর্জিপাড়ায়।
পর্যটকদের এই বাড়তি আকর্ষণ দেশের সর্বউত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের সম্ভাবনাময় পর্যটনখাতকে বিকশিত করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে শক্তিশালী করবে, যা স্থানীয়দের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
সম্প্রতি তেঁতুলিয়ার দর্জিপাড়ায় দেখা যায়, সূর্যের তাপ নিয়ন্ত্রণে মশারির মতো বিশেষ ছাউনির নিচে বাহারি রঙয়ের সারি সারি টিউলিপ ফুল ফুটে রাজসিক সৌন্দর্যে মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে।
শীতপ্রবণ এলাকার ভিনদেশি এই ফুল বাংলাদেশের তেঁতুলিয়ায় ফুটেছে—এটা শুনেই কৌতূহল ও সৌন্দর্য উপভোগের বাসনা নিয়ে প্রত্যন্ত এই গ্রামে ছুটে আসছেন দর্শনার্থীরা। অনেকে ছুঁয়ে দেখছেন, কেউবা ছবি তুলছেন, আবার অনেকেই আপনজনদের সঙ্গে টিউলিপের সৌন্দর্য প্রাণবন্তভাবে ভাগাভাগি করতে ভিডিও ধারণেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
বাবা-মায়ের সঙ্গে টিউলিপ বাগানে ঘুরতে এসে আনন্দে বিহ্বল কলেজ শিক্ষার্থী নাতাশা ইব্রাহীম বলেন, 'এতদিন সিনেমায় ও ইউটিউবে টিউলিপ দেখেছি। সেই অপরূপ সৌন্দর্যের টিউলিপ এখন আমাদের পঞ্চগড়ে। সত্যিই এটা অসাধারণ, ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না।'
ঢাকা থেকে বেড়াতে আসা আত্মীয়দের নিয়ে টিউলিপ বাগানে ঠাকুরগাঁও থেকে এসেছেন ব্যবসায়ী সোহরাব হোসেন আশিক।
তিনি বলেন, '২০১২ সালে ভারতের কাশ্মীরে বিস্তীর্ণ টিউলিপ বাগানের দেখেছি প্রথম। সেই ফুল তেঁতুলিয়ায় হচ্ছে জেনে আত্মীয়দের নিয়ে দেখতে এলাম।'
সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের পরিকল্পিত উদ্যোগে পঞ্চগড়ের পর্যটন খাতের ব্যাপক উন্নয়ন সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) এবং ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর এগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্টের আর্থিক সহায়তায় একটি প্রকল্পের অধীনে ইকো সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (ইএসডিও) উদ্যোগে ২০ জন প্রান্তিক কৃষক টিউলিপ চাষ করেছেন।
![](https://bangla.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/images/2023/02/09/thakurgaon_pic-tulip-06.jpg?itok=BNBp2Yul×tamp=1675915922)
কৃষক হোসনে আরা বেগম, মোর্শেদা বেগম, মনোয়ারা বেগম ও খাদেজা বেগম জানান, গত বছর তারা সম্মিলিতভাবে ২০ হাজার টিউলিপ চাষ করেছেন ২০ শতক জমিতে। তারা প্রতিটি গাছ বিক্রি করেছিলেন ৮০ থেকে ১০০ টাকা করে। এতে প্রত্যেকের প্রায় ৭০ হাজার টাকা করে লাভ হয়েছিল।
গত বছর সারা দেশ থেকে টিউলিপ দেখতে বিপুল দর্শক আসায় এবার প্রকল্পের পাশে তারা দর্শকদের স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী খাবার ও থাকার ব্যবস্থা করেছেন।
ইএসডিও কর্মকর্তা ও প্রকল্পের সমন্বয়কারী আইনুল হক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'টিউলিপ চাষের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ ও এর চাহিদা অনুধাবন করে চলতি শীত মৌসুমে সারা দেশে, বিশেষ করে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় গত বছরের চেয়ে বেশি জমিতে টিউলিপ চাষ করছেন কৃষি উদ্যোক্তারা।'
বিদেশি এই ফুলের প্রতি মানুষের আকর্ষণ লক্ষ্য করে চলতি মৌসুমে নেদারল্যান্ডস থেকে ২ লাখ বাল্ব বা কোন্দ আনা হয়েছে, যেখানে গত বছর দেশে এই সংখ্যা ছিল ৮০ হাজার।
এর মধ্যে ইএসডিওর উদ্যোগে নেদারল্যান্ডস ও ভারতের কাশ্মীরের টিউলিপ খেতের নৈসর্গিক সৌন্দর্য বিবেচনায় স্থানীয় ২০ জন কৃষি উদ্যোক্তার মাধ্যমে সম্মিলিতভাবে ২ একর জমি লিজ নিয়ে প্রায় ৮৬ হাজার বাল্ব বপন করা হয়েছিল গত ১১ জানুয়ারি।
সেখানে টবে রোপণ করা হয়েছে ১৬ হাজার বাল্ব, যেন দর্শনার্থীরা সহজেই ফুটন্ত সেই ফুল তাদের ঘর কিংবা অফিসে রাখতে পারেন।
টিউলিপের বাল্ব বপনের ২০-২২ দিন পর থেকে কলি ফুটতে থাকে।
এ বছর তেঁতুলিয়ার গ্রামটিতে ১০ জাতের ১০ রঙয়ের টিউলিপ শোভা পাচ্ছে। এগুলো হলো এন্টার্কটিকা (সাদা), ডেনমার্ক (অরেঞ্জ শেড), লালিবেলা (লাল), ডাচ সানরাইজ (হলুদ), স্ট্রং গোল্ড (হলুদ), জান্টুপিঙ্ক (গোলাপি), হোয়াইট মার্ভেল (সাদা), মিস্টিক ভ্যান ইজক (গোলাপি), হ্যাপি জেনারেশন (সাদা লাল শেড) এবং গোল্ডেন টিকিট (হলুদ)।
এক প্রশ্নের জবাবে আইনুল হক বলেন, 'গত বছর প্রথমবারের মতো উপজেলার ৩টি স্থানে ৮ জন ক্ষুদ্রচাষি ৪০ শতক জমিতে টিউলিপ চাষ করে সফলতা পান। তাদের সফলতা দেখে চলতি মৌসুমে এই ফুল চাষে যোগ দিয়েছেন এলাকার আরও ১২ জন প্রান্তিক চাষি।'
গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কৃষি উদ্যোক্তা মো. দেলোয়ার হোসেন, যিনি বাংলাদেশে প্রথম ২০২০ সালে সফলভাবে টিউলিপ ফুল ফুটিয়েছেন, দ্য ডেইলি স্টারকে মুঠোফোনে জানান, চলতি মৌসুমে তিনি নেদারল্যান্ডস থেকে ২ লাখ টিউলিপ বাল্ব আমদানি করেন।
এ বছর এই ২ লাখ বাল্ব নেদারল্যান্ডস থেকে এনে দেশের বিভিন্ন জেলায় কৃষি উদ্যোক্তাদের কাছে সরবরাহ করা হয় প্রতি পিস ৬২ টাকায় (ভ্যাট ও ট্যাক্সসহ)।
![](https://bangla.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/images/2023/02/09/thakurgaon_pic-tulip-04.jpg?itok=Fs3ZFCvL×tamp=1675915922)
গত বছর টিউলিপ চাষ করে সফল হওয়া চাষিরা চলতি মৌসুমে গতবারের চেয়ে বেশি বাল্ব কিনেছেন বলে জানান তিনি।
এরমধ্যে তেঁতুলিয়ায় ১ লাখ বাল্ব বিক্রি হয়েছে, যা গত বছর ছিল ৪০ হাজার। দেলোয়ার হোসেন তার গ্রাম শ্রীপুরে ৭০ হাজার বাল্ব বপন করেছেন, যা গত বছর ছিল ৩০ হাজার।
অপরদিকে, রাজশাহীর একজন উদ্যোক্তা নিয়েছেন ৫ হাজার, যিনি গত বছর ১ হাজার বাল্ব নিয়েছিলেন।
এ ছাড়া, যশোরের গদখালীতে ৫ হাজার, রাঙামাটিতে ৬ হাজার, বাগেরহাটে ৫০০, নাটোরে ৫০০, কুমিল্লায় ৩০০, কুমিল্লায় ৩০০সহ অন্যান্য কৃষকদের মাঝে অবশিষ্ট বাল্ব সরবরাহ করা হয়েছে।
টিউলিপ চাষের এই পথপ্রদর্শক বলেন, 'দেশের ফুল-বাজারে টিউলিপের চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। এভাবে ফুল চাষ বৃদ্ধি পেলে বর্তমানে বিদেশ থেকে ফুল আমদানি করে যে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হচ্ছে তা থেকে পরিত্রাণ মিলবে।'
এই ধরনের উচ্চমূল্যের ফুল চাষ সম্প্রসারণে সরকারি সহযোগিতার ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, 'সরকার এ বিষয়ে এগিয়ে এলে ফুলের চাষ বাড়বে, সেই সঙ্গে তরুণদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।'
তিনি জানান, এখন তারা ১৫ নভেম্বর থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টানা ৪ মাস টিউলিপ ফুল কীভাবে বাজারে রাখা যায়, সেই পরিকল্পনা করছেন।
তেঁতুলিয়ার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, 'দেশের আবহাওয়া আসলে টিউলিপ চাষের জন্য খুব বেশি উপযোগী নয়। কিন্তু শীত মৌসুমে তেঁতুলিয়ার তাপমাত্রা দিনের বেলায় ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি এবং রাতের তাপমাত্রা আরও কম থাকে। পঞ্চগড়ে দীর্ঘ সময় শীত থাকায় এখানকার আবহাওয়া টিউলিপ চাষের জন্য সহায়ক। এ কারণেই এখানে সফলতা পাওয়া যাচ্ছে।'
এই কৃষি কর্মকর্তা বলেন, 'অম্লীয়, বেলে-দোআঁশ মাটি, যার পিএইচ ৬-৭ এর মধ্যে থাকে, তা টিউলিপের জন্য উপযোগী। সাধারণত এই ফুলের বাল্ব বা কোন্দ বপনের পর বৃদ্ধির সময় দিনের তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে এবং রাতের তাপমাত্রা ৫ থেকে ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস প্রয়োজন।'
'সকালে ও বিকেলে সরাসরি সূর্যালোক ফুলের গুণমান উন্নত করার জন্যও উপকারী। দুপুরে যখন তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়, তখন আংশিক ছায়ার জন্য শেড নেট ব্যবহার করার প্রয়োজন হয়। টিউলিপ চাষের জন্য মাটি প্রস্তুত করার জন্য পর্যাপ্ত জৈব সারসহ রাসায়নিক সারের সীমিত ব্যবহার প্রয়োজন', যোগ করেন তিনি।
ইএসডিওর নির্বাহী পরিচালক মো. শহীদ উজ জামান বলেন, 'সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার জন্য দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রচুর দর্শক তেঁতুলিয়ায় আসছেন। যদি পরিকল্পনা অনুযায়ী টিউলিপ চাষ এগিয়ে যায়, তাহলে এটি পর্যটকদের জন্য একটি অতিরিক্ত আকর্ষণ হবে এবং উত্তরাঞ্চলের পর্যটনখাতকে সমৃদ্ধ করবে, যা স্থানীয়দের জীবনযাত্রার উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।'
তিনি বলেন, 'তেঁতুলিয়ায় বছরের প্রায় ৪ মাস শীত থাকে। তাই বিশেষজ্ঞদের মতে, এখানকার তাপমাত্রা টিউলিপ চাষের জন্য প্রায় উপযুক্ত। ইএসডিও চাষিদের ঢাকা, রংপুরসহ বিভিন্ন ফুলের বাজারে তাদের উৎপাদিত পণ্য সরবরাহ করতে সাহায্য করছে এবং বছরের বাকি সময়গুলোতে তাদের অন্যান্য ফুল চাষসহ আয়বর্ধক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করে জীবনমান উন্নয়নে ইতোমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে।'
পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, 'এই ক্ষুদ্র কৃষি উদ্যোক্তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন সবসময় তাদের পাশে রয়েছে। এ ছাড়া, জেলার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও পর্যটনখাতের উন্নয়নে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সর্বাত্মক সহায়তা দেওয়ার জন্য সরকার ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।'
Comments