খড়ের বিনিময়ে ধান কাটা উৎসব 

কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলার পানান বিলে খড়ের বিনিময়ে ধান কাটা উৎসব চলছে। ছবি: স্টার

কৃষক রাসেল মিয়ার দুটি গরু। এসময় তার বাড়িতে খড়ের সংকট দেখা দিয়েছে। নিজের জমির ধান পাকতে আরও দুই সপ্তাহ লাগতে পারে। 

রাসেল মিয়ার প্রতিবেশী রফিকুল ইসলামেরও আটটি গরু। তার বাড়িতেও খড়ের সংকট। বাজারে গিয়েও মিলছে না খড়।

এদিকে বৈশাখ মাসের আরও প্রায় ১০ দিন বাকি। ধান এখনো ভালোভাবে পাকেনি। কিছুদিন পরেই পুরোদমে শুরু হবে বোরো ধান কাটা উৎসব।

তবে কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলার পানান বিলে লাখুহাটি এলাকার কৃষক হারুন মিয়ার প্রায় একশ শতাংশ জমির ধান একটু আগেভাগেই পেকে গেছে। তিনি জমির ধান কাটার ঘোষণা দিতেই রাসেল ও রফিকুলসহ খড় সংকটে থাকা আশপাশের প্রায় সব কৃষক খড়ের বিনিময়ে তার জমির ধান কেটে দিতে ভিড় করেছেন।

ছবি: স্টার

এভাবেই প্রতিবছর যাদের ধান একটু আগেভাগে পেকে যায়, খড়ের বিনিময়ে অন্য কৃষকরা তার ধান কেটে দেন। 

এলাকার কৃষকরা জানান, খড়ের বিনিময়ে ধান কাটার বিষয়টি তাদের কাছে একটি উৎসবের মতো লাগে। গতকাল শুক্রবার থেকে পানান বিলে খড়ের বিনিময়ে ধান কাটার এই উৎসব শুরু হয়েছে। 

সরেজমিনে পানান বিলে গিয়ে দেখা যায়, ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই ৩০-৪০ জনের একটি দল ধান কাটা ও মাড়াইয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন। কেউ ধান কাটছেন, কেউ ধান ঝেড়ে খড়ের মুঠি আলাদা করে স্তূপ করে রাখছেন। কেউ কেউ মাথায় ও সাইকেলে করে খড়ের মুঠি নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। তারা কেউ ধান কাটার শ্রমিক নন। সবারই কম-বেশি ধানি জমি রয়েছে। মূলত তারা সবাই এসেছেন খড় উৎসবে। এতে উভয় পক্ষই লাভবান হচ্ছেন। জমির মালিকদের শ্রমিক খরচ বেঁচে যাচ্ছে। 

ছবি: স্টার

কৃষক হারুন মিয়া জানান, পানান বিলে তার একশ শতাংশ জমির ধান অন্যদের তুলনায় একটু আগেভাগে পেকে গেছে। ধান কাটার কথা জানাজানির পর এলাকার ৩০-৪০ জন খড়ের বিনিময়ে ধান কেটে মাড়াই করে দিয়েছেন। এতে তার প্রায় ১০ হাজার টাকা শ্রমিকের খরচ বেঁচে গেছে। অন্যদিকে যেসব কৃষকের জমির ধান কাটতে এখনো ১০-১৫ দিন বাকি, তারাও গরুকে খাওয়ানোর খড় পেলেন। এতে তার কিছু খড় হারালেও কয়েক দিন পর অন্য জমির ধান কাটলে সেটা পূরণ হয়ে যাবে। পানান বিলে আগেভাগে পেকে যাওয়া ২০-২৫ জন কৃষকের কয়েক একর জমির ধান এভাবে খড়ের বিনিময়ে কাটা হয়। কয়েক বছর ধরে এ প্রথা চলে আসছে।

ধান কাটতে কাটতে কৃষক সিরাজ মিয়া জানান, তার তিনটি গরু আছে। বাড়িতে গরুর খাবারের খড় শেষ হয়ে গেছে। নিজের জমির ধান কাটতে এখনো দশ-পনেরো দিন লাগবে। এমন অবস্থায় তিনিও অন্যদের সঙ্গে খড়ের জন্য হারুন মিয়ার জমির ধান কাটতে এসেছেন।

ছবি: স্টার

উত্তর লাখুহাটি গ্রামের আরেক কৃষক খুরশিদ মিয়া বলেন, 'এখন শেষ মুহূর্তে প্রায় সবারই খড়ের সংকট। বাজারে খড়ের দামও বেশি। তাই প্রথম প্রথম যার জমির ধান কাটা হয়, সবাই মিলে আমরা বিনা পয়সায় তাদের ধান কেটে মাড়াই করে দিই। আজ আমিও ধান কেটে ২০ মুঠির মতো খড় নিজের গরুর জন্য বাড়িতে নিয়ে গেছি।'

স্থানীয় শিক্ষক আব্দুল হাই জানান, পানান বিলে তার নিজেরও জমি আছে। প্রতিবছর বোরো মৌসুমে প্রথম প্রথম যাদের ধান পাকে, তাদের ধান খড়ের বিনিময়ে অন্যরা কেটে দেন। কয়েক বছর ধরে পানান বিলে এ প্রথা চলে আসছে। এটাকে তারা খড় উৎসব বলে ডাকেন।

ছবি: স্টার

এ বিষয়ে কিশোরগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. সাদিকুর রহমান বলেন, 'আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় কৃষকেরা ইতিমধ্যে টুকটাক ধান কাটা শুরু করেছেন। অনেক জায়গায় খড় উৎসবও চলছে। সপ্তাহ দুয়েক পর পুরোদমে ধান মাড়াই শুরু হবে। প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগ না হলে এবার ধানের বাম্পার ফলন পাবেন কৃষকরা।'

তিনি জানান, এবার জেলার ১৩ উপজেলায় এক লাখ ৬৮ হাজার ১১৫ হেক্টর জমিতে ধানের আবাদ করা হয়েছে। এতে চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে সাত লাখ ৮৮ হাজার ৯১২ টন।

বোরো মৌসুমের শেষ পর্যন্ত যেন কৃষকদের মুখে হাসি থাকে, সেই প্রত্যাশা করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Exporters caught off guard by India’s import curbs

"This sudden decision could severely disrupt bilateral trade"

7h ago