সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় কিশোরীকে পুলিশ কর্মকর্তার অসহযোগিতা

রাজধানীর ওয়ারীতে একটি বাসায় কাজ করতো ১৬ বছর বয়সী সাদিয়া আক্তার (ছদ্মনাম)। ২০২১ সালের ২ ডিসেম্বর প্রেমিক সুমন চন্দ্র দাসের (৩০) নির্দেশনা অনুসারে সাদিয়া সেই বাসা থেকে সোনার গহনা ও নগদ টাকা চুরি করে বরিশালে পালিয়ে যায়।
বাংলাদেশে নারী ধর্ষণ
স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

রাজধানীর ওয়ারীতে একটি বাসায় কাজ করতো ১৬ বছর বয়সী সাদিয়া আক্তার (ছদ্মনাম)। ২০২১ সালের ২ ডিসেম্বর প্রেমিক সুমন চন্দ্র দাসের (৩০) নির্দেশনা অনুসারে সাদিয়া সেই বাসা থেকে সোনার গহনা ও নগদ টাকা চুরি করে বরিশালে পালিয়ে যায়।

মামলার বিবরণে বলা হয়েছে, সুমন তাকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। বরিশালে পৌঁছানোর পর তিনি সাদিয়াকে লঞ্চঘাট থেকে একটি হোটেলে নিয়ে যান। সেখানে তিনি ও তার বন্ধুরা তাকে সংঘবদ্ধভাবে ধর্ষণ করেন এবং তার কাছ থেকে স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকা নিয়ে তাকে সেখানেই ফেলে রেখে যান।

সাদিয়ার অগ্নিপরীক্ষা সেখানেই শেষ হয়নি।

চুরির ঘটনায় মামলার কয়েকদিন পর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও ওয়ারী থানার উপপরিদর্শক সোহেল রানা সাদিয়াকে তার গ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করেন। অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার কারণে আদালত তাকে ১০ মাসের জন্য সংশোধন কেন্দ্রে পাঠান। পুলিশ এ মামলায় অভিযোগপত্র দাখিলের পর বর্তমানে বিচারের অপেক্ষায় আছে সাদিয়া।

কিন্তু সাদিয়া থানায় ধর্ষণের অভিযোগ করলেও যারা তাকে ধর্ষণ করেছে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

সাদিয়া ডেইলি স্টারকে জানান, পুলিশ তাকে ধর্ষণের মামলা করার আশ্বাস দিয়েছিল। তবে এ ঘটনার ১১ মাস পেরিয়ে গেলেও ধর্ষকদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি। ধর্ষণের মেডিকেল রেকর্ডও সংরক্ষণ করা হয়নি।

'আমি ধর্ষণের কথা জানালে তদন্ত কর্মকর্তা আমাকে ৫ থেকে ৬টি সাদা কাগজে সই করিয়ে ধর্ষণের মামলা করার আশ্বাস দিয়েছিলেন, কিন্তু কোনো মামলা করেননি', বলেন সাদিয়া।

তার ভাষ্য, তদন্ত কর্মকর্তা যে জায়গায় সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে সেটি পরিদর্শন করেছেন এবং এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছেন। কিন্তু তবু তিনি প্রতিশ্রুতি রাখেননি। কোনো ধর্ষণ মামলা করেননি।

অবশেষে গত বছরের ২৯ অক্টোবর চুরির মামলায় জামিন পেয়ে সুমন চন্দ্র দাস (৩০) ও ইমরান হোসেন মল্লিকের (২৩) বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা করেন সাদিয়া।

বরিশালের কাউনিয়া উপজেলার কালীগঞ্জ গ্রামের সুমন এবং একই জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার দাড়িয়াল গ্রামের ইমরানকে ২০২২ সালের ১৯ জানুয়ারি চুরির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে সুমন ২ মাস পর এবং ইমরান ২০-২৫ দিন পর জামিনে মুক্তি পান, যদিও সাদিয়া অক্টোবর পর্যন্ত জামিন পাননি বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।

এদিকে ২০২২ সালের ১৯ জানুয়ারি ঢাকা মহানগর আদালতের বিচারক মোহাম্মদ নুরুল হুদা সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় সাদিয়ার জবানবন্দি রেকর্ড করেন।

ধর্ষণের ঘটনায় মামলার পর বরিশাল থানা পুলিশ ২ জনকে গ্রেপ্তার করে। তাদের আদালতে তোলা হলে প্রধান আসামি ধর্ষণের বিষয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। কিন্তু মেডিকেল রেকর্ড ও অন্যান্য প্রমাণ না থাকায় আসামিরা আবার জামিনে মুক্ত হন।

সাদিয়া বলেন, 'আমি চাই আমার ধর্ষকদের শাস্তি হোক। আমি এখনো আশা করি সরকার আমাকে ন্যায়বিচার দেবে, কিন্তু আমি নিশ্চিত নই যে আমি ন্যায়বিচার পাবো। কারণ আমার কাছে এখন কোনো কার্যকর প্রমাণ নেই।'

চুরির মামলায় সাদিয়া, সুমন ও ইমরানের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা সোহেল রানা। চুরির সময় সাদিয়ার বয়স ১৬ বছর হওয়ায় তার জন্য পৃথক অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়।

সেই চার্জশিটে উপপরিদর্শক সোহেল রানা বলেন, বরিশালে সাদিয়াকে সুমন ও ইমরান ধর্ষণ করেছে।

এ বিষয়ে চুরির মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সোহেল রানার বক্তব্য নেওয়ার জন্য এক সপ্তাহ ধরে তার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।

জানতে চাইলে ওয়ারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. কবির হোসেন হাওলাদার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মেয়েটি এবং তার ২ বন্ধুকে একটি চুরির মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মেয়েটি অভিযোগ করেছে যে তাকে একটি হোটেলে তার বন্ধুরা ধর্ষণ করেছে।'

'আমরা ধর্ষণের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে আদালতের নির্দেশনা চেয়েছিলাম। কিন্তু ধর্ষণের অভিযোগের বিষয়ে আমরা আর কোনো আদেশ পাইনি। সে কারণেই আমরা শুধু চুরির মামলায় চার্জশিট দাখিল করেছি,' বলেন তিনি।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে ধর্ষণ একটি অপরাধ এবং একজন পুলিশ কর্মকর্তার সেই এখতিয়ার আছে যে তিনি ওয়ারেন্ট ছাড়াই গ্রেপ্তার করতে পারেন এবং আদালতের অনুমতি নিয়ে বা অনুমতি ছাড়াই তদন্ত শুরু করতে পারেন।

এ ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা কী হওয়া উচিত ছিল জানতে চাইলে আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চুরির ঘটনাটি সত্য, এবং এর জন্য তিনি শাস্তি পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু এই ঘটনায় তদন্ত কর্মকর্তা ধর্ষণের শিকার সেই কিশোরীর প্রতি নিছক অবহেলা দেখিয়েছেন।'

'যেহেতু আসামিরা পুলিশ হেফাজতে ছিল, সেহেতু তদন্ত কর্মকর্তার উচিত ছিল ওই কিশোরীর মেডিকেল টেস্টের ব্যবস্থা করা। মেডিকেল রিপোর্টটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৩২ ধারায় অত্যন্ত মূল্যবান। পুলিশ আসামিদের রিমান্ড চাইতে পারতো', বলেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, 'যদি অভিযুক্ত মেয়েটিকে ধর্ষণের কথা স্বীকার করত, তবে পুলিশ পৃথক চার্জশিট দাখিল করতে পারত - একটি চুরির জন্য এবং আরেকটি ধর্ষণের জন্য।'

ঘটনার সত্যতা জানার পরও ধর্ষণের ঘটনায় এমন নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করায় ওই তদন্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেন জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।

ধর্ষণের প্রমাণ সম্পর্কে যোগাযোগ করা হলে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) ফজলুল করিম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের কাছে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের একটি লিখিত অভিযোগ রয়েছে এবং সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার কিশোরী ১৬৪ ধারায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাছে এ বিষয়ে জবানবন্দি দিয়েছে।'

মেডিকেল রিপোর্টের বিষয়ে জানতে চাইলে এডিসি বলেন, 'ধর্ষণ মামলার আলামত খুঁজে পাওয়া কঠিন। কারণ ঘটনাটি প্রায় ১ বছর আগে ঘটেছিল। তাছাড়া ঘটনাটি অনেক দিন আগের হওয়ায় মেডিকেল রিপোর্টও খুব একটা কাজে আসবে না।'

তিনি আরও বলেন, 'তদন্ত কর্মকর্তা সোহেল রানা যদি আগে আদালতকে জানাতেন যে ভিকটিমকে সংঘবদ্ধভাবে ধর্ষণ করা হয়েছে, তাহলে বরিশাল পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে ডাক্তারি প্রমাণ সংগ্রহের চেষ্টা করতে পারতো।'

Comments