কম্বোডিয়ায় বাংলাদেশি ‘সাইবারদাস’দের দুঃসহ জীবন

মাসে প্রায় ৮০ হাজার টাকা বেতন-ভাতা, থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থাসহ একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানে রিসেপশনিস্টের চাকরি। এমন সুবর্ণ সুযোগ ২৫ বছর বয়সী বেকার যুবক ফয়সাল হোসেনের জন্য হাতছাড়ার করার মতো ছিল না।
কম্বোডিয়ার উপকূলীয় শহর সিহানুকভিলের একটি কম্পাউন্ড। এখানে ‘সাইবার দাস’দের দিয়ে অপরাধমূলক কাজ করানো হয়। ছবি: সংগৃহীত

মাসে প্রায় ৮০ হাজার টাকা বেতন-ভাতা, থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থাসহ একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানে রিসেপশনিস্টের চাকরি। এমন সুবর্ণ সুযোগ ২৫ বছর বয়সী বেকার যুবক ফয়সাল হোসেনের জন্য হাতছাড়ার করার মতো ছিল না।

প্রয়োজনীয় সব প্রক্রিয়া শেষে ফয়সাল ২০২১ সালের ৯ জানুয়ারি অভিবাসী কর্মী হিসেবে কম্বোডিয়ায় যান।

কম্বোডিয়ার উপকূলীয় শহর সিহানুকভিলে 'দ্য ক্রাউন কলেজ' নামে ১৮তলা বিলাসবহুল ভবনটিই ছিল তার কর্মস্থল। সেখানে তিনি বিভিন্ন দেশের তরুণদের কম্পিউটার ডেস্কে ব্যস্ত সময় কাটাতে দেখে মুগ্ধ হন। এমনকি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তাকে কম্বোডিয়া নিয়ে যাওয়া বাংলাদেশি দালালের জড়িয়েও ধরেছিলেন।

ফ্লাইটে ওঠার কয়েক মাস আগে তিনি নিজ শহর নরসিংদীতে এক দালালকে ২ লাখ ৪৭ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। ফয়সাল ভেবেছিলেন, তার জীবন বদলে যাবে।

আসলেই এই চাকরি তার জীবনকে এমনভাবে বদলে দিয়েছে, যা তিনি দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি।

ফয়সাল টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা করেছেন। কম্বোডিয়ায় পৌঁছানোর পরের ১১ মাস তাকে কী দুঃসহ জীবন কাটাতে হবে, তা তিনি কল্পনাও করেননি।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটিতে সাইবার স্ক্যাম অপারেটরদের কাছে বাংলাদেশিদের একটি চক্র ফয়সালকে 'সাইবারদাস' হিসেবে বিক্রি করে। তার কাজ ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামির এক ধনী তরুণী সেজে অনলাইনে স্ক্যামিংয়ের মাধ্যমে মার্কিন পুরুষদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া।

ফয়সাল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শুরুতে আমি প্রতিবাদ করেছিলাম। কিন্তু তারা জানায়, আমাকে ৪ হাজার ডলারে বিক্রি করা হয়েছে। এই টাকা ফেরত না দিলে আমি কম্পাউন্ড ছেড়ে যেতে পারব না। তখন নিজেকে খুব অসহায় লাগে, বিধ্বস্ত হয়ে পড়ি।'

কাজ করতে না চাইলে ফয়সালকে ওই কমপ্লেক্সের ভেতরে একটি টয়লেটে কয়েকদিন আটকে রাখা হয়। মারধর, বৈদ্যুতিক শকের মতো নির্যাতনের শিকারও হন তিনি। সহকর্মীদের কাছে জানতে পারেন, সেখানে কয়েকজনকে নির্যাতন করে হত্যাও করা হয়েছে।

ফয়সাল বাংলাদেশ থেকে কম্বোডিয়ায় গিয়ে দাসত্বের কবলে পড়া অনেকের মতোই একজন। তার মতো আরও কয়েক হাজার তরুণ-তরুণী কম্বোডিয়া জুড়ে সিহানুকভিলের মতো কম্পাউন্ডগুলোতে আটকে আছেন। মূলত এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে তাদেরকে নেওয়া হয়েছে।

দীর্ঘদিন ধরে মানবপাচার এশিয়ার একটি আঞ্চলিক সমস্যা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাস মহামারিতে এ ধরনের সাইবার অপরাধ আরও বেড়েছে এবং অপরাধে বৈচিত্র্য এসেছে।

কম্বোডিয়ায় মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের বিশেষ দূত অধ্যাপক ভিতিত মুনতারভর্ন তার এক প্রতিবেদনে সিহানুকভিলে স্ক্যামিং কম্পাউন্ডগুলোকে 'নরকের' সঙ্গে তুলনা করেছেন।

তিনি বলেন, কম্বোডিয়ার সাইবার কেলেঙ্কারি সেন্টারগুলোতে সাম্প্রতিক অভিযান সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র গত বছরের আগস্টে মানবপাচারের ওপর করা বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে যে, এই ধরনের অপরাধের সঙ্গে কম্বোডিয়ার বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা 'সহযোগী' হিসেবে কাজ করছেন।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে, কম্পাউন্ডগুলো যারা পরিচালনা করে আসছেন, তারা এতটাই শক্তিশালী যে স্থানীয় পুলিশের কাছ থেকে সাহায্য চাওয়া হলে উল্টো ভুক্তভোগীদেরই আরও নির্যাতনের শিকার হতে হয়।

প্রতিবেদনগুলোতে কম্বোডিয়াকে সাইবার কেলেঙ্কারি কেন্দ্রগুলোর জন্য 'হটস্পট' হিসেবে উল্লেখ করা হলেও এ ধরনের সাইবার কেলেঙ্কারি কেন্দ্র থাইল্যান্ড, লাওস ও মিয়ানমারের সীমান্ত শহরগুলোতেও রয়েছে।

সাইবার কেলেঙ্কারির শিকারদের নিয়ে তৈরি প্ল্যাটফর্ম গ্লোবাল অ্যান্টি-স্ক্যাম সংস্থার (গ্যাসো) কর্মকর্তা আমান্ডা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কেলেঙ্কারির কেন্দ্রগুলো বেশিরভাগই চীনের নাগরিকরা পরিচালনা করে থাকেন। তবে সেখানে তাইওয়ানিজ এবং মালয়েশিয়ান বসও রয়েছে।'

বিবিসি, আল-জাজিরায় প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং ভুক্তভোগীদের সাক্ষাৎকার থেকেও তার এই বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া যায়।

আমান্ডা বলেন, 'কম্বোডিয়া ছাড়াও থাইল্যান্ড সীমান্তের কাছে মিয়ানমারের মায়াওয়াদ্দিতেও অনেক বাংলাদেশি আটকা পড়েছেন।'

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সাল থেকে প্রায় ৩ হাজার ৫৯৬ জন বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মী ভ্যারিফায়েড চ্যানেলের মাধ্যমে কম্বোডিয়ায় গেছেন। তাদের মধ্যে ২০২২ সালে গেছেন ২ হাজার ২০০ জনের বেশি, ২০২৩ সালের প্রথম ১২ দিনে গেছেন ৮৬ জন। তবে ভ্যারিফায়েড না, এমন চ্যানেলের মাধ্যমে কতজন শ্রমিক সেখানে গেছেন সে সংখ্যাটি এখনো অজানা।

গত বছরের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কম্বোডিয়ায় বন্দিদশায় কাটিয়েছেন আবদুস সালাম। মেরুদণ্ডে আঘাত পেয়ে ২১ ডিসেম্বর ঢাকার ফেরেন তিনি। একটি হাসপাতালে তার অস্ত্রোপচার হয়। তার ধারণা, এই কম্পাউন্ডগুলোতে কয়েকশ বাংলাদেশি দাসের মতো বন্দি হয়ে আছেন।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কম্বোডিয়ায় বাংলাদেশি দালালদের একটি চক্র, যাদের মধ্যে অনেকে একসময় এর শিকার হয়েছিলেন, তারা এখনো বাংলাদেশি তরুণদের পাচার করে চলেছে। প্রধানত চীনা নাগরিকদের পরিচালিত এই কম্পাউন্ডগুলোতে তারা তরুণদের বিক্রি করছে। বাংলাদেশে কিছু স্থানীয় দালাল এবং নিয়োগকারী সংস্থা তাদের সাহায্য করছে।'

কম্পাউন্ডগুলোতে কতজন বাংলাদেশি আছে তার সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। কম্বোডিয়ায় বাংলাদেশের কোনো দূতাবাস নেই। ব্যাংককে কম্বোডিয়ার দূতাবাস, যারা সেখানকার বিষয়গুলো পরিচালনা করে থাকেন, তাদের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা। তাদের দুর্দশা থেকে লাভবান হয়েছেন এমন একজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও অভিযোগ তুলেছেন তারা।

অনলাইনে আবেদন করে বা অন্য দেশে কম্বোডিয়ান দূতাবাসের মাধ্যমে বাংলাদেশিরা কম্বোডিয়ার ভিসা পেতে পারেন। এজেন্সিগুলো সাধারণত ভিসা প্রক্রিয়ার সব কাজ করে থাকে।

প্রতারিত জীবনের গল্প

মহামারি শুরু হওয়ার ঠিক আগে গ্রামের স্থানীয় এক দালালকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা দিয়েছিলেন পিরোজপুরের রুবেল (২০)। নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে আরও ৫ জনের সঙ্গে কম্বোডিয়ায় গিয়েছিলেন তিনি।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দেড় বছর ধরে আমি প্রায় বিনা পারিশ্রমিকে বিভিন্ন নির্মাণ প্রকল্পে কাজ করেছি। এই সময়ে আমার ৫০০ জনেরও বেশি বাংলাদেশি শ্রমিকের সঙ্গে দেখা হয়েছে। তারা সবাই কোনো মজুরি ছাড়াই, না খেয়ে সেখানে কাজ করছিলেন, তারা সবাই প্রতারিত হয়েছেন। তাদের সবারই গল্প একই রকম।'

'সবাইকেই দালালরা ভালো বেতনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল'

তিনি বলেন, 'দালালরা কম্বোডিয়ায় নিয়ে আসার পর শুরুতে কর্মীদের পাসপোর্ট নিয়ে নেন। তারা শ্রমিকদের ভরণপোষণের খরচ হিসেবে মাসে ৫০ ডলার দেন। যখন মহামারি শুরু হয়েছিল, তখন আমাদের একটি ফাঁকা বাড়িতে কোনো খাবার ছাড়া, কাজ ছাড়া রেখে দেওয়া হয়।'

'আমরা ৫ জন ছিলাম এবং দেড় মাস সেখানে বন্দি ছিলাম। কোনো কোনো দিন আমাদের শুধু পানি খেয়ে থাকতে হয়েছে।'

২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ে এক দালাল এসে রুবেলকে জিজ্ঞেস করেছিল, তিনি কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে চাকরি করতে চান কি না। অন্য কোনো উপায় না পেয়ে তিনি রাজি হন। সেই দালাল তাকে এক স্ক্যামিং অপারেটরের কাছে বিক্রি করে দেন।

গত বছর আগস্টে উদ্ধারের আগে তিনি বিভিন্ন সময়ে ৬টি স্ক্যামিং কম্পাউন্ডে বন্দি ছিলেন এবং সব ধরনের মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন।

রুবেল গত বছরের ৪ ডিসেম্বর একটি আন্তর্জাতিক এনজিও'র সহায়তায় খুলনার প্রসেনজিৎ সরকার ও ফেনীর এমরান হোসেন রনিসহ আরও ২ জনের সঙ্গে দেশে ফেরেন।

রুবেল জানান, ওই কম্পাউন্ডে অনেক বাংলাদেশির সঙ্গে তার দেখা হয়েছে।

'ঢাকার যাত্রাবাড়ীর আলামিন শেষ কম্পাউন্ডে আমার সঙ্গে ছিল। সে ডিসেম্বরের শুরুতে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে সাহায্য চায়। এখনো অনেকে আছেন, যাদের সাহায্যের খুব প্রয়োজন।'

১৪ ডিসেম্বর রুবেল পল্টন থানায় একটি মামলা করেন। মামলায় তাকে চাকরির প্রস্তাব দেওয়া মাসুদ খান (৫০) ও এর সঙ্গে জড়িত আরও ৩ জনকে আসামি করেন। অভিযুক্তদের মধ্যে একজন চাঁদপুর জেলার জাহাঙ্গীর আলম (৫৫)। এ ছাড়া, কম্বোডিয়ায় আরও কয়েকজন বাংলাদেশি দালাল রয়েছে, যারা তাকে প্রতারকদের কাছে বিক্রি করেছিল।

কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট বর্তমানে মামলাটি তদন্ত করছে।

গত ১৩ জানুয়ারি কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার তোহিদুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা প্রায় ৬টি রিক্রুটিং এজেন্সির সঙ্গে জড়িত বেশ কয়েকটি অপরাধী চক্র খুঁজে পেয়েছি, যারা বাংলাদেশিদের কম্বোডিয়ায় পাচার করছে এবং সেখানে তাদের দাসত্বের ফাঁদে ফেলছে।'

দ্রুত অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হবে আশা জানালেও এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত অপরাধীদের ধরার বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি।

রক্ষক যখন ভক্ষক

গত বছরের অক্টোবরে বিভিন্ন প্রতারক চক্র থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে উদ্ধার হওয়ার পর প্রসেনজিৎ, রনি এবং ইসমাইল হোসেনসহ ৮ বাংলাদেশি কম্বোডিয়ার নমপেনের অভিবাসন আটক কেন্দ্রে কয়েকদিন ধরে আটকে ছিলেন।

প্রসেনজিৎ, রনি ও ইসমাইলের কাছে বৈধ পাসপোর্ট ছিল। তাদের মুক্তির জন্য কেবল থাইল্যান্ডের বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে একটি অনুরোধপত্রের প্রয়োজন ছিল। অন্যদিকে, ফয়সাল, রুবেল ও অন্যান্যদের পাসপোর্ট হারিয়ে যাওয়ায় তাদের ট্রাভেল পারমিটের প্রয়োজন ছিল।

কিন্তু থাইল্যান্ডে বাংলাদেশ দূতাবাসের অসহযোগিতা কারণে তাদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে বলে জানান তারা।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, তাদের ট্রাভেল পারমিট বা অনুরোধপত্র পাওয়ার জন্য ব্যাংককের বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রশাসনিক কর্মকর্তা (শ্রম শাখা) আব্দুল হাদিকে ঘুষ দিতে হয়েছিল।

প্রসেনজিৎ ও ইসমাইল জানান, বাংলাদেশে তাদের আত্মীয়রা হাদির দেওয়া একটি বিকাশ অ্যাকাউন্টে ৪৫০ মার্কিন ডলার পরিশোধ করেছেন।

ফয়সাল ও রুবেল জানান, বিকাশের মাধ্যমে হাদিকে ১৬ হাজার ৫০০ টাকা দেওয়ার পরই তারা তাদের কাগজপত্র পেয়েছেন।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি সামাজিক উদ্যোগ হিউম্যানিটি রিসার্চ কনসালটেন্সি (এইচআরসি) কম্বোডিয়ায় আটকে পড়া ক্ষতিগ্রস্তদের উদ্ধারে কাজ করে। ভুক্তভোগীদের প্রতি দূতাবাসের এই আচরণকে 'অমানবিক' বলে উল্লেখ করেছেন সংস্থাটির সারভাইভার এমপাওয়ারমেন্ট কর্মকর্তা সালাম।

তিনি বলেন, 'দূতাবাস এমনকি গাসোর ইমেলের উত্তরও দেয়নি। এটি ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন। সাহায্যের জন্য মরিয়া অনেকেই তাৎক্ষণিকভাবে সাড়া দেবে, যদি সরকার দ্রুত ব্যবস্থা নেয়।'

ব্যাংককে বাংলাদেশ দূতাবাসে যোগাযোগ করা গাসোর কর্মকর্তা আমান্ডাও দূতাবাসের নিষ্ক্রিয়তার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, 'দূতাবাস অবশ্যই প্রতিনিধি পাঠিয়ে কম্বোডিয়ার কর্তৃপক্ষকে চাপ দিতে পারতো।'

মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে আব্দুল হাদি তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেন।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দূতাবাস ট্রাভেল পারমিট ও অন্যান্য কাগজপত্রের জন্য ১ হাজার ১৫০ টাকা নেয়।'

ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে অর্থ নেওয়ার জন্য তিনি কম্বোডিয়ায় বাংলাদেশি এজেন্টদের দায়ী করেন।'

এ বিষয়ে ব্যাংককে বাংলাদেশ দূতাবাসের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি। রাষ্ট্রদূত ফোন ধরেননি। প্রশ্ন উল্লেখ করে গত শনিবার ইমেল পাঠানো হলেও দূতাবাস কোনো উত্তর পাঠায়নি।

তবে গতকাল শুক্রবার দূতাবাসের ২ কর্মকর্তা পরিচয় গোপন রাখার শর্তে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দূতাবাস অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখছে। কম্বোডিয়ায় অভিবাসী শ্রমিকদের হয়রানির বিষয়ে দূতাবাস প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে ইতোমধ্যেই কয়েকবার সতর্ক করেছে।'

যোগাযোগ করা হলে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (কর্মসংস্থান শাখা) খায়রুল আলম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কম্বোডিয়ায় বাংলাদেশিদের দাসত্বের বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। আমরা থাইল্যান্ডে আমাদের দূতাবাস থেকে এমন কোনো রিপোর্ট পাইনি।'

জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া উইং) নাজমুল হুদা বলেন, 'থাইল্যান্ডের দূতাবাসের এই ধরনের পরিস্থিতি সম্পর্কে আমি অবগত নই। আমরা অবশ্যই দূতাবাসের কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ খতিয়ে দেখব।'

সংগঠিত অপরাধীদের চক্র

ভুক্তভোগীরা অন্তত ৫টি বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সির নাম উল্লেখ করেছে, যারা দেশব্যাপী দালালদের নেটওয়ার্কের পাশাপাশি অনলাইন বিজ্ঞাপনের মাধ্যমেও শ্রমিকদের চাকরির প্রলোভন দেখিয়েছে।

ঢাকার ধানমন্ডি এলাকায় সরকারি-নিবন্ধিত রিক্রুটিং এজেন্সি এম/এস রাইট জব-এর ফেসবুক পেজে পোস্ট করা কম্বোডিয়ায় একটি লাভজনক চাকরির অফার ২০২২ সালের জুন মাসে এমরান হোসেন রনির নজরে আসে।

এজেন্সি তাকে প্রতি মাসে ন্যূনতম ৬০০ ইউএস ডলার মজুরিতে একজন টাইলস ইনস্টলার হিসেবে চাকরির প্রস্তাব দেয়।

রনি বলেন, 'আমি যখন তাদের ফেসবুক পেজে দেওয়া ফোন নম্বরে কল করি, তখন তারা আমাকে আমার পাসপোর্ট এবং ৫০ হাজার টাকা অগ্রিম পেমেন্ট নিয়ে তাদের অফিসে যেতে বলে।'

'এজেন্সির কার্যক্রম দেখে আমার কোনো আশঙ্কা হয়নি। আমি অগ্রিম টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে সংস্থাটি সাড়ে ৩ লাখ টাকার চুক্তিতে আমাকে রাজি করায়।'

জানতে চাইলে রাইট জবের কর্মকর্তা জিয়াউল হক জানান, তারা কম্বোডিয়ায় ৫-৭ জন কর্মী পাঠিয়েছেন। কিন্তু তাদের দাস হিসেবে বিক্রির বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি।

এমরানের ফেরার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এমরান নির্দোষ। কিন্তু কম্বোডিয়া পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছে।'

এমরানকে কোনো কোম্পানির কাছে বিক্রির বিষয়টিও অস্বীকার করেছেন তিনি।

দ্য ডেইলি স্টার মোট ৩০টি ফেসবুক গ্রুপ ও পেজ খুঁজে পেয়েছে, যারা হয় কম্বোডিয়ায় চাকরির অফার করতো বা এখনো অফার করে আসছে। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর 'ভিসা বাজার' নামে একটি ফেসবুক গ্রুপের একটি পোস্টে লেখা ছিল: 'কম্বোডিয়ার জন্য শ্রমিক ভিসা অ্যাভেইলেবল। কম্পিউটারে দক্ষ এবং প্রাথমিক ইংরেজি বাধ্যতামূলক। বেতন ৮০০ থেকে ১১০০।'

ভুক্তভোগী এবং এনজিও কর্মীরা বলছেন, পাচার রোধ করতে কম্বোডিয়ার বিপদ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে হবে।

গাসোর আমান্ডা বলেন, 'অভিবাসন ছাড়পত্র দেওয়ার আগে অভিবাসীদের পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সাক্ষাৎকার নিলে এ ধরনের অপরাধ অনেকাংশে রোধ করা যাবে। অভিবাসী কর্মীদের বিদেশ ভ্রমণের জন্য ব্যুরো অব ম্যানপাওয়ার, এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিং (বিএমইটি) সার্টিফিকেশন প্রয়োজন। অভিবাসী কর্মীদের বিএমইটি কার্ড বহন করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে প্রতিটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একটি প্রবাসী ডেস্ক রয়েছে।'

জানতে চাইলে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, 'ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা সন্দেহভাজন যাত্রীকে বোর্ডিং করা থেকে বিরত রাখতে পারেন।'

তিনি বিমানবন্দরগুলোতে কঠোর স্ক্রিনিংয়ের ওপরও জোর দিয়েছেন।

তবে ফয়সালের দাবি, বৈধ বিএমইটি কার্ড না থাকা সত্ত্বেও তিনি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন পার হয়েছেন।

প্রবাসী ডেস্কের কর্মকর্তারাও এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত অভিযোগ তুলে ফয়সাল বলেন, 'প্রবাসী ডেস্কে আমার আঙুলের ছাপ না মেলায় একজন কর্মকর্তা এসে আমাকে লাইন থেকে সরিয়ে নিয়ে যান। তিনি আমার এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং তারপরে আমাকে ফ্লাইটে উঠতে দেন।'

তার এই অভিযোগের সত্যতা দ্য ডেইলি স্টার যাচাই করতে পারেনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএমইটির মহাপরিচালক মো. শহিদুল আলম বলেন, 'কম্বোডিয়ায় বাংলাদেশিদের জোরপূর্বক দাসত্বের বিষয়টি আমি জানি না। আমরা এখনো এ ধরনের কোনো অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ সত্য হলে আমাদের সেখানে জনশক্তি রপ্তানি বন্ধের কথা ভাবতে হবে।'

বিমানবন্দরে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, 'আমাদের সার্ভারের সঙ্গে আঙুলের ছাপ না মিললে কোনো প্রবাসী কর্মী ফ্লাইটে ওঠার ছাড়পত্র পাবেন না।'

অভিযোগ অস্বীকার করে একই কথা জানিয়েছেন এইচএসআইএ-তে বিএমইটির সহকারী পরিচালক ফখরুল আলম।

অনুবাদ করেছেন সুচিস্মিতা তিথি

Comments