সাইবার অপরাধ: ঝুঁকিতে শিশু-কিশোররা

২০২৩ সালের মে মাসে সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন (সিক্যাফ) প্রকাশিত ‘বাংলাদেশে সাইবার অপরাধপ্রবণতা ২০২৩’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের মোট সাইবার অপরাধ ভুক্তভোগীদের মধ্যে ১৪ দশমিক ৮২ শতাংশের বয়সই ১৮ বছরের কম।
সাইবার অপরাধ
ছবি: সংগৃহীত

বছর তিনেক আগে ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খুলেছিল রাজধানীর একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ও লেভেলের শিক্ষার্থী রাহাত (ছদ্মনাম)। মাস খানেক আগে ফোন চুরির পাশাপাশি তার ফেসবুকও হ্যাক হয়। হ্যাকার সেই অ্যাকাউন্টটি ব্যবহার করেই তার একাধিক বন্ধু ও স্বজনকে বিকাশে জরুরি ভিত্তিতে টাকা পাঠানোর মেসেজ পাঠায়।

বিশ্বাস করে কয়েকজন পাঠায়ও। টাকা পাওয়ার পরপরই হ্যাকার তাদের ফেসবুকে ব্লক করে দেয়। ব্লক করার পর দুজন বন্ধু রাহাতের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রতারণার বিষয়টি জানতে পারে। 

রাহাত দ্য ডেইলি স্টারকে বলে, 'ফোন চুরি হওয়ার পর আমি আর ফেসবুকে ঢুকিনি, সিমও উঠাইনি। ফোন চুরির পর চোরই সিমে পাসওয়ার্ড রিকভার করে ফেসবুক হ্যাক করেছে।'

ফেসবুকের সুবাদে কাউসার নামের এক ছেলের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী হাবিবার (ছদ্মনাম)। এক পর্যায়ে দুজনের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠে। কয়েক মাস পর সম্পর্কের অবনতি হয়। কাউসার তখন ফেসবুকে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে হাবিবাকে ব্যক্তিগত ছবি ফাঁস করার হুমকি দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করতে শুরু করে এবং টাকা দাবি করে। কিছু টাকা দেওয়াও হয়। কিন্তু পরে কাউসার বড় অংকের অর্থ দাবি করলে হাবিবার পরিবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানালে দুই বন্ধুসহ কাউসারকে আটক করে পুলিশ।

বাংলাদেশে সাইবার অপরাধের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ঝুঁকিতে রয়েছে শিশু-কিশোররা। গত পাঁচ বছরে দেশে সাইবার অপরাধে শিশু ভুক্তভোগীর সংখ্যা বেড়েছে দেড় গুণেরও বেশি। ২০২৩ সালের মে মাসে সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন (সিক্যাফ) প্রকাশিত 'বাংলাদেশে সাইবার অপরাধপ্রবণতা ২০২৩' শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন চিত্রই।

গবেষণা প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, দেশের মোট সাইবার অপরাধ ভুক্তভোগীদের মধ্যে ১৪ দশমিক ৮২ শতাংশের বয়সই ১৮ বছরের কম। ২০১৮ সালে প্রকাশিত সিক্যাফের করা জরিপের তুলনায় যা শতকরা ১৪০ দশমিক ৮৭ শতাংশ বেশি। মূলত ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই সবচেয়ে বেশি সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছে শিশুরা।

কেন সাইবার অপরাধের ক্ষেত্রে শিশু ভুক্তভোগীর হার বাড়ছে জানতে চাইলে গবেষণাটির সমন্বয়ক ও ইনডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান ও মানবিক বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ওবায়দুল্লাহ আল মারজুক বলেন, 'যেকোনো অপরাধের ক্ষেত্রেই শিশুরা বড় ধরনের ঝুঁকিতে থাকে। সাইবার অপরাধের ক্ষেত্রে শিশু ভুক্তভোগীর হার বাড়ার মূল কারণ শিশুদের কাছে সাইবার জগত উম্মুক্ত হলেও তাদের মধ্যে সাইবার সচেতনতা নেই। ফলে এই শিশুরা অপরাধীদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে তাদের শিকারে পরিণত হয়ে ভুক্তভোগী হচ্ছে।'

২০১৯ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত 'অনলাইন সেফটি অব চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ' শীর্ষক গবেষণায় ইউনিসেফ বলেছে, 'দেশের ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সী ৩২ শতাংশ শিশু সাইবার হয়রানির মুখে পড়ছে।'

কেন সাইবার অপরাধে মূল ঝুঁকিতে শিশুরা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও সহযোগী অধ্যাপক শাহারিয়া আফরিন বলেন, 'যেহেতু শিশুদের বয়স কম এবং সবকিছুতেই আগ্রহ বেশি থাকে, তাই তারা সহজেই আকৃষ্ট হয়। অন্যদিকে সহপাঠীদের নিয়ে তাদের নিজস্ব একটি জগত থাকে সেখানে তাদের মধ্যে সচেতনতা গড়ে উঠতে পারে না। বেশিরভাগ শিশুই সহপাঠী কিংবা সাইবার অপরাধীদের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে ভুক্তভোগী হচ্ছে।'

যেভাবে সাইবার অপরাধীদের শনাক্ত করে পুলিশ

ঢাকা মহানগরে সাইবার অপরাধ নিয়ে মূলত কাজ করে থাকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল অপরাধ বিভাগ, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাইবার গোয়েন্দা ও অপারেশন বিভাগ, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) সাইবার টিম।

সাইবার অপরাধের ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী শিশু এবং সাইবার অপরাধীদের ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম) তারেক আহমেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সাইবার অপরাধের ব্যাপারে আমরা সবসময়ই তৎপর রয়েছি। আমাদের কাছে সাইবার অপরাধ নিয়ে কোনো অভিযোগ জমা পড়লেই আমরা অতি দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছি। বিশেষ করে শিশুদের আমরা আলাদা গুরুত্ব দিয়ে থাকি।'

কোন ধরনের সাইবার অপরাধে শিশু ভুক্তভোগীর সংখ্যা বেশি জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'শিশুরা মূলত ফেসবুক ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্ল্যাকমেইলের শিকার হচ্ছে। এ ছাড়া ফেসবুকে তারা নানা প্রস্তাব, আইডি হ্যাকিং, অপ্রীতিকর ছবির প্রকাশের মতো অপরাধের শিকার হচ্ছে।'

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) সূত্রে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল সেন্টার ফর মিসিং অ্যান্ড এক্সপ্লয়টেড চিলড্রেনের (এনসিএমইসি) দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে শিশু যৌন নিপীড়নকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে থাকে সিআইডি।

সিআইডির সাইবার গোয়েন্দা ও অপারেশন বিভাগের এসএসপি তরিকুল ইসলাম বলেন, 'শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন বন্ধ, শিশু পর্নোগ্রাফি নির্মূলের বিষয়ে কাজ করা এনসিএমইসিকে তথ্য দিয়ে থাকে ফেসবুক, গুগলসহ টেক জায়ান্টরা। পরে এনসিএমইসি সংশ্লিষ্ট দেশের গোয়েন্দাদের তথ্যগুলো সরবরাহ করে থাকে। ২০২১ সাল থেকে এনসিএমইসির সঙ্গে কাজ করছে সিআইডি।'

এনসিএমইসির দেওয়া তথ্যে জানা যায়, ২০২২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে ২১ লাখ পর্নোগ্রাফি ও শিশু যৌন নির্যাতনের ভিডিও সংরক্ষিত রয়েছে। 

সিআইডির তথ্যানুসারে, এনসিএমইসির তথ্যের পাশাপাশি অনলাইন ও সোশ্যাল মিডিয়ায় সার্বক্ষণিক নজরদারি ও বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত সাইবার অপরাধের অভিযোগের ভিত্তিতে অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে থাকে সিআইডি।

গ্রামের চিত্র আরও ভয়াবহ

২০২২ সালের নভেম্বর মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের করা এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, গ্রামাঞ্চলে ইন্টারনেট ব্যবহার করা শিশুদের মধ্যে ৫৯ শতাংশ শিশু যেকোনো ধরনের সাইবার নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। অন্যদিকে দুই ধরনের সাইবার নিপীড়নের শিকার হচ্ছে ৩৮ শতাংশ শিশু। ২৬ শতাংশ শিশু তিন ধরনের সাইবার নিপীড়নের শিকার হচ্ছে।

গবেষণায় বলা হয়, গ্রামাঞ্চলে ১১-১৭ বছর বয়সী ৩৩ শতাংশ শিশু ইন্টারনেট ব্যবহার করে। যেসব শিশুরা ইন্টারনেটে বেশি সময় ব্যয় করে তাদের সাইবার নিপীড়নে শিকার হওয়ার আশঙ্কাও বেশি।

কেন শহরের চেয়ে গ্রামে শিশুরা সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছে বেশি জানতে চাইলে গবেষণাটির সমন্বয়ক অধ্যাপক ডা. আতিকুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শহরের তুলনায় যেহেতু গ্রামে সাইবার সচেতনতা কম তাই সেখানে ভুক্তভোগীর সংখ্যাও বেশি। গ্রামে বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের ইন্টারনেট ব্যবহারে কোনো খেয়ালই রাখেন না। অন্যদিকে সেখানে শিশুরা ভুক্তভোগী হলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারস্থ তো দূরে থাক, বিষয়টি আমলেই নেওয়া হয় না। ফলে গ্রামে আমরা বেশি বিপজ্জনক চিত্র দেখছি।'

আইনি সহায়তা নেওয়া হচ্ছে না

সাইবার অপরাধের ভুক্তভোগী অনেক শিশুর পরিবারই আইনি সহায়তা নিচ্ছে না। ভুক্তভোগী একাধিক শিশু ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হওয়ার ভয়ে তারা অভিযোগ জমা দিচ্ছে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভুক্তভোগী এক শিশুর মা এই প্রতিবেদককে বলেন, 'যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। এখন মানুষ জানলে বাকি মান-ইজ্জতও যাবে।'

মূলত অপরাধের মাত্রা তীব্র হলে এবং বড় দুর্ঘটনা ঘটলেই কেবল ভুক্তভোগীদের পরিবার পুলিশের শরণাপন্ন হচ্ছে।

এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার তারেক আহমেদ বলেন, 'সাইবার অপরাধের ক্ষেত্রে শিশুসহ স্পর্শকাতর বিষয়গুলোকে আমরা আলাদাভাবে গুরুত্ব দিয়ে থাকি। এক্ষেত্রে আমরা অভিযোগকারীর নিরাপত্তা এবং তাদের সুরক্ষার বিষয়ে চেষ্টা করে থাকি। ভুক্তভোগী শিশুরা যদি পুলিশের সহায়তা না নেয়, তাহলে এর সমাধান মিলবে না।'

এক্ষেত্রে পুলিশ কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিশেষ সংবেদনশীলতার সঙ্গে ব্যবস্থা নিতে হবে বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক ডা. আতিকুল ইসলাম।

তিনি বলেন, 'সমাজে হেয় প্রতিপন্ন হতে পারে এই ভয়েই অনেক শিশুর পরিবার আইনি সহায়তা নেয় না। এক্ষেত্রে পুলিশ কিংবা সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও বিশেষ সংবেদনশীলভাবে বিষয়টি দেখতে হবে, যেন শিশুরা আবারও একটি আঘাত না পায়। নয়তো এই শিশুরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে, যা তাদের পরবর্তী জীবনেও প্রভাব ফেলবে। অন্যদিকে আইনি সুরক্ষা না দিলে সাইবার অপরাধের শিকার শিশুদের বাস্তব চিত্র কখনোই পুরোপুরি উঠে আসবে না।'

প্রতিকার

সাইবার অপরাধ থেকে শিশুদের রক্ষার জন্য সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সম্মিলিত প্রচেষ্টাই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় বলে মত দেন বাংলাদেশের সাইবার নিরাপত্তা সচেতনতা-বিষয়ক জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক ড. ইজাজুল হক।

তিনি বলেন, 'সাইবার অপরাধ প্রতিরোধে সম্মিলিত উদ্যোগের বিকল্প নেই। কারো একার পক্ষেই এটি রোধ করা সম্ভব নয়। বাবা-মাকে সন্তানদের সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখতে হবে। যতদূর সম্ভব হয় মোবাইল ব্যবহার থেকে দূরে থাকতে হবে। পাশাপাশি বিটিআরসিরও ভূমিকা রয়েছে। তারা নজরদারির মাধ্যমে ব্যবস্থা নিতে পারে। এজন্য আলাদা ইউনিট গঠন করতে পারে তারা।'

'এ ছাড়া ভুক্তভোগী শিশুর বাবা-মায়ের উচিত বিষয়টি না লুকিয়ে সরাসরি আইনি পদক্ষেপ নেওয়া। নয়তো অপরাধীরা আবার অপরাধ করার সাহস পাবে', যোগ করেন তিনি।

Comments