সাগর-রুনি হত্যা: হতাশার ১২ বছর

গত ১২ বছরে তদন্ত প্রতিবেদন জমা ১০৭ বার পিছিয়েছে
সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি। ফাইল ছবি সংগৃহীত

সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যার ১২ বছর পার হলেও তাদের পরিবারের জন্য ন্যায়বিচার এখনো সুদূরপরাহত।

জোড়া খুনের মামলায় আদালত তদন্ত কর্মকর্তাকে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য বারবার তারিখ দেন। তবে কোনোবারই তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা পড়ে না। আদালত আবারও সময় বাড়ান।

এই হতাশাজনক চক্র গত ১২ বছর ধরে চলছে, তদন্তকারীরা তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য ১০৭ বার সময় চেয়েছেন।

ভুক্তভোগী পরিবারগুলো হতাশা প্রকাশ করে একে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের ১২ বছরের ব্যর্থতা বলে উল্লেখ করেছে।

গত সপ্তাহে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জাতীয় সংসদকে জানিয়েছিলেন, সাংবাদিক দম্পতি হত্যার তদন্ত শেষ করার কোনো সময়সীমা বেঁধে দেওয়া সম্ভব নয়।

এর আগে গত ২ ফেব্রুয়ারি আনিসুল হক বলেছিলেন, সাগর-রুনির খুনিদের খুঁজে বের করতে যদি তদন্ত ৫০ বছর লেগে যায়, তাহলে দিতে হবে।

২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে সাংবাদিক দম্পতি মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার এবং এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি তাদের ভাড়া বাসায় নির্মমভাবে খুন হন।

সেই সময় ফ্ল্যাটটিতে বাবা-মায়ের সঙ্গে ছিল তাদের একমাত্র সন্তান মাহির সারোয়ার মেঘ। তার বয়স ছিল তখন মাত্র পাঁচ বছর। বাবা-মায়ের সেই নৃশংস মৃত্যু নিয়ে এখনও অন্ধকারে ১৭ বছরের এই কিশোর।

মামলার বাদী রুনির ভাই নওশের রোমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, শীর্ষ মন্ত্রীদের এমন মন্তব্য তাদের আর অবাক করে না।

'শুরু থেকেই আমরা মন্ত্রীদের কাছ থেকে এ ধরনের বক্তব্য পেয়ে আসছি। এবারই প্রথম নয়। আইনমন্ত্রীর বক্তব্য সেসব বক্তব্যের সংযোজন মাত্র।'

'বিবৃতিগুলো নির্দেশ করে যে সরকার 'কিছু কারণে' ন্যায়বিচারে আগ্রহী নয়।'

তিনি বলেন, 'তারপরও তদন্ত কর্মকর্তা এ ধরনের কথা বলে থাকলে ঠিক আছে। কিন্তু সরকারের একজন শীর্ষ মন্ত্রী যখন এ কথা বলেন, তখন আমরা ন্যায়বিচারের জন্য আমরা কোথায় যাব? এ ধরনের বক্তব্যে এই ধারণাই দৃঢ় হয় যে, তাদের হত্যার পেছনে কোনো প্রভাবশালী মহল থাকতে পারে।'

২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল থেকে, র‌্যাব ১০৫ বার আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমার সময় চেয়েছে। এর আগে আরও দুই সংস্থা দুই বার সময় চেয়েছে। সব মিলিয়ে এই হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে ১০৭ বার সময় পেছানো হয়েছে।

হত্যাকাণ্ডের পরপরই তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তারের প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। সেই ৪৮ ঘণ্টা এখন প্রায় ১,০৫,১৯২ ঘণ্টায় গড়িয়েছে, কিন্তু প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি।

পরিবারের সদস্যরা এখন হত্যার রহস্য সমাধানে সরকারের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন।

মেয়ে ও জামাতা হত্যার বিচারের অপেক্ষায় থেকেই দুই বছর আগে রুনির মা নূর নাহার মির্জা মারা যান।

তদন্তের বিষয়ে রোমান বলেন, 'র‍্যাব অনেক সময় সামান্য পরিমাণ গাঁজা জব্দের মতো বিষয়েও সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। কিন্তু এক্ষেত্রে তারা নীরব ছিল।'

রোমান বলেন, 'শুরুতে তারা (র‍্যাব) মামলার বিষয়ে আগ্রহী ছিল যখন তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। কিন্তু তদন্তভার হস্তান্তর করার পর গত ১২ বছরে তারা কোনো কিছু করতেই ব্যর্থ হয়েছে।

যোগাযোগ করা হলে র‌্যাবের মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন বলেন, ভুক্তভোগী পরিবার র‌্যাবের তদন্তে সন্তুষ্ট না হলে তদন্ত সংস্থা পরিবর্তনের জন্য আদালতে আবেদন করতে পারেন।

তদন্তের বিষয়ে মঈন খান বলেন, 'আমরা সুনির্দিষ্ট দুটি বিষয় উদঘাটনে কাজ করছি- হত্যাকারী ও হত্যার পেছনের উদ্দেশ্য। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা চূড়ান্ত কিছু পাইনি।'

২০১২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি মামলা দায়েরের পর শেরেবাংলা নগর থানাকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিন দিন পর মামলাটি গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তাদের ব্যর্থতার পর মামলাটি র‌্যাবের কাছে হস্তান্তর করা হয় ১৮ এপ্রিল, ২০১২।

মামলায় গ্রেপ্তার আট জনের মধ্যে দুজন জামিন পেয়েছেন। বাকিরা কারাগারে আছেন।

র‌্যাবের অতিরিক্ত এসপি খন্দকার মো. শফিকুল আলম মামলার সপ্তম তদন্ত কর্মকর্তা। ২০১৯ সালের ৭ জুলাই তাকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়।

২০২০ সালের ৭ অক্টোবর, তিনি জোড়া খুনের একটি অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দেন।

অগ্রগতি প্রতিবেদনে তিনি বলেছিলেন, ঘটনাস্থল থেকে জব্দ করা আলামত ডিএনএ পরীক্ষার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফরেনসিক সার্ভিসে (আইএফএস) পাঠানো হয়েছিল। আইএফএস দুই অজ্ঞাত পুরুষের ডিএনএ শনাক্ত করেছে। পরে ওই দুজনকে শনাক্ত করতে যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি ডিএনএ ল্যাব প্যারাবন স্ন্যাপশটের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।

র‍্যাব কর্মকর্তাদের মতে পরীক্ষার ফলাফলে সুনির্দিষ্ট কিছু পাওয়া যায়নি।

আগামী ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকার একটি আদালতে এ মামলার শুনানির দিন ধার্য রয়েছে।

Comments