মাদক মামলা থেকে বাঁচতে এক রোহিঙ্গার ‘আয়নাবাজি’

মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা আবুল হোসেন বাংলাদেশি নাগরিক কারাদণ্ড এড়াতে মো.সালাউদ্দিনের পরিচয় ব্যবহার করেন। ছবি: কোলাজ/সংগৃহীত
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা আবুল হোসেন বাংলাদেশি নাগরিক কারাদণ্ড এড়াতে মো.সালাউদ্দিনের পরিচয় ব্যবহার করেন। ছবি: কোলাজ/সংগৃহীত

মাদকের মামলা থেকে বাঁচতে বাংলাদেশি এক নাগরিকের তথ্য ব্যবহার করেন মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা এক রোহিঙ্গা। ফাঁসিয়ে দেন বাংলাদেশি নাগরিককে। যে কারণে দীর্ঘ সাত বছর ধরে হেনস্তার শিকার হয়েছেন বাংলাদেশের সেই নাগরিক।

সাত বছর পর পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্তে বেরিয়ে এসেছে এসব তথ্য। ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠানো হয়েছে বিশেষ সুপারিশ।

ভুক্তভোগী বাংলাদেশি নাগরিক মো. সালাউদ্দিনের (২৮) অভিযোগ, পুলিশের 'গাফিলতির কারণেই' তার এ ভোগান্তি। মামলার চার তদন্ত কর্মকর্তা জট খুলতে ব্যর্থ হলেও পঞ্চম তদন্ত কর্মকর্তা রোহিঙ্গা আসামির তথ্য বের করে আসামিকে গ্রেপ্তার করেন।

আদালত ও পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া নথিতে দেখা যায়, ২০১৭ সালের ২৮ নভেম্বর ১০০০ ইয়াবা ট্যাবলেটসহ নগরীর চাঁন্দগাও থানার কালুরঘাট সেতুর পাশ থেকে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা আবুল হোসেন। তবে আটকের পর বাংলাদেশের কক্সবাজারের এক নাগরিকের তথ্য নিজের বলে পুলিশের কাছে পরিচয় দেন তিনি।

গ্রেপ্তারের সময় তিনি তার নাম মো. সালাউদ্দিন বলে পরিচয় দেন। পুলিশকে জানান, তিনি কক্সবাজার জেলার চকরিয়া থানার কুটাখালীর মৃত মমতাজ আহমদের ছেলে। মায়ের নাম তৈয়াবা খাতুন। সেই তথ্য ব্যবহার করেই মামলা রুজু করেন চান্দগাও থানার এস আই মফিজুর রহমান। সেই মামলায় আদালতের মাধ্যমে সালাউদ্দিন হিসেবে জেলহাজতে যান রোহিঙ্গা আবুল হোসেন।

এর কিছুদিন পরে আইনজীবির মাধ্যমে হাইকোর্ট থেকে জামিনে গিয়ে পলাতক হন আবুল হোসেন। অন্যদিকে চান্দগাও থানার তৎকালীন প্রথম উপ-পরিদর্শক (এসআই) এএফএম জিয়াউল হুদা সালাউদ্দিনের নামে তার ঠিকানায় তথ্য যাচাই বাছাই করার জন্য ইনকোয়ারি স্লিপ (ই স্লিপ) স্থানীয় থানায় পাঠানো হয়। অভিযোগ আছে, সেখানে আসামির নাম ঠিকানা সঠিকভাবে যাচাই না করেই বাংলাদেশের নাগরিক সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে ১৮ ডিসেম্বর ২০১৭ সালে মাদক মামলায় চার্জশিট দেওয়া হয়।

পরে আদালত এই মামলায় সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। পরোয়ানা নিয়ে তাকে ধরতে গেলেই বাধে বিপত্তি। সালাউদ্দিন জানান, তিনি পুলিশের কাছে কোনোদিন গ্রেপ্তার হননি, থানায় তার বিরুদ্ধে কোনো মামলাও নেই। আবার তার বাবাও জীবিত আছেন মৃত নন। পুলিশের কাছ থেকে মামলার বিষয়ে জানতে পেরে সালাউদ্দিন চট্টগ্রামে আইনজীবির মাধ্যমে আদালতে আবেদন করে পুলিশের চার্জশিট চ্যালেঞ্জ করেন।

সালাউদ্দিন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার নামে কোনো মামলা নেই। আমি চাষাবাদ করে খাই। আমাকে পুলিশ ধরতে এলে শুনি আমার নামে মামলা হয়েছে। পরে ধারকর্জ করে আদালতে এসে আইনজীবী ধরে বিষয়টি আদালতকে জানাই।'

'এই ঘটনায় আমি পুরোপুরি বিপর্যস্ত ছিলাম,' বলেন তিনি।

সালাউদ্দিন জানান তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত থেকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে আসামির ছবি আনতে বলা হয়। পরে আসামির ছবির সঙ্গে আদালতে আবেদন করা সালাউদ্দিনের ছবির মিল না থাকায় মামলাটি আরও অধিক তদন্তের জন্য পিবিআই মেট্রোকে নির্দেশ দেন আদালত।

মামলার তদন্তে তিন তদন্তকারী কর্মকর্তার পর দায়িত্ব পান পুলিশ পরিদর্শক মোজাম্মেল হক। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের খুলশী থানার পরিদর্শক তদন্ত হিসেবে কর্মরত আছেন।

মোজাম্মেল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আবুল হোসেন এবং সালাউদ্দিন দুই জনই পাশাপাশি ইউনিয়নে থাকতেন। আবুল হোসেন রোহিঙ্গা হলেও স্থানীয় লোকজনের বাড়িতে গরু চড়াতো এবং কৃষিকাজ করত। সেই সুবাদে সালাউদ্দিনের নাম ঠিকানা বিস্তারিত জানত।'

'দীর্ঘদিন কোনো ক্লু না পাওয়া গেলেও সালাউদ্দিনের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আমরা একটা ক্লু পাই। অন্যদিকে জেলহাজত থেকে আবুলের ছবি নিয়ে আমরা তার অবস্থান শনাক্ত করতে চেষ্টা করি। সেই ক্লু ধরে আমরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পাশের বাজারে এক ঝালমুড়ি বিক্রিতার সন্ধান পাই। সেই ঝালমুড়ি বিক্রেতাকে আবুলের ছবি দেখালে তিনি আবুলের বাবার নাম আমাদেরকে জানান এবং রোহিঙ্গা হিসেবে শনাক্ত করেন,' বলেন মোজাম্মেল।

মোজাম্মেল হক আরও বলেন, 'আবুল হোসেনের নাম এবং বাবার নাম পাওয়ার পর পুলিশের কাছে থাকা আসামির ডেটাবেজে সার্চ করলে আমরা দেখি এই নামের এক ব্যক্তি উখিয়া থানায় ইয়াবা পাচার মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন চান্দগাও থানার মামলার পরে।'

'উখিয়া থানায় গিয়ে ছবি দেখালে এবং তথ্য নিয়ে আমরা নিশ্চিত হই আবুল হোসেন রোহিঙ্গা এবং আগের মামলার আসামি। তদন্তের এক পর্যায়ে আমরা তাকে গত ২৮ মার্চ বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে গ্রেপ্তার করি,' বলেন তিনি।

মোজাম্মেল বলেন 'ইএস স্লিপে আসামির নাম ঠিকানা থাকে, কোনো ছবি থাকে না। যার ফলে কেউ যদি অন্য কারো নাম ব্যবহার করেন তাৎক্ষণিকভাবে প্রকৃত আসামি শনাক্ত করা কঠিন। জেলখানায় ছবি থাকার কারণে আমরা প্রকৃত আসামিকে খুঁজে পেয়েছি।'

এই মামলায় প্রকৃত আসামি আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে গত ১৭ সেপ্টেম্বর আদালতে সম্পূরক চার্জশিট জমা দিয়েছে পিবিআই। মামলা থেকে বাংলাদেশি নাগরিক সালাউদ্দিনকে দায়মুক্তির কথা বলা হয়েছে। মামলাটি আদালতে বর্তমানে বিচারাধীন।

পিবিআই মেট্রোর পুলিশ সুপার নাঈমা সুলতানা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ইএস স্লিপে আসামির ছবি থাকলে নিরীহ মানুষ হয়রানি থেকে মুক্তি পাবে। আমাদের কাছে এইরকম অনেক উদাহরণ আছে যারা নামের কারণে এবং ছবি না থাকায় হয়রানির শিকার হয়েছেন।'

সালাউদ্দিন যোগ করেন, 'কিছু না করেও পুলিশের আসামির খাতায় নাম উঠেছে। মামলা থেকে অব্যাহতি পেলেও পুলিশের সার্ভার থেকে কীভাবে নাম কাটাব সেটা নিয়ে চিন্তিত।'

Comments

The Daily Star  | English
Kudos for consensus in some vital areas

Kudos for consensus in some vital areas

If our political culture is to change, the functioning of our political parties must change dramatically.

3h ago